Ameen Qudir

Published:
2020-04-05 19:51:07 BdST

একদিকে নবজাতকের মুমূর্ষু মা অন্যদিকে রোগী ডাক্তারদের সংক্রমণের শংকা ও আমাদের সীমাবদ্ধতা


 
ডাঃ এস এম মুইজ্জুল আকবর চৌধুরী
__________________________

সংকট থাকবেই; থাকবে করোনা ঝুঁকি: তবুও স্বপ্নগুলো বেচে থাক।

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় চারদিন আগে সিজারিয়ান অপারেশন হওয়া এক রোগী severe respiratory distress (শ্বাস কষ্ট) নিয়ে আমাদের চট্টগ্রাম মা- শিশু ও জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়। মেডিসিনে রোগীকে Post partum cardiomyopathy হিসাবে Provisional ডায়াগনোসিস করে এবং রোগীকে CCU তে পাঠায়। সিসিইউতে চিকিৎসা শুরু করা হয়। কিন্তু রোগীর Chest Examination এ Consolidation এর Findings পেলে urgent Chest X-ray করতে বলা হয়। কিন্তু রোগীর কন্ডিশন খারাপ। এক্স-রে করতে নেয়া যাচ্ছে না। কন্ডিশন একটু বেটার হলে এক্স-রে করানো হয়। ফ্লিম যখন হাতে আসে তখন রাত ১টা। এক্স-রে তে Bi-lateral consolidation involving mid & lower zone suggesting Atypical Pneumonia ......
X-Ray দেখে শুরুতেই একটাই চিন্তা COVID!! আর ইতিমধ্যেই
CCU র সব ডাক্তার -নার্স-স্টাফ এক্সপোজড!! যদি COV + ve হয় তবে সবারই সংক্রমণের শংকা!শুধু কি ডাক্তার নার্স.... আশে পাশের রোগীগুলোও ঝুঁকির মুখে। নিয়ম অনুযায়ী further evaluation , isolation & diagnosis confirmation এর জন্য করোনা নির্ধারিত হাসপাতালে patient transfer করে দিলেই বাচোয়া। কিন্ত বিবেক সায় দেয় না, পেশাগত commitment সায় দেয়না... এতো রাতে Transfer করলে পথে রোগীর যে কোন অঘটন হয়ে যেতে পারে, রোগীকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হবে। আর এই মাঝ রাতে রোগী কোথায় যাবে, কে ভর্তি নিবে~ সেই সাথে ভর্তি জটিলতায় চিকিৎসার অভাবে ডাঃ তাজকিয়ার মায়ের মৃত্যুর মতো আরেকটা মৃত্যু হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি.... তখন হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ নুরুল হক Nurul Haque ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি দুই রিং হতেই ফোন ধরলেন। উনার সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলাম সিসিইউ-র মধ্যেই রোগীর সর্বোচ্চ আইসোলেশন মেইনটেইন করে স্ক্রিন দিয়ে ঘিরে চিকিৎসা অব্যাহত রাখার। ইতিমধ্যে প্রায় ছয় ঘন্টা পেরিয়ে গেছে, রোগীও ট্রিটমেন্ট-এ কিছুটা রেসপন্স করছে,শ্বাসকষ্ট কিছুটা কমে আসছে। রেসপিরেটরি রেট, হার্ট রেট কমে আসছে, হাই ফ্লো অক্সিজেনে সেচুরেশন মেইনটেইন হচ্ছে.... তবু সারাক্ষণ শংকায় কাটাচ্ছি.. inadequate Protection নিয়ে duty করছে আমাদের ডাক্তার -নার্স-স্টাফরা। Duty তে ডাঃ Najimuddin Mohd Shaikat. ওর commitment আর সাহস সত্যিই প্রশংসনীয়। কোন দ্বিধা ছাড়াই COVID হতে পারে জেনেও রোগীর পাশে থেকে সারা রাত চিকিৎসা দিয়ে গেছে আর নার্স-অন্যান্য স্টাফরাও কাজটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে সব ঝুঁকি মাথায় সারা রাত নিরলস কাজ করেছে। আমার সিসিইউ টিম নিয়ে আমার সত্যিই গর্ব হচ্ছে। নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, এরাই হচ্ছে মহান চিকিৎসা পেশার প্রকৃত উত্তরাধিকারী।
সকালে রোগীর এক্স-রে,ECHO করালাম আর CBC,CRP, S Ferritin করতে পাঠালাম। এক্স-রে তে দেখলাম opacity আরো বেড়েছে আর ECHO-তে Normal LV function..So রোগী Cardiomyopathy না। আমাদের মেডিসিন এন্ড এলাইডের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডাঃ Sheikh Shaikh Mohammad Hasan Mamun ভাইকে Pt condition অবহিত করলে তিনি রোগীর সর্বোচ্চ চিকিৎসার নির্দেশনা দেন।
তখন সকাল ৯ঃ৩০...urgent COV test আর রোগীর ট্রান্সফার দরকার। BITID তে ফোন দিলাম BITID এর সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মামুন ভাইকে। ডাঃ মামুন ভাই Mamunur Mamun সবসময়ই খুব আন্তরিক ও helpful.. উনি জানালেন, আজ শুক্রবার, সাম্পল কালেকশন ১০.৩০-১১ টা হবেই আর ডাঃ শাকিল ভাইকেও ফোন দিলাম। এই শুক্রবারেও তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অনেক রোগীর রিপোর্ট করতে হবে। বুঝলাম আমাদের দ্রুত রিপোর্ট পাওয়া দুরহ, শনিবারের আগে নয়। এবং আরো বুঝলাম, Acute pateint ম্যানেজ করার মত facility BITID র নাই আর BITID তে শিফট করা ঠিক হবে না।
তখন সিভিল সার্জন " ডাঃ ফজলে রাব্বি Sk Fazle Rabbii ভাইকে ফোন দিলাম, তিনি রোগীর চিকিৎসা continue করতে এবং COV test করার পরামর্শ দেন। আমি সিসিইউতে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা কনটিনিউ করে রোগীর রাখার জটিলতার কথা বললে, উপায় না থাকলে জেনারেল হাসপাতালে Transfer এর পরামর্শ দেন।
তারপর জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডাঃ রবকে Abdur Rob Masoom ফোন দিলাম, তিনি কাল বিলম্ভ না করেই রোগী Transfer দিতে ও রোগী শিফট করতে বললেন। কিন্তু রোগীর তখন আবার saturation fall করতে থাকে, হার্ট ও শ্বাসের গতি বেড়ে যায়। রোগীর এই clinical condition এ যেকোন সময় ICU support লাগতে পারে। এ অবস্থায় রোগী শিফট করলে পথেই খারাপ হয়ে যেতে পারে আর transfer করলেও ICU সাপোর্ট আছে এমন হাসপাতালে শিফট করাই বাঞ্চনীয়। কিন্তু জেনারেল হাসপাতালে এখনো ICU সাপোর্ট নাই, পার্ক ভিউ হাসপাতাল সরাসরি পাঠাতে পারব না...জেনারেল হাসপাতাল হয়েই পার্ক ভিউ হাসপাতালে যেতে হবে আর পার্ক ভিউ ICU তে সরকারি সেট আপ এখনো প্লাস-মাইনাস । ফলে এটাও uncertain!!
আমাদের সামনে লজিষ্টিক সাপোর্টের অভাবে সীমাহীন অসহায়ত্ব!!
দরিদ্র গার্মেন্টস শ্রমিকেরা মুমূর্ষু বউ.. সদ্য জন্ম নেয়া ফুটফুটে এক শিশুর মা.. সেই শিশুর জীবনের শুরুতে মাতৃহারা হওয়ার ঘোর সম্ভাবনা!!
এতো চেষ্টার পর, অনিশ্চয়তা মাথায় রোগীকে Transfer করতে গিয়ে খারাপ কিছু হলে চিকিৎসক হিসাবে নিজের বিবেকের কাছে আজীবন দহনে পুড়তে হবে..তাই আপাতত শিফটের চিন্তা বাদ দিয়ে Pt ম্যানেজ করার জন্য ডাক্তারদের বলি।
সংকটময় এই মুহুর্তে বিভাগীয় পরিচালক ডা শাহরিয়ার Hasan Shahriar Kabir ভাইকে ফোন করি। আমাদের বিএমএ'র কোষাধ্যক্ষ ও হাসপাতালের Joint Secretary ডাঃ আরিফ ভাই Arif Ameenও বিভাগীয় পরিচালককে ফোন করে সামগ্রিক সুবিধা-অসুবিধা জানিয়ে সহযোগিতা চান। তিনি সব শুনে, আমাদের সিসিইউ'র Treatment ও সকল ঝুঁকি উপেক্ষা করে দ্বায়িত্বপুর্ন সেবায় ভুয়সী সন্তোষ প্রকাশ করেন। রোগীর জীবন রক্ষায় ও চিকিৎসক -স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তায় সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন... বলতে দ্বিধা না যে, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) এর আন্তরিক বক্তব্য ঐসময় আমার সিসিইউ টিমের জন্য ছিল অনেক বড় অনুপ্রেরণা হয়ে দাড়ায়। তিনি তৎক্ষনাৎ COV test এর ব্যবস্থা করেন এবং দ্রুততম সময়ে রিপোর্ট প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন । sample collection এর পর ডাঃ শাকিল ভাই আমাকে দ্রুততম সময়ে রিপোর্ট দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। আর হাসপাতাল পরিচালক ডাঃ Nurul Hoque ভাইকে নতুন করে দেখলাম...তিনি প্রকৃত অর্থেই একজন মানবিক মানুষ!

ডাক্তার -নার্স-স্টাফরা সম্ভাব্য কোভিড রোগীর সংস্পর্শে আসায় তাদের ওয়ার্ড থেকে বের হতে নিষেধ করি এবং রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত ডিউটি চালিয়ে যেতে বলি। এখানে গর্বের সাথে বলতে পারি, সংক্রমণের আশংকা থাকা সত্বেও আমাদের সিসিইউ ডাক্তার -নার্স-স্টাফরা বিনা দ্বিধায় হাসি মুখে দ্বায়িত্ব পালনের স্বেচ্ছায় নিবেদিত ছিলেন। তাদের সাহস ও সেবা করার মানসিকতার প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

সম্ভাব্য বিপদ বিবেচনায়, ডেপুটি ডিরেক্টর ডাঃ আশরাফ Ashraful Karim ভাইকে ডাক্তার -নার্স-স্টাফদদের জন্য কোয়ারান্টাইনের জন্য ব্যবস্থা করতে বলি। ডাঃ আশরাফ ভাই সাথে সাথেই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নেন এবং কিছুক্ষণ পর জানান,কোয়ারান্টাইন এর জন্য ৫টি কেবিন প্রস্তুত রেখেছেন।
সন্ধ্যা ৬:৩০মি আমরা রিপোর্ট পাই।রোগীর COV test নেগেটিভ। এটা একটা Atypical Pneumonia..অনাকাঙ্ক্ষিত সংক্রমণের শংকা মুহুর্তে শেষ হয়ে যায়। রোগীকে Easily নির্দ্বিধায় হাসপাতালের ICU তে Shift করি। ICU তে এখন বিনা শংকায় রোগী র চিকিৎসা চলছে। আল্লাহ সহায় হলে রোগী বেচে যাবেন। ফুটফুটে নবজাতক একদিন মায়ের কোলে হাসতে পারবে। সেই মা ও ছোট শিশুর মুখের হাসির চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছুই হতে পারেনা। সবাই দোয়া করবেন, এই মা-শিশুর হাসিমাখা চোখের ভেলায় কিছুটা সময় যেন ভাসতে পারি।

#এতো_কিছুর_মাঝেও_মজার_একটা_অবজারভেশন_আছে!!
আমাদের মাঝে সারাক্ষণ অন্যান্য রোগীর মাঝে সংক্রমনের শংকা ছিলোই তাই সাসপেক্টেড করোনার চিকিৎসা চলছে এটা গোপন রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু থেকেই ছিল।
কিন্তু অন্যান্য রোগী ও রোগীর স্বজনরা কোথা থেকে জেনে গেছে বা বুঝে গেছে একজন সাসপেক্টেড রোগী ওয়ার্ডে আছে!! এতে তারাও খুবই আতংকিত হয়ে পড়ে শুধু তাই নয় তারা কোনো করোনা রোগী সাথে থাকবেনা,করোনা রোগী দ্রত সরাতেই হবে, করোনা হার্টের ওয়ার্ডে থাকতে পারবেনা। এটা মরণ ব্যাধি। তারা এই মরন ব্যধির ছোয়ায় মরতে চায় না ! তারা রোগীকে নিয়ে বাইরে চলে যেতো কিন্তু করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসায় অন্য সিসিইউ ভর্তি নিবে না তাই যেতেও পারছেনা। অসংখ্য অভিযোগের আংগুল যথারীতি আছেই~ডাক্তারদের কোন বিবেচনা নাই, কান্ড জ্ঞান নাই, মানবিকতা নাই, দ্বায়িত্ব বোধ নাই ইত্যাদি ইত্যাদি।।।।
আর অন্যদিকে
মুমূর্ষু রোগীর স্বজনরাও চিকিৎসা চায়, রোগীকে বাচাতে চায় কিন্তু তারাও কেউ মরতে চায়না, তারা রোগীর সাথে দেখা করতে চায়না, নিজ হাতে রোগীকে খাওয়াতে চায় না, ওষুধ ও খাওয়াতে চাই না কিন্তু রোগীর চিকিৎসা চাই, সুস্থতা চাই, ক্ষুদার্ত দেখতে চাই না। এটা ডাক্তার -নার্স -স্টাফদের দ্বায়িত্ব ।
একদিকে মুমূর্ষু রোগী ও তার স্বজনরা আর অন্য দিকে অন্যান্য রোগী ও তাদের স্বজনরা।
আর..... রোগীদের স্বজনদের হট্রগোল পুরো সময় জুড়েই ছিল।
সবাই বাচতে চায় কিন্তু দায়িত্ব বা ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না!!
আমরা স্বাস্থ্যকর্মীরা ভয়াবহ সংকটে...
______________________

ডাঃ এস এম মুইজ্জুল আকবর চৌধুরী
সহকারী অধ্যাপক, হৃদ রোগ বিভাগ ইন-চার্জ,করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ)
চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজ

সাংগঠনিক সম্পাদক, বিএমএ চট্টগ্রাম।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়