Ameen Qudir
Published:2020-03-15 15:11:51 BdST
একজন মানসিক রোগীর ‘মানুষ’ হয়ে ওঠা'র কাহিনি বলছেন শীর্ষ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
লেখকের ছবি
অধ্যাপক ডা. ঝুনু শামসুন নাহার
বাংলাদেশের প্রথিতযশ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
__________________________
নাম তার মিলা (আসল নাম নয়)। বর্তমানে বয়স ৪৩। ঊনিশ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়ীর লোকেরা পাগল বলে খেদিয়ে দিয়েছে। স্বামীর খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। পাগল হওয়া সত্ত্বেও মিলাকে সে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সে ছিল তার বাবার ওপর আর্থিকভাবে অনেকটা নির্ভরশীল। অতএব পরিবারের সবার মত মেনে নিয়েছে। আবার বিয়েও করেছে। হয়তো সুখীও হয়েছে। মিলা কিন্তু আজো মনে মনে ভাবে নারী বলেই কি শ্বশুরবাড়ী থেকে তাকে পাগল হয়ে বিতাড়িত হতে হয়েছিল! তার স্বামী যদি মানসিক রোগী হতো তাহলে কি মিলা এত সহজে তাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করতে পারতো! সমাজ সংসার কি তখন তার ওপরে চাপ দিত না! তারা কি বলত না মেনে নাও ভাগ্যকে। বিয়ে একবারই হয়। মেয়েদের ধৈর্য্য সহ্য থাকা চাই।
মিলা ছোট বেলা থেকেই চুপচাপ। শান্তশিষ্ট। বন্ধু-বান্ধব বেশী ছিল না। একা একা থাকতেই বেশী পছন্দ করতো। তার ব্যক্তিক্ত্বের ধরন ছিল স্কিজয়েড (Schizoid Persnality)। মিলা পড়াশোনায় ভালো ছিল। বেশ ভালো বলা চলে। স্কুলের পরীক্ষায় ভালো ফল করে কলেজে ভর্তি হলো। তখন থেকেই কেমন কেমন শুরু হলো। মনে হতে লাগলো সবাই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এমনকি তার মাও বুঝি তার শত্রু, খাবারে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। নানা রকম গায়েবী কথা শুনতে লাগলো; কারা যেন তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আজেবাজে কথা বলে। মিলার মনে হতে লাগলো তারাই বুঝি তাকে নিয়ন্ত্রন করছে; তার কাজ-চিন্তা-ভাবনা সবই তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মিলা যেন একটা মেশিন।
এ রকম অবস্হায় মিলার পড়ার মান খারাপ হতে থাকলো। পাড়াগাঁয়ে বাস তাদের । প্রতিবেশীরা বলতে শুরু করলো জ্বীনের আছর হয়েছে। ওঝা দেখানো হলো। কবরেজ দেখানো হলো। হুজুরের পানিপড়া খেল। গলায় মাথায় চুলে তাবিজ বেঁধে দেয়া হলো। ওঝার জ্বীন তাড়ানোর কথা মনে হলে তো এখনো মিলা শিউরে ওঠে। আগুন জ্বালিয়ে তার সামনে মিলাকে বসানো হলো। কিমভুতকিমাকার সাজে ওঝা একটা চকচকে বেত নিয়ে এল। মিলাকে সে যে কি পেটানো পেটালেন ওঝা মশাই। মিলা তারস্বরে চীৎকার করে কাঁদতে লাগলো। হাউ হাউ করে কাঁদলো। ওর বাবা মা ভাই বোন সবাই সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে জ্বীন তাড়ানো দেখলো । কিন্তু মিলার কষ্টটা কেউ দেখলো না। তথাকথিত জ্বীন তাড়ানো হলো; অসুখ কিন্তু ভালো হলো না। তখন একজন ডাক্তারের কাছে মিলাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এক মাস ওষুধ খাওয়ানোর পরে রোগের একটু উন্নতি হলো। ডাক্তার রোগের নাম বললেন স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia)। এও বলে দিলেন যে ওষুধ অনেকদিন ধরে চালাতে হবে।
মিলা দেখতে ভালোই ছিল। সবাই সুন্দরীই বলতো। পিতা-মাতা-আত্মীয়-স্বজনের ধারনা বিয়ে হলে অসুখ পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে। অতএব অসুখ একটু ভালো হওয়াতেই মিলাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। পাত্র তেমন প্রতিষ্ঠিত না। বাবার সাথে ছোটখাট ব্যবসায় যুক্ত। তাতে কি? মেয়ে আইবুড়ো থাকার চেয়ে বিয়ে হলে বরং ভালো। বলা ভালো মিলা কিন্তু গ্রামের মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে।
বিয়ের পরে ডাক্তার দেখানো বন্ধ। ওষুধ খাওয়া বন্ধ। মিলার অসুখ আবার বাড়লো। অস্বাভাবিক আচরন শুরু হলো আবার। শ্বশুর বাড়ীর লোকেরা এই ‘পাগল’ বউকে তাড়াতে তৎপর হলো এবং তাকে বাবার বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। স্বামীর বাড়ীতে মিলার আর যাওয়া হলো না।
ঊনিশ-কুড়ি বছর বয়স তখন মিলার। নব প্রেমের কুড়ি সবে ফুটতে শুরু করেছে। খুব কষ্ট হতো স্বামীর কথা ভেবে। কিন্তু কাকে বলবে মুখ ফুটে? সে যে পাগল! কে শুনবে তার কথা? মিলার মা ও বড় ভাই হয়তো বুঝেছিলেন ব্যাপারটা। তারা আবার ডাক্তার দেখালেন, নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার ব্যবস্হা করলেন। তারা সেই সাথে মিলাকে পড়াশোনায় ফিরে যাওয়ার জন্যও উৎসাহ দিলেন। মিলা নিয়মিত ওষুধ খেতে লাগলো। মাঝে মাঝে ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও রোগের বাড়াবাড়ি হতো। এত কিছুর মধ্যেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজের পরীক্ষা পাশ করলো। ততদিনে ওর বড় ভাই ঢাকায় একটা ভালো চাকরী পেয়েছে এবং মিলাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে। মিলার রোগের অবস্হা একটা পর্যায়ে এসে যেন থেমে থাকলো। খুব খারাপও না আবার খুব ভালোও না। ওকে দেখলে একটু অস্বাভাবিক লাগে। ভাই তখন ঢাকায় আরেকজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে মিলাকে নিয়ে গেলেন।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওষুধ বদলে দিলেন। ক্লোজাপিন (Clozapine) নামক ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করালেন। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষাও করতে হতো। মিলার চেহারা ধীরে ধীরে একজন স্বাভাবিক মানুষের মতো হয়ে এলো। কাজকর্ম ও পড়াশোনাতেও সে আরো মনোযোগী হলো। মিলা প্রাইভেট ভাবে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করলো। ভাই ভাবীর উৎসাহে এমএ-ও পাশ করলো ইতিহাসে। আপাততঃ সে একটা এনজিও-তে কাজ করছে একজিকিউটিভ হিসেবে। বেতন মোটামুটি ভালোই। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এখনও ওষুধ চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ভাই ভাবীর আশ্রয় ছেড়ে স্বাধীন ভাবে কর্মজীবি মহিলা হোস্টেলে আছে। তবে আত্মীয় স্বজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে।
স্বামী সংসার মিলার হয়নি। দুঃখতো একটু হয়ই। তবে সে তার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে দুঃখী মানুষের সেবা করার চেষ্টা করে। প্রায়ই গ্রামে-গন্জে যায় এনজিওর কাজে এবং সেখানে গিয়ে মানসিক রোগ সম্পর্কে ভুল ধারনা ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করে নিজের ঊদ্যোগেই। মানসিক রোগের বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা কোথায় পাওয়া যায় সে সম্পর্কেও খবরাখবর দেয়। মিলা এখন ভালোই আছে। শান্তিতে আছে বলা যায়। মানসিক রোগী হয়েও ‘পাগল’ বা ‘জ্বিন-ভুতের আছর’ এই তকমা আজ আর মিলার গায়ে লেগে নেই।
আপনার মতামত দিন: