ডাক্তার প্রতিদিন

Published:
2020-05-12 16:43:26 BdST

কোভিড-১৯: বাংলাদেশে লকডাউন শিথিলের কোন সুযোগ আছে কি?


ডা. মো. মারুফ হক খান
এমবিবিএস, এমপিএইচ, এমএসসি, পিএইচডি
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
______________________


করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাস নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের চলমান লকডাউন (!) এর শিথিলতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত দেখা যাচ্ছে। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এখনো লকডাউন শিথিলতার কোন সুযোগ বা প্রসঙ্গিকতা দেখছি না।

করোনা যেহেতু সহজে সংক্রামিত (ছোঁয়াচে) হয় এবং এখনো পর্যন্ত কোন ভ্যাকসিন বা কার্যকরী ঔষধ আবিস্কার হয়নি (ট্রায়াল চলমান), সেহেতু সংক্রামণ প্রতিরোধ করাই প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। বিগত চার মাসের অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায় যে করোনা সংক্রামণ প্রতিরোধে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ‘লকডাউন’ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে এবং কিছু দেশ ইতিমধ্যে এর সফলতা পেয়েছে (যেমন: চীন); আবার কিছু দেশ (যেমন: জাপান) ‘জরুরী অবস্থা’ জারি করে অধিক জনসমাগম নিষিদ্ধ করে, প্রয়োজন ছাড়া ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে, নির্দিষ্ট কিছু দেশ হতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে যাথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশও গত ২৬ শে মার্চ হতে লকডাউন পদ্ধতি কার্যকর করে যাচ্ছে, যদিও প্রথম দিকে কিছু কর্তাব্যক্তিদের সমন্বয়হীনতার ফলাফল স্বরূপ লকডাউনের কার্যকারীতা কিছুটা কমে গেছে এবং লকডাউনের স্থায়িত্ব দীর্ঘ হচ্ছে।

জীবিকার তাগিদে ও নানাবিধ কারণ বিবেচনায় বর্তমানে আমাদের দেশে লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক কারণ আমাদের মতো একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের জন্য ‘লকডাউন’ দীর্ঘ মেয়াদে চালিয়ে নেওয়া খুবই দুরূহ একটি ব্যাপার। কিন্তু আমাদের দেশের সামগ্রীক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমি আরো কিছুদিন ‘লকডাউন’ মেনে চলার পক্ষপাতি, এবং পরবর্তিতে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে ভিন্ন ভিন্ন কর্মপন্থা ঠিক করে লকডাউন শিথিলের পক্ষপাতি।

নিচের বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এখনই লকডাউন শিথিলতার কোন সুযোগ দেখছি না:

* জনসংখ্যার ঘনত্ব: করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে অন্যকে সংক্রামিত করতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরেছে। আর প্রতিরোধের জন্য সামাজিক দূরত্ব (১মিটার বা ৩ ফুট; যদিও এখন ২ মিটার বলা হচ্ছে) বজায় রাখে নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে সংক্রামণ ঠেকানো বা হ্রাস করা অনেকটাই সম্ভব। কিন্ত আমাদের মতো মাত্রাধিক ঘনত্বের (১,১০৬ জন প্রতি বর্গকিলোমিটার) জনসংখ্যার দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে কার্যক্রম চালানো প্রায় অসম্ভব, যার কিছু নমুনা কিছুদিন পূর্বে লকডাউনের সাথে ছুটি ঘোষণার সময় ফেরি, লঞ্চ সহ অন্যান্য যানবাহনে দেখা গিয়েছে। অথচ উন্নত এবং কম জনসংখ্যার দেশসমূহে দেখা যায় যে তাদের দৈনন্দিন কর্মকান্ডে এরা প্রায় সকল সময় প্রস্তাবিত সামাজিক দূরত্বের চেয়েও বেশি দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করে; এমনকি অধিকাংশ জনগণ ব্যক্তিগত যান ব্যবহার করে বিধায় গণপরিবহনেও জনসমাগম অনেক কম থাকে (কিছু বড় বড় শহর ব্যতিত)।

* করোনা বিষয়ক স্বাস্থ্য সচেতনতা: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে, তা হলো আমাদের সচেতনতা ও করোনা বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করা। এমনি নানাবিধ কারণে আমরা জাতি হিসেবে সচেতন নয়, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।আমাদের চারপাশে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে, যেমন যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা, যেখানে সেখানে থুথু বা কফ ফেলা, অযথা হর্ণ বাজানো, মনের মাধুরি মিশিয়ে রাস্তা পারাপার হওয়া (এমনকি দেশের অধিকাংশ পাবলিক টয়লেট অতি প্রয়োজনে নাক ও চোঁখ বন্ধ করে ব্যবহার করতে হয়) ইত্যাদি। এমন একটি পরিস্থিতিতে গুটিকয়েকজন নানান পেশার নেতৃস্থানীয় কিছু ব্যাক্তি করোনা বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং ভুল ধারণা পোষণে সাহায্য করেছেন। এক শ্রেণীর লোক প্রথমে আমাদের জনসাধারণ কে বুঝিয়েছেন করোনা মুসলমানদের আক্রান্ত করবে না, করোনা মুসলমানদের রোগ নয়, মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশের অনেকে নিরীহ লোকজন এখনো তা বিশ্বাস করেন। আরেক শ্রেণীর লোক ছিল যারা বলেছেন, করোনা ঠান্ডা আবহাওয়ার দেশের রোগ, আমাদের দেশে আসবে না; আবার কেউবা বলেছেন করোনা সামান্য সর্দি জ্বর, এনিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরকম কিছু লোকের নানাবিধ ভুল তথ্য প্রদানের ফলে করোনা বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে প্রতিবন্ধতা তৈরি করছে।

* বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা: নানাবিধ সীমাবদ্ধতা, আমলাতান্ত্রীক জটিলতা, অপ্রতুল স্বাস্থ্যকর্মী ও অপরিকল্পিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা বহুদিন ধরেই আমাদের দেশে বিরাজমান (যা আমার পূর্বের একটি লেখায় কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম http://www.dainikamadershomoy.com/post/251620) । আমরা যদি করোনা প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে না পারি তাহলে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা দিয়ে মহামারী কালীন চিকিৎসা সেবা চালিয়ে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব হবে। যেখানে সাধারন সময়ে আমাদের দেশের সরকারী হাসপাতালগুলোতে বিছানার অভাবে রোগীকে মাটিতে রেখে চিকিৎসা প্রদান করা হয়ে থাকে (যদিও অসুস্থ রোগীর সুস্থতার জন্য জন্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা খুবই প্রয়োজন); সেখানে সংক্রামক করোনা রোগী সামাল দেওয়া যে কষ্টসাধ্য হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও করোনা আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর হাসতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়না, আক্রান্ত রোগীর ৫ শতাংশ রোগীও যদি হাসপাতালে ভর্তি হয় সংক্রামক রোগ বিবেচনায় তা সামাল দেওয়ার মতো আমাদের সক্ষমতা এখনো গড়ে উঠেনি, যেখানে উন্নত দেশ সমূহ তাদের পরিকল্পিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা নিয়েও হিমশিম খাচ্ছে। আমরা যদি আমাদের অধিক ঘনত্বের জনসংখ্যা এবং বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা নিয়ে করোনা প্রতিরোধে গুরুত্ব না দিয়ে প্রতিকারে বেশী গুরুত্ব আরোপ করি তাহলে তা হবে বড় ধরনের নির্বুদ্ধিতা।

* বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার: বাংলাদেশ সহ আমাদের নিকটবর্তী দেশ সমূহে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কিছু উন্নত দেশের তুলনায় কম বলে প্রতিয়মান হচ্ছে, আমাদের বংশগতি, জীবনযাপনের ধরণ ও ভাইরাসের মিউটেশন সহ আরো কিছু বিষয় এর সাথে সম্পর্কিত থাকতে পারে যার জন্য আগামীতে বিশদ গবেষণা প্রয়োজন; কিন্তু আমি মনে করি বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে আমাদের সক্ষমতার অভাব ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। জনবহুল একটা দেশে এখন পর্যন্ত (১১/০৫/২০) মাত্র ৩৭ টি কেন্দ্রে করোনার টেষ্ট করা হচ্ছে যা জনসংখ্যার তুলনায় খুবই নগন্য, কিছু দিন পূর্বে এই সংখ্যা আরো কম ছিল। এটা সহজে অনুমেয় করোনা পরীক্ষা যতো বাড়বে আক্রান্তের হার ততো বাড়বে। এছাড়াও আমাদের সমাজে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি একটি নেতিবাচক ও বিরূপ ধারণা একধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে যার ফলে অনেকে করোনার উপসর্গ থাকলেও টেষ্ট করতে অনীহা প্রকাশ করছে, করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করলেও প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন এবং গোপন রাখছেন।কাজেই আমাদের প্রাপ্ত করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার নিয়ে এখনি আশাবাদী (বা হতাশ) হওয়ার কিছু নেই! যদিও অদ্যবদি প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারের উর্ধ্বমুখি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

* জীবন, জীবিকা ও লকডাউনের স্থায়িত্ব: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এবং উদীয়মান অর্থনীতির একটি দেশে লকডাউন এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে হলে তা শ্রমজীবি সহ সকল পেশার লোকের জীবন এবং জীবিকার উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু সামগ্রীক জনগোষ্ঠীর জীবন যেখানে হুমকি মুখে সেখানে জীবিকাকে প্রাধান্য দেয়ার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করি। করোনা সংক্রামণ ও মৃত্যু হার সহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আগামী দিনে কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ধারণ করে এলাকা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে লকডাউন শিথিল করা যেতে পারে, তবে তার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত এবং পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা (আমার পূর্বের আরেক লেখায় এবিষয়ে কিছুটা আলেকপাত করেছিলাম https://www.niramoy24.com/archives/15864…)। যদি আগামী দিনে করোনায় অক্রান্তের হার ও হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন সামগ্রীকভাবে জীবন, জীবিকা এবং দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।

যেহেতু কোভিড-১৯ রোগটি নতুন, এখনো অনেক কিছু জানা সম্ভব হয়নি, ভ্যাকসিন বা কার্যকরী ঔষধ তৈরি হয়নি, সহজে সংক্রামিত হচ্ছে এবং বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরেছে, আমাদের দেশের জনসংখ্যার মাত্রাধিক ঘনত্ব, সচেতনতার অভাব, বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা, সীমিত সক্ষমতা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, অর্থনৈতিক অবস্থা সহ নানাবিধ বিষয়সমূহ বিবেচনায় করোনা প্রতিরোধে সর্বাধিক আগ্রাধিকার দিয়ে আমি আরো কিছুদিন লকডাউন চালিয়ে নেওয়ার পক্ষে, এখনই শিথিলতার এবং করোনাকে হালকাভাবে নেওয়ার কোন সুযোগ দেখছি না। সরকারের পাশাপাশি যদি দেশের সকল বিত্তবান ব্যক্তিবর্গ যার যার অবস্থান থেকে দরিদ্র মানুষের পাশে মহানুভবতা নিয়ে দাড়ায় তাহলে এই মহামারীকালীন কান্তিকাল সকলে মিলে অতিক্রম করা যাবে বলে আশা করি।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়