ডাক্তার প্রতিদিন
Published:2020-05-10 16:17:54 BdST
আইসোলেশন কি, তা প্রথম বুঝিয়েছিলেন একজন বাঙালী
শ্রেয়সী সেন
___________________
জানেন কি, আইসোলেশন কি, তা প্রথম বুঝিয়েছিলেন একজন বাঙালী!
বর্তমানে করোনা ভাইরাসের হানায় বিশ্ববাসী আক্রান্ত ও আতঙ্কিত। লকডাউন, আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং - শব্দবন্ধগুলো এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তবে জানেন কি, এই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং এবং আইসোলেশন কি, তা প্রথম বুঝিয়েছিলেন একজন বাঙালী? তাও আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে!
হ্যাঁ, তিনি চক্রপাণি দত্ত। একজন প্রসিদ্ধ বাঙালী চিকিৎসক এবং গ্রন্থপ্রণেতা। একাদশ শতকের শেষভাগে বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্গত ময়ূরেশ্বর গ্রামে (বর্তমান বীরভূমের অন্তর্গত) লোধ্রবলী কুলীন বংশে তাঁর জন্ম বলে মনে করা হয়। পিতা নারায়ণ দত্ত ছিলেন সমসাময়িক পালরাজা গৌড়রাজ নয়পালের রন্ধনশালার অধ্যক্ষ। চক্রপাণি প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন প্রাচীন ভারতীয় দুই প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক চরক ও সুশ্রুতের লেখা সংহিতা দুটির অনুপুঙ্খ টীকা রচনা করে। সে গ্রন্থদুটির নাম যথাক্রমে - 'চরকতত্ত্বপ্রদীপিকা' এবং 'ভানুমতী'। এই গ্রন্থদুটিতেই চরক ও সুশ্রুতের দেওয়া নিদানের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি জীবাণুঘটিত সংক্রামক রোগে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকার বিষয়টি বিশদে ব্যাখ্যা করেন।
চক্রপানি রোগের তিন প্রকার কারণসমূহের কথা বলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম, ‘অভিষঙ্গজ হেতু’। অর্থাৎ ভাইরাসের আক্রমণ। এই অভিষঙ্গজ বিষয়ে ‘সুশ্রুত সংহিতা’-র ৬ নং অধ্যায়ের ৩২ ও ৩৩ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘‘প্রসঙ্গাদ গাত্রসংস্পর্শাৎ নিশ্বাসাৎ সহভোজনাৎ।/ সহশয্যাসনশ্চাপি বস্ত্রমাল্যানুলেপনাৎ।।’’ এই শ্লোকদুটির অর্থনির্ণয় প্রসঙ্গে চক্রপানি লিখলেন যে, জীবাণু আক্রান্তকে ছোঁয়ার মাধ্যমে, তার হাঁচি-কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে, তাঁর সঙ্গে বসবাস, একই থালায় খাওয়া, একই বিছানায় শোওয়ার মতো কাজ করলে সুস্থ মানুষও তাঁর সংস্পর্শে এসে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর এভাবেই উপসর্গগুলি এক জনের থেকে অন্য জনে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই, আক্রান্ত ব্যক্তির সম্পূর্ণ পৃথক থাকাই বাঞ্ছনীয়। এটাই তো আইসোলেশন। তাই না?
সঠিক বিচারে, ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রানুযায়ী আইসোলেশনের কথা আমরা পাই সেই সুশ্রুতের আমলে অর্থাৎ খ্রীষ্টের জন্মেরও আগে থেকে। তবে বহুদিন পর্যন্ত সুশ্রুত সংহিতার বিষয়বস্তুর আলোচনা চিকিৎসক মহলেই সীমিত ছিল। চক্রপাণি দত্তই প্রথম তার সর্বজনবোধ্য ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে তাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। কাজেই, যা ছিল স্বল্প স্তরে সীমাবদ্ধ, তাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কৃতিত্বটি অবশ্যই এই বাঙালী সন্তানের প্রাপ্য। পরবর্তীকালে, তিনি নিজের মৌলিক গ্রন্থগুলিতেও ( চিকিৎসাসংগ্রহ, দ্রব্যগুণ ও সর্বসারসংগ্রহ) এই বিষয়টি আলোচনা করেছেন। উপাধি পেয়েছেন 'চরকচতুরানন' ও সুশ্রুতসহস্রনয়ন'।
আয়ুর্বেদ চর্চার পাশাপাশি একজন বিশিষ্ট রসায়নবিদও ছিলেন চক্রপাণি। তিনিই সম্ভবত পারদ-গন্ধকঘটিত লবণ (Mercury Sulphide) কজ্জলী বা রসপর্পটি আবিষ্কার করেন এবং ওষুধ হিসাবে তার প্রচলনও ঘটান। আবার চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও চক্রপাণি ব্যাকরণ ও ন্যায়দর্শন সম্পর্কিত গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল সুদূরপ্রসারী।
আজ আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র করোনা প্রতিরোধে যে সব উপায়ের কথা বলছে, তা মূলত সনাতনী আয়ুর্বেদ থেকেই নেওয়া, কেবল তার প্রয়োগে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। সাড়ে তিন হজার বছরেরও বেশী প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদের পিতৃপ্রতিম মহর্ষি সুশ্রুত সেই সকল প্রতিরোধমূলক বিধানের জন্মদাতা হলেও তাকে মানুষের বোধক্ষম করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন এই বাংলার এক কৃতী, বিবিধবিদ্যাবিশারদ, প্রতিভাবান সন্তান- মহামহোপাধ্যায় চক্রপাণি দত্ত।
- শ্রেয়সী সেন
সুলেখক
আপনার মতামত দিন: