Dr. Aminul Islam

Published:
2020-06-08 15:52:35 BdST

স্বাস্থ্য খাতে যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে : ২৫টি ক্ষুরধার প্রশ্ন বিএমএ মহাসচিবের


ডেস্ক

________________

স্বাস্থ্য খাতে যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে: শিরোনামে এক মুক্ত লেখায় বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন: বিএমএ মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী অন্তত: ২৫টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ক্ষুরধার প্রশ্ন তুললেন। সেসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া বড় জরুরি। কেননা , সেসব প্রশ্নের মাঝেই আছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের হাল। করোনা পরিস্থিতিতে বেসামাল বেদিশা অবস্থার প্রকৃত চিত্র।

ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরীর লেখাটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ হল।

 

স্বাস্থ্য খাতে যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে/ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী

এক যুগের বেশি সময় আগে উপজেলায় চাকরি করেছিলাম। সেই উপজেলায় ম্যালেরিয়া মশা প্রতিরোধক নেট (মশারি) বিতরণ শেষে একজন এনজিও কর্মকর্তা এসে বললেন, স্যার, ১৮৭টি মশারি বিতরণ করা হয়েছে, এ তালিকায় স্বাক্ষর করেন। আমি তাকে পরদিন বিকেলে আসতে বললাম। উপজেলার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে আমার স্বাক্ষরসহ ওই বিতরণ তালিকাটি তিনি তার প্রধান অফিসে প্রেরণ করবেন। পরদিন সকালবেলা নিজে মোটরসাইকেল চালিয়ে তালিকাভুক্ত পরিবার যাচাই করতে গিয়ে তালিকাভুক্ত প্রথম ১৬টি পরিবারের মধ্যে মাত্র দুটি পরিবার মশা প্রতিরোধক নেটপ্রাপ্তির কথা স্বীকার করল। আর বাকিরা পায়নি বলে জানাল। আমি আর কষ্ট করে বাকিগুলো দেখিনি এবং সেই তালিকাটিতেও স্বাক্ষর করিনি।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে এবং স্বাস্থ্য কাঠামোকে গণমুখী করে গড়ে তুলতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে একজন চিকিৎসককে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। চিকিৎসকরা প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পেলেন। উপজেলা ও কোন কোন ইউনিয়নে স্বাস্থ্য স্থাপনা তৈরি করে প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেল। এ এক জাদুকরি ঐতিহাসিক ঘটনা।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৬ সাল-পরবর্তী এ পর্যন্ত দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল প্রাপ্তি ঘটেছে। আমাদের প্রাইমারি হেলথ কেয়ার আর ইপিআই বিশ্বের নজরকাড়া সাফল্য পেয়েছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে অসংখ্য মৌলিক বিষয় সংযোজিত হয়েছে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা শেখ হাসিনার নির্দেশ আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।

কষ্ট নিয়েই বলতে হয়, মহামারি করোনা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অনেক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা আমাদের নতুন করে ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও টেকনিক্যাল বটে। বিগত কয়েক বছর শুধু কেনাকাটাই যেন ছিল মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। জেলায় জেলায় সিভিল সার্জন অফিস কিংবা ছোট-বড় হাসপাতালগুলোতে কী কী কেনাকাটা হবে, কোথায় স্থাপনা নির্মাণ হবে, এগুলোতেই মন্ত্রণালয় ব্যস্ত ছিল। আর অনেক ক্ষেত্রে কেনাকাটারই চাহিদা ঠিক করে দিতেন হাসপাতাল কিংবা সংশ্নিষ্ট বিভাগের চিকিৎসক নয়, মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের ঠিকাদাররা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই কেনাকাটা নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের না দিতে পারলে অনেক হাসপাতাল ব্যবস্থাপক ওএসডি কিংবা বদলি হয়েছেন।

সমসাময়িক করোনার ছোবল মোকাবিলায় মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর সম্পূর্ণ প্রস্তুত বলে দাবি করে আসছিল। দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার আগে দেশের কোন কোন হাসপাতালটি কভিড ডেডিকেটেড ছিল, কোথায় কোথায় আইসিইউ ছিল, কত শয্যার আইসিউ ছিল, কোন হাসপাতালে ফ্লু-কর্নার স্থাপন করা হবে, কোন হাসপাতালে ট্রায়াজ সিস্টেম হবে, ডায়ালাইসিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ জটিল রোগের রোগীরা কোন হাসপাতালে কীভাবে চিকিৎসা নেবেন, কতজন ডাক্তার-নার্স-ওয়ার্ডবয়-ক্লিনার কভিড মোকাবিলার ট্রেনিং নিয়েছিলেন, চিকিৎসা সুরক্ষা সরঞ্জাম কোথায় ছিল, এগুলো ব্যবহারের ট্রেনিং কখন দেওয়া হলো, কতটা টেস্টিং ল্যাবরেটরি ছিল তা আমরা কেউ জানি না। সেই মশারি বিতরণের মতো এগুলো কি শুধু খাতা কিংবা কম্পিউটার শিটে লিখে রেখে প্রস্তুতির খবর দেওয়া হয়েছিল? দুই হাজার কিট নিয়ে আইইডিসিআর যে হিরোইজম দেখাল, তা কীসের ভিত্তিতে? তাদের কাজ তো গবেষণা করা, তারা তো রিসার্চ ল্যাবরেটরি, সার্ভিস ল্যাবরেটরি নয়। নিপসম, সিডিসি কোথায়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে রোগ নির্ণয়ের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে আজও অধিদপ্তরের কোনো কোনো পরামর্শক মিডিয়াকে বলেন, রোগ নির্ণয় এত জরুরি নয়। এরা কারা? তাহলে আজ ৪৮টিরও অধিক ল্যাব তৈরি করেও বলা হচ্ছে কেন আরও ল্যাব লাগবে? গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তাড়াহুড়ো করে আজ ২০০৯ সাল মডেলের আরটিপিসিআর মেশিন কেন কেনা হচ্ছে? কারা এগুলো কেনার পরামার্শ দিচ্ছে? কোনো কোনো হাসপাতাল সেই মেশিন না নিতে চাইলে অনুরোধ করে সেগুলো আপাতত রেখে দেওয়ার কথা কেন বলা হচ্ছে? ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ও মাস্ক নিয়ে এত কেলেঙ্কারি হলো কেন? কেন তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে পরিচালককে ওএসডি এবং বদলি করা হলো? মাস্ক কেলেঙ্কারি তদন্তের রিপোর্ট কোথায়? পরিচালক বদলি করতে সময় লাগে না; তবে এ তদন্তে ক্ষমতাশালী মন্ত্রণালয়ের এত সময়ক্ষেপণ কেন? এত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, আক্রান্তের দায় ভার কে নেবে? বাংলাদেশে এযাবৎকালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের কথা অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলতে লজ্জা কেন?

মনীষীরা বলেন, একটা খারাপ সময়ও অনেক ভালো আগামীর প্রস্তুতির সুযোগ করে দেয়। করোনাকালের সমাপ্তি শেষে জগৎ সংসার আলোকিত হবেই। সেই আলোকিত বাংলাদেশে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আর কোনো দুর্নীতি দেখতে চাই না, দুর্নীতির পক্ষে না থাকার কারণে কোনো কর্মকর্তার শাস্তিমূলক বদলি-ওএসডি দেখতে চাই না। আমরা কম্পিউটারে ছাপাকৃত রিপোর্টের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজও দেখতে চাই; আমরা সরকারের চিন্তা ও চেতনার সঙ্গে আনুগত্যশীল কর্মকর্তাদের মন্ত্রণালয়ের ও অধিদপ্তরের প্রধান পদে দেখতে চাই; আমরা অধিদপ্তরে দক্ষ, সৎ, মাঠ পর্যায়ের কর্মীকে দায়িত্বশীল পরিচালক পদে দেখতে চাই। আমরা অধ্যাপকদের অধ্যাপনার পদ ও অধিদপ্তরের যে পদে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী তাদের থাকার কথা, সেই পদে দেখতে চাই। বিজ্ঞ আদালত কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিরুদ্ধে যারা কাজ করে ধৃষ্টতা দেখান, তাদের আমরা কোথাও দেখতে চাই না। মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের সবজান্তা কর্মকর্তাদের নিষ্ফম্ফল প্রয়াসের দায়ভার চিকিৎসক সমাজ কিংবা জাতি নিতে চায় না। সরকারের চেতনাবিরোধী ব্যর্থ ব্যক্তিদের দায়ভার জননন্দিত সরকার বহন করবে কেন? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বক্ষেত্রে ক্যাডার কম্পোজিশনের পুরোপুরি বাস্তবায়ন চাই।

আমরা স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি চাই, হাসপাতালগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রচুর পরিমাণে জনবল নিয়োগ করে জনগণের জন্য যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের উদ্যোগ দেখতে চাই। রাজাকার সন্তান, লুটেরা, নীতিবিবর্জিত আর অক্ষম ব্যক্তিদের হাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখতে চাই না। আমরা কর্মস্থলে নিরাপত্তা চাই, দ্রুত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন চাই, নবীন চিকিৎসকদের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং চাই। চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষণার ক্ষেত্র চাই। আমরা মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা ও বিশৃঙ্খলার অবসান চাই। প্রশাসনের ব্যর্থতার দায়ভার চিকিৎসকরা বহন করবে কেন? ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা জীবন দিয়েছি, আগামী দিনের সব প্রয়োজনে আমরা সাহসিকতার সঙ্গে লড়তে চাই। আর ভর্ৎসনা নয়, আমরা আমাদের কাজের যোগ্য মর্যাদা চাই।

বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতার মতো মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী সর্বোচ্চ পদে চিকিৎসকদের পদায়িত হতে দেখতে চাই। কর্মক্ষেত্রে বারবার ব্যর্থ কিংবা সরকারের চিন্তা ও চেতনাবিরোধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোথাও দেখতে চাই না। যোগ্য, দক্ষ স্বাস্থ্য প্রশাসকদের অধিদপ্তরে দেখতে চাই। সব দুর্নীতির বিচার চাই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা জনকল্যাণমুখী হবেই। তিনিই এ দেশের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার শেষ বাতিঘর।

_____________________________

Ad..

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়