রাতুল সেন

Published:
2020-05-19 03:27:54 BdST

সেনসেশন বনাম সায়েন্সঃ জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক


অধ্যাপক ডা. সেজান মাহমুদ


 প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ 

_____________________

আইভারমেক্টিন/ইভারমেক্টিন এবং ডক্সিসাইক্লিন ওষুধ নিয়ে পত্রিকায় গয়রহ সংবাদ পরিবেশন করেন অনেকে। শিরোনামগুলো এরকম ছিল-
" দেশে করোনা চিকিৎসায় বড় সাফল্য, দুটি ওষুধের সম্মিলিত ব্যবহারে তিনদিনে ৫০% ভাগ সুস্থ, চারদিনে শতভাগ"
আমি আমার স্ট্যাটাসে এইসব সাংবাদিকদের একটু কটু ভাষায় লিখেছিলাম। এখন বিস্তারিত জেনে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বের কথা চিন্তা করে, আবারো লিখছি। কারণ, এখানে শুধু সাংবাদিকদের দোষ দেয়া ঠিক না। সব পক্ষের দায়িত্ব নিয়েই কথা বলা উচিত।

কালের কণ্ঠ ডা তারেক আলম এবং ফার্মাকোলজির প্রফেসর ডা সায়েদুর রহমানের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন গত ১৬ তারিখ রাতে। দেখা যাচ্ছে ডা তারেক আলম বা তাঁর পক্ষের কেউ এটাকে গবেষণা (যদিও তিনি বলেছেন কেউ বাংলায় অনুবাদ করতে ভুল করেছে) এবং বিষ্ময়কর সাফল্য হিসাবে বর্ণনা করেছেন এবং প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছেন (আমার কাছে কপি আছে)। আমি শুধু পত্রিকার নিউজের সমালোচনা করেছিলাম, ডাক্তারের না। তারপর আমার পরিচিত ক্লিনিশিয়ান কেউ কেউ যেহেতু ডা তারেক আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত ক্লিনিশিয়ান তাঁর সমালোচনা করার অধিকার নাই, অন্যান্য মাধ্যমেও অনেক জুনিয়ার ডাক্তাররা এজাতীয় কথা লিখেছেন যারাই তাঁর সমালোচনা করেছেন তাঁদের কে। এঁর মধ্যে একটা যুক্তি হলো আপনি কয়টা রোগী দেখেন? কিছুদিন আগেই আমি মেডিসিন আর মেডিক্যাল সায়েন্সের পার্থক্য নিয়ে লিখেছি। যিনি রোগী দেখেন তিনি মেডিসিন প্র্যাকটিস করছেন যা মেডিক্যাল সায়েন্সের প্রাক্টিক্যাল দিক। যারা মেডিক্যাল সায়েন্স করছেন তাঁরা রোগী না দেখলেও তাঁরাই তো তৈরি করে দিচ্ছেন চিকিৎসক কী প্র্যাকটিস করবেন, কী গাইডলাইন গবেষণার মাধ্যমে এভিডেন্স বা প্রমাণ তৈরি করে। তাই এজাতীয় কথা বলা মুর্খতার সামিল, যিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানী তিনি সমালোচনা করতেই পারেন বিজ্ঞানের পদ্ধতি নিয়ে, এভিডেন্স নিয়ে। তাই গবেষণা ও প্রমাণ নিয়ে কয়েকটা কথা বলিঃ

গবেষণা করার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। প্রথমতঃ স্টাডি ডিজাইন - কী পদ্ধতিতে সেই গবেষণা হবে তা ঠিক করা, ক্লিনিক্যাল ইন্টারভেনশন হলে কন্ট্রোল্ড স্টাডি, নানান রকমের বায়াসকে সরিয়ে ফলাফলের স্ট্যাটিস্টিকাল সিগনিফিকান্স দেখা, দ্বিতীয়ত স্ট্যাটিস্টিকাল সিগনিফিকান্স দেখা গেলে তার ক্লিনিক্যাল সিগ্নিফিকেন্স আছে কিনা তা পরখ করা, তৃতীয়ত পিয়ার রিভিউ করা (যার মানে হলো অন্যান্য বিজ্ঞানীরা সমালোচনা করবে যাতে চারিদিক থেকে নিশ্ছিদ্র হয়), চতুর্থত সেটাতে উত্তীর্ন হোলে জার্নাল বা কনফারেন্সে প্রকাশ — এসব ধাপ পেরুতে হবেই। ধরুন, এপিডেমিকের সময়ে মানুষ শর্টকার্ট চাইবে, কিন্তু সেটারও পদ্ধতি আছে। সেখানে যোগ্যব্যক্তিদের দিয়ে সমালোচনা করিয়ে নেয়া আরও জরুরী, যাকে বলা হয় এক্সপিডাইটেড ক্রিটিক্যাল এভালুয়েশন।

কিন্তু বাংলাদেশের কিছু বিজ্ঞানী ও গবেষক, চিকিৎসক শর্ট-কাট ক'রে সাংবাদিক সম্মেলনে চলে যাচ্ছেন সরাসরি। আর তার সাথে সাথে নিজেদের অপ্রমাণিত বা সামান্য কাজের ফুলিয়ে ফাপিয়ে প্রচার করার ব্যবস্থা করছেন মিডিয়াতে! “এই প্রথমবারের মত বাংলাদেশে” বা " বাংলাদেশেই তৈরি হল সর্প্রথম' এজাতীয় হেডলাইনে দিয়ে। অথচ পুরো ব্যাপারটাই হয়তো একেবারেই সাধারণ কাজ বা অপ্রমাণিত আন্দাজ! যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

ডা তারিকের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা হলো তিনি একজন ভাল ক্লিনিশিয়ান, ফুসফুস ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ। তিনি তাঁর বিবেচনায় কিছু রোগীকে এই ওষুধ দিয়েছেন (৬০ জন কে) এবং তাঁর দৃষ্টিতে 'ভাল ফলাফল' পেয়েছেন। কিন্তু আমরাও বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁর ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন করতেই পারি। যেমন, যেহেতু কোভিড রোগীদের ৮০% এমনিতেই সাধারণ কেয়ারে (সিম্পটমেটিক কেয়ার) ভাল হয়ে যান, তাই ৪২ জন হয়তো এমনিতেই ভাল হয়েছেন। বাকি ১২ জন দিয়ে কোন স্টাডি হয় না। তাছাড়া কোন কন্ট্রোলড স্টাডি না। একজন স্পেশালিষ্ট হিশাবে তাঁর এটি জানার কথা। এই গেল সায়েন্সের পার্ট। তিনি যদিও পরে বলেছেন এটা কোন গবেষণা না। একজন ক্লিনিশিয়ান কিন্তু এভাবে চিকিৎসা দিয়ে এনেকডোটাল এভিডেন্স তৈরি করতে পারেন। বিজ্ঞানে এই এভিডেন্সের একটা পিরামিড আছে যার একেবারে তলায় এই 'এনেকডোটাল এভিডেন্স', যার মূল্য খুব সামান্যই। তিনি যেটা ভুল করেছেন এবং উপকারের চেয়ে অপকার বেশি করেছেন তা হলো সাংবাদিকদের কাছে প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে প্রচার করা। উচিত ছিল বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন বা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো। অন্যদিকে যে কেউ প্রেস রিলিজ দিয়ে যে কোন কিছু দাবি করতে পারেন, সাংবাদিকদের কাজ হলো তাঁর সত্যতা যাচাই করা। ছাপার আগেই কোন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীকে জিগ্যেস করে নিতে পারতেন সাংবাদিক ভাইয়েরা।

লক্ষ্য করুন ক্ষতি কী কী হলোঃ
১। বাংলাদেশে এমনিতেই প্রেসক্রিপশন ছাড়া যে কোন ওষুধ কেনা যায়। আমেরিকা বা ইউরোপে তা যায় না। তাই সবাই গয়রহ বেশি দাম দিয়ে হলেও এই ওষুধ দুটো কিনে খাওয়া শুরু করলেন। সাইড-ইফেক্ট না হয় বাদই দিলাম, ইম্প্রপার ব্যবহারে ওষুধের কার্যকারীতাও শেষ হয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্যে। পৃথিবী জুড়ে এন্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস রেজিস্ট্যান্স তৈরি করছে যার মূল কারণ, ওষুধের এই অপব্যবহার।
২। পাবলিক ট্রাস্ট- মেডিক্যাল সায়েন্সে পাবলিক ট্রাস্ট বা জনবিশ্বাস খুব গুরুত্বপূর্ণ। এধরনের প্রচার সেই বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়। আমি আপনাদের গ্যারান্টি দিচ্ছি- তিনি যদি আমেরিকায় প্র্যাকটিসের সময় পত্রিকায় এই রকম দাবি করে বিজ্ঞাপন দিতেন-এত দিনে শত শত মামলা হয়ে যেতো ডাক্তাদের বিরুদ্ধে। পাবলিক ট্রাস্ট তৈরি হতে লাগে বছরের পর বছর, আর ভাঙতে লাগে এক মিনিট।
৩। বাংলাদেশে জুনিয়ের ডাক্তারেরাও মনের সুখে এনেকডোটাল এভিডেন্স খুঁজবেন। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন রোগীরা।
৪। বাংলাদেশে রোগীদের অধিকারের কোনকিছু ঠিকমতো দেখা হয়না সেই অধিকারও কিছুটা নষ্ট হবে। যেমন, যতো গরীব মানুষই হোক, আপনি তাকে গবেষণায় ব্যবহার করতে চাইলে তাঁর সম্মতি (কোন মিথ্যা তথ্য না দিয়ে ক্ষতি, সম্ভাব্য ক্ষতি সব তাঁর ভাষায় বুঝিয়ে দিতে হবে)। না হলে, বড় বড় ওষুধ কোম্পানি দুনিয়া জুড়ে নানান অন্যায় স্টাডি করবে (আমি শত শত উদাহরণ দিতে পারি যা নিয়ে গবেষণা, এডভোক্যাসি আছে আমার, যা আমেরিকার ডাক্তার, মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের পড়াই)।

দিন শেষে আমরা সবাই দেশের মানুষের মঙ্গল চাই। দেশের ভবিষ্যৎ চিকিৎসা ব্যবস্থা, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার নির্মাণ চাই। কেউ কাউকে ছোট করতে না, বরং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সমালোচনা (পীয়ার রিভিউ) গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। যিনি সমালোচনা করবেন তিনিও নিরপেক্ষ এবং নৈর্ব্যক্তিকভাবে করবেন। এভাবেই বিজ্ঞানের সংস্কৃতি তৈরি হবে যা আমাদের সকলের জন্যে মঙ্গল বয়ে আনে।

তাই নিজেদের একটু সংযত রাখুন। মানুষকে কম বিভ্রান্ত করুন। জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করুন। সকলেই নিরাপদে, সুস্থ থাকুন।

AD..

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়