Ameen Qudir

Published:
2020-02-22 05:55:32 BdST

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি


দেবব্রত তরফদার

প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক
___________

আমার ছাত্র সুব্রত দে শান্তিপুরের ছেলে , সে আমার খুব কাছের মানুষ। তার অনুরোধ ছিল এই দিনটিকে নিয়ে কিছু লেখার ।আমি এদেশের বাংলাভাষী । ভাষাদিবসের প্রাককালে আমার মনোভাব সবার সঙ্গে শেয়ার করছি।
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জনগনের কাছে একাধারে মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন। বঙ্গীয় সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্মঅন্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরে ভাষা বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে । ঐদিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে আব্দুল জব্বার , আবদুস সালাম , আবুল বরকত , রফিকউদ্দিন আহমদ এই ছত্রযুবারা শহীদ হন ।প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজে সমবেত হন। নানা নির্যাতন সহ পরদিন সবাই রাজপথে নেমে আসেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার মধ্যে দিয়ে ভাষা আন্দোলন অনেক জোরদার হয় , ফলস্বরূপ ১৯৫৪ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল তা আজ আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি লাভ করেছে ।১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয় । ২০১০ সালের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫ তম অধিবেশনে এই সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাশ হয় । বাঙালির এই দিনটি হয়ে যায় সমগ্র পৃথিবীর ।
আব্দুল জব্বার , আবদুস সালাম ,আবুল বরকত , রফিকউদ্দিন আহমেদ , ভাষারক্ষায় এদের আত্মদান ও আত্মহুতির মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ নিহিত ছিল ।বাঙালির জাতীয় চেতনার উদ্ভবের ফলে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন।
এই অংশটুকু লেখার উদ্দেশ্য হল আমাদের এদেশের বাঙালিদের এক বিরাট অংশের এ সম্পর্কে কোন ধারণা নেই ।অথচ বহুক্ষত্রেই ঘটা করে পালিত হয় ভাষাদিবস । আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি -- গানে ভরে যায় আকাশ বাতাস । আবার হয়তো উপর মহল থেকে নির্দেশ ( আদেশ ) আসলো বাধ্যতামূলক ভাবে পালন করতে হবে ভাষাদিবস ।আর উৎসব শুরু হয়ে গেল যত্রতত্র । এবং মনুষ্য রূপী রোবটের নাচ গানে মুখরিত হবে চারদিক।
বাংলা ভাষায় কথা বলে ছাব্বিশ কোটি । এপারের সাড়ে নয় ওপারের সাড়ে ষোল। রাজনীতির কারণে দেশভাগ তারপর বাংলাভাষী রা এক হতে পারিনি কোন দিক থেকেই । একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য বাংলাভাষী হিসাবে গর্ব হয় কিন্তু এর অংশীদার তো নই । কি করেছি মাতৃভাষার জন্য ।ওপারে বাংলা ভাষা সাংবিধানিক যোগ্যতা অর্জন করেছে আর এপারে লাভ করেছে । আমাদের রবীন্দ্রনাথ , আমাদের জীবনানন্দ , আমাদের নজরুল করে ছবি টাঙিয়ে উৎসব পালন করি কিন্তু বর্তমান যুবসমাজ এঁদের লেখা থেকে যোজন মাইল দূরে। বাংলাদেশের যত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে । তারা প্রত্যেকেই দু একটি কবিতা পুরো বলতে পারে , গানও। কিন্তু এখন এদেশের ছাত্রসমাজের এক বিরাট অংশের তা নেই ।উচ্চশিক্ষার হারের বিচারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতে প্রথম।এম এ র ছড়াছড়ি । বাংলা ভাষা সাহিত্যের ছাত্রদের কি পড়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যাবে -- বেঙ্গলি অনার্স । সিলেবাসের পড়া নোট নির্ভর তার বাইরে কিছুই নেই। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্ররা যেহেতু বিদেশি সাহিত্য পড়ে তাই তাদের বাংলা সাহিত্য পড়ার দরকার নেই। অন্য বিষয় পড়া ছাত্রদের কথা না বলায় ভালো। এক সময় পাঠক হিসাবে বাঙালির গর্ব ছিল এখন পাঠকের অভাবে বহু লাইব্রেরির অস্তিত্ব নেই বা ধুঁকছে।সরকারের কল্যাণে শহর নগর গ্রাম গঞ্জে বইমেলার কমতি নেই , কিন্তু এ মেলা বিনোদনের বই বিক্রি নামমাত্রই । বাংলা সাহিত্য আর এগোবে না , কে লিখবে , কার জন্য ? রুটি রুজির জন্য ইংরেজি অবশ্যই দরকার । তাই বলে নিজের ভাষা ।
মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা বন্ধু বা ছাত্রদের মুখে শুনেছি । দুজন অচেনা বরিশাল , চট্টগ্রাম , খুলনা বা সিলেটি নিজেদের পরিচয় পাবার পর মাতৃভাষা তেই কথা শুরু করে দেয় । শুধু এরা নয় দুজন তামিল মালয়ালি পাঞ্জাবী গুজরাটি মারাঠি জার্মান জাপানি রাশিয়ান সবার ক্ষেত্র প্রযোজ্য শুধু এদেশীয় বাঙালি বাদে ।তৃতীয় কোন পক্ষ না থাকলেও তারা কথা বলে ইংরেজিতে। বাঙালি বন্ধুদের কোন গ্রুপে বাংলায় লেখালিখি চলছে তার মধ্যে কেউ লিখল ইংরেজিতে ।মানে আমি কত জানি দেখো । কদিন আগে মেয়ের বাজনার একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলাম । এক বন্ধু ইংরেজিতে তার মতামত লিখে দিল ।হয়তো তার কথার ওজন বাড়বে । কে জানে ।বাংলা এদেশের গ্রাম গঞ্জ আর মফস্বলের ভাষা।
ইংরেজ আমলে ইংরেজি জানা ভারতীয়দের কদর ছিল । আয় পয় ক্ষমতা বেশি ছিল তাই অনেকে আত্মশ্লাঘা অনুভব করতেন ।এটাই বাঙালি জিনে ঢুকে গেছে। বাংলা ভাষা এদেশে সাংবিধানিক মর্যাদা পেয়েছে আর বাংলার সাংসদ দীপক অধিকারী সাংসদ অধিবেশনে তার বক্তব্য বাংলায় বলার জন্য হয়ে গেলেন হাসির পাত্র । আর আমরা বাঙালিরা গলার শির ফুলিয়ে চেঁচালাম -- এ ব্যাটা ইংরেজি জানে না । যদিও এই ধারণা ভুল ।কি নির্লজ্জ্ব আমরা।
আমাদের বাঙালির মধ্যে হিরোর সংখ্যা কম ।যাদের নিয়ে গর্ব করি ।শেষ হিরো বোধহয় সৌরভ গাঙ্গুলি । একবার বাংলাদেশে এশিয়া কাপে ভারত চ্যাম্পিয়ান হয় । ক্যাপ্টেন হিসাবে বক্তব্য রাখতে আসেন সৌরভ । সারা মাঠ উত্তাল ।অনুরোধ আসে দর্শকদের কাছ থেকে বাংলায় কিছু বলার জন্য । না একটা বাংলা শব্দ বেরোয়নি ওনার মুখ থেকে । এরা আমাদের হিরো । পথপ্রদর্শক। তাই ভাষাদিবসের প্রাককালে বাঙালি হিসাবে লজ্জাবোধ করছি।লজ্জা লজ্জা।
( যাঁরা একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন এবং যুক্ত ছিলেন তাঁদের হাজারো প্রণাম ।)

দেবব্রত তরফদার

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়