Ameen Qudir

Published:
2020-02-08 00:40:07 BdST

এক ডাক্তারের আত্মত্যাগ: করোনা সম্পর্কে সর্বপ্রথম জানিয়ে পদে পদে লাঞ্ছিত হন যিনি


 
ডা. সাঈদ এনাম
__________________

ডা. লি ওয়েনলিয়াং। এখন বিশ্ব ডাক্তার সমাজের মহান গৌরবের নাম। তার অকুতোভয় সেবার কাজের কাছে সারা বিশ্ব আজ শ্রদ্ধায় অবনত। তিনিই সর্বপ্রথম করোনা ভাইরাস সম্পর্কে চীনা কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেন। কিন্তু তাকে পাত্তা দেয়া হয় নি। বরং পদে পদে নিগৃহীত হতে হয়। পরে তার কাছে ক্ষমাও চায় দম্ভধারী কর্তৃপক্ষ। কাহিনির সেখানেই শেষ নয়।
এক পর্যায়ে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ডা.লি ওয়েনলিয়াং করোনাভাইরাস এ আক্রান্ত হন। পরে হাজারো রোগীর জীবন বাঁচিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে নিজেই মহাপ্রয়াণে যান। এই মহান চিকিৎসকের জন্য শ্রদ্ধা।
এবার পাঠ করি, কি হয়েছিল তার সঙ্গে তার পূর্ণ বিবরণ।


প্রথমে উহান সিটি কর্তৃপক্ষ ভয়াবহ করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি খুব একটা আমলে নেয়নি! এমন কি ব্যাপারটা গোপন রাখতে চেয়েছিল। এ নিয়ে পূর্ব সতর্কতা জানানো চিকিৎসক ডা.লি ওয়েনলিয়াং নামের একজন অপথালমোলজিস্টকে (চক্ষু বিশেষজ্ঞ) পুলিশ চুপ থাকতে বলে। তার অপরাধ ছিলো, তিনি সবাইকে নতুন এই ভাইরাসটির সংক্রমণের ব্যাপারে এসএমএস ও ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সচেতন ও সতর্ক করছিলেন।

ডিসেম্বরে ডা. লি ওয়েনলিয়াং খেয়াল করলেন নতুন আক্রান্ত কিছু রোগী প্রায় একই রকম উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসছে। তার কাছে বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক ঠেকেনি। তিনি এ ব্যাপারে সচেতন ও সতর্ক থাকতে বললে পুলিশ তাকে অযথা 'গুজব ছড়ানোর' অভিযোগে থানায় ডেকে পাঠায়। তার কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়। এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবারও হুঁশিয়ারি করে।

ডা. লি. এর সঙ্গে এসব ঘটে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে, যখন সবে মাত্র কয়েকজন রোগী করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসা শুরু করেছেন।

ডা. লি কাজ করতেন উহান সিটির একটি হাসপাতালে। যে সকল নতুন রোগী জ্বর সর্দি কাশি নিয়ে একের পর এক ভর্তি হচ্ছেন তাদের উপসর্গগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল ছিলো। এটি ছিল ২০০৩ সালের মহামারী আকারে রূপ নেয়া সার্স (সেভেয়ার এক্যুইট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) রোগের মতো। ডা. লি খেয়াল করলেন আক্রান্ত রোগীদের সকলেই উহান সিটির হোয়ানান বাজারের আশপাশের যেখানে সাপ, বাদুর, শিয়াল ও কুকুর ইত্যাদি হিংস্র প্রাণীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খবারের জন্যে বিক্রি হয়।

সচেতন ডা. লি. এর সন্দেহ হলে তিনি সহকর্মীদের গোপনে সতর্ক করতে থাকলেন এবং সকল চিকিৎসককে প্রোটেকটিভ ব্যবস্থা নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করার পরামর্শ দিতে থাকলেন।

ডা. লি এর সতর্কতাকে পুলিশ গুজব ধরে নেয়। তার বিরুদ্ধে তারা চরম বিমাতা সুলভ আচরণ করে, শাসায়; তাচ্ছিল্য ও অপমান করে।

পুলিশের ভাষা ছিলো এ রকম

'আমরা তোমাকে আবারো সতর্ক করছি ডা. লি ওয়েনলিয়াং। যদি তুমি তোমার 'গোয়ার্তুমি' বন্ধ না করো, 'ভ্রান্ত তথ্য' আর 'গুজব' ছড়াতে থাকো তাহলে তোমাকে আমরা আদালতের তুলবো'। তারা মুচলেকা দিতে বলে।

ডা. লি. তাদের সাথে না পেরে মুচলেকা দিতে বাধ্য হন। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তিনি পুরো ঘটনা, কি হতে যাচ্ছে এবং তার সাথে কি কি আচরণ করা হয়েছে এ নিয়ে তাদের জনপ্রিয় সোশ্যাল মাধ্যম 'ওয়েবোতে’ পোস্ট করেন। শুধু তাই নয় দুঃখে তিনি তার ওয়ালে একটি ব্যাঙাত্মক কুকুরের কার্টুনও আপলোড করেন। কুকুরটির বড় বড় চোখ। সেগুলো উল্টানো আর তার লক লকে বড় জিহ্বাটা বেরিয়ে আসছে।

মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়। তোরজোড় পড়ে যায় এ নিয়ে। হাজার হাজার লাইক কমেন্টস পড়ে। অনেকে দুঃখ করে কমেন্ট করেন, 'একজন সচেতন চিকিৎসকের সঙ্গে এমন মূর্খ আচরণ করলে সাধারণ জনগণ বা রোগী বাঁচবে কি করে'।

এর পরই কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে।

পরের কাহিনী ইতিহাস। ডা. লিকে 'হিরো' আখ্যা দেওয়া হয়। তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এবং কর্তৃপক্ষ তাদের অজ্ঞতা আর গর্হিত আচরণের জন্যে বারবার নিঃশর্ত ক্ষমা চান।

কিন্তু ততক্ষণে বড্ড দেরি হয়ে যায়। নতুন করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এক মাস সময় ভাইরাসের জন্যে অনেক সময়। এরই মধ্যে করোনাভাইরাস উহান শহর, উবেই প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়ে চীন ও চীনের বাহিরে।

ডা. লি. যখন সতর্ক করেন তখন বিষয়টি আমলে নিলে পরিস্থিতি হয়তো এতো খারাপ হতো না। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা অসচেতনতা আর মূর্খতার জন্যে হাজার হাজার চীনা নাগরিক আজ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। মারা যাচ্ছেন শত শত। সারা বিশ্বে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে চীন থেকে, যা এখনও চলমান। চীনের বাহিরে ফিলিপাইনেও গেল দুদিন আগে মারা গেছেন এক রোগী।

ডা. লির প্রতি বিমাতা সুলভ আচরণের জন্যে চীন তার প্রায়শ্চিত্ত করছে। বিশ্ব থেকে 'পরাশক্তি চীন' এখন কার্যত আলাদা। যেনো এক মৃত্যুপূরী। বিদেশের কোনো নাগরিক যেমন চীনে যেতে পারছেন না, তেমনি চীন থেকে কোনো নাগরিক আসতে পারছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। চীন কার্যত অচল। বিশ্বের বহু দেশ চীনের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ রেখেছে।

ডা. লি একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ সার্জন। তিনি ভাইরোলজিস্ট, এপিডেমিওলজিস্ট ছিলেন না। ফলে তার অতশত ভাববার দরকার ছিল না। তার কাজ ছিল চোখের রোগীর চিকিৎসা করা। কিন্তু সবার আগে তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক সচেতন নাগরিক। তিন যা করেছেন তা দেশের মানুষের জন্যে করতে চেয়েছেন।

ডা. সাঈদ এনাম

ডিএমসি, কে-৫২

সাইকিয়াট্রিস্ট
সহকারী অধ্যাপক
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়