Ameen Qudir
Published:2017-01-20 14:44:06 BdST
১২ বছর স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি : দিনে ২৫ বার আয়নায় নিজে দেখে আর ভাবে
অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম
_________________________
১। বড় বোনের বিয়েতে সে পালিয়ে যায়।
অনুষ্ঠান শেষ হলে এসে বলে আমি গাছে উঠে অনুষ্ঠানের সব কিছুই দেখেছি।
---- ২৮ বছরের তরুন স্বেচ্ছায় গৃহ বন্দি ১২ বছর
২। ১৭ বছরের পূর্নিমা সারাক্ষণ কাদে,চিৎকার করে
আমার নাক ঠিক করে দাও, না হয় মেরে ফেলো।
রোগের নাম Body Dysmorphic Disorder(BDD)-- দৈহিক গঠনে কল্পিত খুত নিয়ে হাহাকার
( উভয় রোগী ও তাদের অভিভাবকদের সম্মতিতে ছবি দিয়েছি।ছেলেটি বলেছে যদি ছবি দেখে সবাই বলে চেহারা খারাপ নয় ভালো, তাহলে তার ভালো লাগবে ও তার মত বদলাতেও পারে।মেয়েটি বলে ছবি দেখে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিন, আমার ব্যাপারে কি ব্যবস্হা নেওয়া যায়।
আপনারাই বলুন তাদের চেহারা কি খারাপ,নাক কি বিকৃত?)
বিশেষ করে কৈশোর কালে শারীরিক গঠনের ক্রটি নিয়ে আমরা অনেকেই হীনমন্যতায় ভুগি।
আমরা সবাই উত্তম কুমার বা সুচিত্রা সেন হতে চাই।
সামান্য ক্রটি থাকলে বা অন্য কেউ চেহারা নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করলে, আমরা নিজের দৈহিক সৌন্দর্য ও দৈহিক গঠন নিয়ে অতৃপ্তিতে ভুগি,হীনমনযতায় ভুগি।
এটি কমন সমস্যা।
কিন্তু কখন কখন কারো কারো মধ্যে নিজের চেহারার কোন কাল্পনিক খুত এমন ভাবে তার চিন্তা মননে বাসা বাধে যে,
সারাক্ষন ঐ কাল্পনিক খুতের কথা তার মনে আসতে থাকে,
সারাক্ষন ঐ যন্ত্রনায় পিষ্ট হতে থাকে।
তার হয়তো আদৌ ও তেমন খুত নেই( পুরোটাই কাল্পনিক- যেমন আজকে বর্নিত উভয় রোগীর)
বা থাকলে ও খুবই সামান্য যা ধর্তব্যের মধ্যে পরে না।
এই কাল্পনিক খুত তারা ঢেকে রাখতে চায
সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায়,
সবাইকে এড়িয়ে চলতে চায়,
বার বার আয়নায় সেটি চেক করে।
তাদের এই ধারনা যে ঠিক নয়, তা তাদের বেশীর ভাগই বুঝতে পারে না।
এমনকি সেটি বদ্ধমূল দৃড় ভ্রান্ত বিশ্বাসে রুপ লাভ করতে পার, যাকে আমরা ডেলুসনাল বিলিভ বলি
( আমাদের উভয় রোগী এ পর্যায়ের)।
নাক,চোখ,ঠোট,স্তন,লিঙ্গ প্রভৃতির ক্রটি নিয়ে এরা বেশী ভুগে।
তবে যে কোন অঙ্গ নিয়েই তা হতে পারে
.....................................................
কেইস-১
তানভীর , বর্তমানে বয়স ২৮।
সে ছিল ক্লাশে ফার্স্ট বয়।
২০০৪ সনে তার মা লক্ষ্য করলো সে স্কুলে অনিয়মিত যাচেছ।
একদিন যায় তো তিন দিন যায় না।
মা নিজে তাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়ে আসতো, কিন্তু সে ঘুরে বাড়ী ফিরে আসতো।
কারন জিজ্ঞেস করলে বলে, চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে,অদ্ভুত চেহারা, সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে,বিশেষ করে মেয়েরা।
মা মেয়েদেরকে জিজ্ঞাস করে,তারা বলে না খালা আমরা এমন কিছু বলি নাই।
স্কুলে সে মেইন গেট দিয়ে ঢুকতো না,দেওয়াল টপকে স্কুলে ঢুকতো ও চুপিসারে ক্লাশে ঢুকে যেতো।
বাড়ী থেকে বের হয়ে মূল রাস্তা দিয়ে যেতো না,চিপা গলি দিয়ে যেতো,কেউ দেখলে দূরত চলে যেতো।
ঘরে এসে ঝুম মেরে শুয়ে থাকতো।
আস্তে আস্তে স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
ক্লাশের ফার্স্ট বয় পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে না, তাই টিচার ও মা মিলে হোন্ডায় বেধে স্কুলে নেয়।
স্যারের রুমে বসে ঐ পরীক্ষা দেয়।
কিন্তু পরদিন আর যায় না।
এ ভাবে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
সারাক্ষণ বাসায় বসে থাকে।
ভালো খেলতে পারতো, সে খেলাও বাদ দিয়ে দিয়েছে।
বাজারে যায় না,আত্মীয় বাড়ী যায় না।
এক কথায় গত ১২ বছর স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হয়ে রয়েছে।
বাসায় টিভি দেখে,গান শুনে ও নামাজ পড়ে ।
দিনে ২০-২৫ বার আয়নায় চেহারা দেখে।
মনে হয় অদ্ভুত,পাগলের মতন চেহারা
রান্না ঘরের কোনায় গিয়ে ভাত খায়,যাতে কেউ না দেখে।
ঐ সময় ঘরে রঙ্গিন টিভি ছিল না।কিন্তু রঙ্গিন টিভি দেখার শখ।তাই পাশের দোকানে রাতের অন্ধকারে পিছন দিকে গিয়ে উকি দিয়ে টিভি দেখতে যেতো।
এর মাঝে বড় বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান।
অনেক লোক আসবে,তাই লজ্জায় সে পালিয়ে যায়।
বোন তো ভাইকে ছাড়া বিয়ে করবে না।সবাই বুঝিয়ে
কোন রকমে বিয়ে পড়িয়ে দেয়।
অনুষ্ঠান শেষে সে বাড়ী এসে বলে আমি গাছে উঠে সব অনুষ্ঠানই দেখেছি।
আত্মীয়রা এসে বলে তুমি ক্রিকেট খেলতে পারো?
তার মন চিৎকার করে উঠে, হায়রে তোমরা জানো না আমি কত ভালো খেলোয়ার।
তাকে ইন্টার্ভিউ করার সময় জানায, স্যার আমার এই কদাকার চেহারার কারন আমার পাপ।
আমি অল্প বয়স থেকেই মাস্টারবেসন করতাম।
ক্লাশ সিক্স- সেভেন থেকে তা বেড়ে যায়।
দিনে ৫-৬ বার ও করতাম।আত্মীয় স্বজনদের আন্ডার গার্মেন্ট এনে হস্ত মৈথুন করতাম।
নিজের উপর অনেক অত্যাচার করেছি,অনেক পাপ করেছি।
কিছুদিন পর অনেকেই বলতে থাকে তুই শুকিয়ে গেছিস।
বার বার এ রকম শুনাতে আয়নায় চেহারা দেখে মনে হলো তাইতো, চেহারা কেমন অদ্ভুত হয়ে গেছে।
ঘর থেকে বের হলেই শুনি ও দেখি আমাকে দেখে সবাই হাসাহাসি করছে।
এটি মিথ্যে নয় স্যার,বিশেষ করে মেয়েরা বেশী হাসে।আমার চেহারা নাকি পাগলের মতন।
আমার এ রোগের জন্য খালু বলে হাসপাতালে ভর্তি হতে।
আমি চিৎকার করে বলি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে কি হবে,এটি আমার পাপের শাস্তি।আমি আপনার মেয়ের, স্ত্রীর কাপড় দিয়ে মাস্টারবেসন করেছি।
এক সময় সবাইকে প্লাস্টিক সার্জারীর কথা বলি।তারা বলে ডাক্তারের ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
যখনই মনে হয় হস্তমৈথুনের পাপের কারনে আজ আমার এ দশা তখনই অস্হির হয়ে পড়ি,মেঝেতে শুয়ে পরে চিৎকার করি
একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি কিন্তু ব্যর্থ হই।
এখন ও আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে।
.................................................
কেইস-২:
পূর্নিমা ১৭ বছরের মেয়ে।
৩ সপ্তাহ আগে মুখ ধুতে গিয়ে তার ভাষায় আঙ্গুলের নখের আঘাতে, তার নাকের মাংস ছিলে যায়।
এর পর থেকেই সে সারাক্ষন চিৎকার করে কাদছে,
আমার নাক নষ্ট হয়ে গেছে,
বিকৃত হয়ে গেছে,
আমার নাক ঠিক করে দাও।
সে ঘুমায় না,কেবল কাদে।
বার বার আয়নায় নাক চেক করে,হাত থেকে আয়না সরায় না।
অস্হির থাকে,হাত পা খামচায়,বলে চামড়া এনে দাও,নাক ঠিক করে দাও।
ওড়না দিয়ে নাক ঢেকে রাখে যাতে কেউ না দেখতে পায়,
কম্বল নিয়ে শুয়ে থাকে।
খায় না,টিভি দেখে না কেবল হাহাকার, নাক খারাপ হয়ে গেছে,
আমাকে মেরে ফেলো।
কয়েকবার হুইল পাউডার খেয়ে মরতে গেছে।
সবাই বলে ঠিক আছে, সে আয়না দেখে বলে কিছুই ঠিক নাই,
কেউ ভালো করতে পারবে না,
আমাকে মেরে ফেলো
.............................................................
টেক হোম ম্যাসেজ-- সবার যা জানা উচিৎ:
১।আমাদের আত্ম মর্যাদাবোধ দুর্বল হয় , যদি ভাবি আমরা অন্যদের থেকে কোন দিক থেকে ছোট,হেয়।
দৈহিক গঠন ও সৌন্দর্য এর অন্যতম একটি দিক,বিশেষ করে কৈশোর- তারুন্যে।
আত্ম মর্যাদা বোধ উচু রাখতে হলে এ ধরনের হীনমন্যতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
প্রয়োজনে প্রফেসনাল কাউন্সিলিং নিতে হবে।
২। যদি খুত বিষয়টি রোগ পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে দ্রুত সাইকিয়াট্রস্ট এর স্মরনাপন্ন হন।
তা না হলে আত্ম হত্যা করে মৃত্যু বা গৃহবন্দি হয়ে অকর্মন্য,কষ্টদায়ক জীবন বেছে নিতে হতে পারে।
৩। ছেলেদের হস্তমৈথুন,মেয়েদের মাসিক নিয়ে আমাদের রয়েছে রাখঢাক গুরগুর অবস্হা।
এ সব বিষয়ে রয়েছে নানাবিধ কুসংস্কার, মিথ যা জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন রকমের মানসিক রোগের।
ধাত সিন্ড্রম তার অন্যতম
৪। থট,পারসেপশন গুরুত্বপূর্ণ।
চাক্ষুষ প্রমান সত্বেও এই দুই রোগী নিজেদের ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল।
তেমন ডেলুসন না আমাদের চিন্তা,দৃষ্টি ভঙ্গি,পারসেপশনে থাকতে পারে এমন ক্রটি।
সুস্হ জীবন,সুস্হ সমাজের জন্য প্রয়োজন সঠিক, সুস্হ চিন্তা ও পারসেপশন।
নিজের আয়নায় নিজকে যা মনে হয়, তা সব সময় সঠিক না ও হতে পারে।
________________________________
লেখক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। জনপ্রিয় লেখক কলামিস্ট। Professor of Psychiatry at National Institute of Mental Health, Sher-E-Bangla Nagar, Dhaka
আপনার মতামত দিন: