Ameen Qudir
Published:2020-02-07 23:52:18 BdST
করোনাভাইরাস থেকে বিশ্ববাসীকে রক্ষাকারী ডাক্তারের মহান আত্মত্যাগ: মহান মৃত্যু
ডেস্ক
______________
করোনাভাইরাসের বিষয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ককারী সেই চীনা ডাক্তার মারা গেছেন। করোনাভাইরাসের রোগীদের জীবন বাঁচাতে তিনি চীনে হাসপাতালে নিয়োজিত ছিলেন। অক্লান্ত পরিশ্রম, অনন্য সেবার কাজের ধকলে নিজেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। মানবতার মহান পথে অবশেষে তার মহাপ্রয়াণ। চিকিৎসকের এই তো জীবন।
তার মহাপ্রয়াণ নিয়ে ধুম্রজাল থাকলেই বিবিসি তা নিশ্চিত করেছে।
লি ওয়েনলিয়াং নামে ওই চিকিৎসক উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালে কাজ করার সময় ভাইরাসে আক্রান্ত হন।
মারাত্মক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে যে চীনা চিকিৎসক সর্বপ্রথম সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গিয়েছেন।
বিবিসি জানায়, তিনি যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, সেখান থেকে এই খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
লি ওয়েনলিয়াং নামে ওই চিকিৎসক উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালে কাজ করার সময় ভাইরাসে আক্রান্ত হন।
তিনি ৩০শে ডিসেম্বর সহকর্মীদের কাছে একটি সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তবে পুলিশ তাকে "মিথ্যা মন্তব্য করা" বন্ধ করতে বলে।
তার মৃত্যুর বিষয়ে পরস্পরবিরোধী সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু পিপলস ডেইলি এখন জানিয়েছে যে শুক্রবার তিনটার দিকে তিনি মারা যান।
জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চীনের মূল ভূখণ্ডে ভাইরাসটির প্রকোপে এখন পর্যন্ত ৬৩৬জনের মৃত্যু হয়েছে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে মোট ৩১ হাজার ১৬১জন।
বৃহস্পতিবারই ৭৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে শ্বাসযন্ত্রে তীব্র সংক্রমণ দেখা দেয় এবং এর লক্ষণগুলো সাধারণত জ্বর দিয়ে শুরু হয় এবং এর পরে হয় শুকনো কাশি।
সংক্রামিত বেশিরভাগ মানুষই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন - ঠিক যেমন তারা ফ্লু বা জ্বর থেকে সেরে ওঠেন।
কীভাবে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল?
গ্লোবাল টাইমস, পিপলস ডেইলি এবং অন্যান্য চীনা গণমাধ্যম বৃহস্পতিবার ডা. লি-এর মৃত্যুর খবর জানিয়েছিল।
৩৪ বছর বয়সী ডা. লিকে, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ প্রাথমিকভাবে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল এবং এই খবরটি চীনা সামাজিক মাধ্যম ওয়েইবোতে ঝড় তুলে দেয়। ওয়েইবো অনেকটা টুইটারের মতো। এই খবরে সেখানে প্রচুর মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানায়।
পিপলস ডেইলি একটি টুইট করে করে জানিয়েছে যে ডা. লি এর মৃত্যু "জাতীয় শোক" ছড়িয়ে দিয়েছে।
তবে গ্লোবাল টাইমস তখনও বলেছিল যে ড. লি'কে 'ইসিএমও (এক্সট্রা-কর্পোরাল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন)' নামে পরিচিত একটি চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
যার মাধ্যমে একজন রোগীর হার্টকে পাম্প করে সচল রাখা হয় এবং রক্তে অক্সিজেনের পরিবহন বজায় রাখা হয় যেন তা ফুসফুসের মধ্যে চলে না যায়।
গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছিল যে তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
করোনাভাইরাস নিরাপত্তায় যে সতর্কতা প্রয়োজন
ঘটনাস্থলে থাকা সাংবাদিক এবং চিকিৎসকরা, যারা তাদের নাম ব্যবহার করতে চান না, তারা বিবিসি এবং অন্যান্য মিডিয়াকে বলেছেন যে সরকারী কর্মকর্তারা হস্তক্ষেপ করেছেন।
সরকারী সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলা হয়েছে যেন তারা তাদের প্রতিবেদন পরিবর্তন করে এবং জানায় যে, ডা. লিকে এখনও চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
পরে সংবাদমাধ্যমগুলো ডা. লি'র মৃত্যুর নতুন সময়টি জানায়:
চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, করোনাভাইরাস দ্বারা নিহতদের বেশিরভাগের বয়স ৬০ বছরের উপরে। যারা অন্যান্য সমস্যায় ভুগছিলেন।
লি ওয়েনলিয়াং এর গল্প
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. লি করোনাভাইরাস নিয়ে তার প্রাথমিক সতর্কবার্তা পাঠানোর এক মাস পরে তিনি হাসপাতালের বিছানা থেকে ওয়েইবোতে তাঁর গল্প পোস্ট করেন।
তিনি ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সাতটি ঘটনা লক্ষ্য করে দেখতে পান যে সেটি অনেকটা সার্সের মতো - যে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ২০০৩ সালে বিশ্বব্যাপী মহামারী তৈরি হয়েছিল।
৩০শে ডিসেম্বর তিনি একটি চ্যাট গ্রুপে তার সহকর্মী ডাক্তারদের একটি সতর্ক বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি সবাইকে সংক্রমণ এড়াতে প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরার কথা বলেন।
চার দিন পরে তাকে জননিরাপত্তা ব্যুরোতে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে একটি চিঠিতে স্বাক্ষর করতে বলা হয়েছিল। ওই চিঠিতে তাঁর বিরুদ্ধে "মিথ্যা মন্তব্য করার" অভিযোগ করা হয় যা "সামাজিক শৃঙ্খলাকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করেছে"।
তিনি ওই আটজনের মধ্যে একজন ছিলেন যাদের বিরুদ্ধে পুলিশ "গুজব ছড়িয়ে দেওয়ার" অভিযোগে তদন্ত করেছিল।
পরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ডা. লি'র কাছে ক্ষমা চান।
ডা. লি তার ওই ওয়েইবো পোস্টে ব্যাখ্যা করেন যে ১০ই জানুয়ারি তিনি কীভাবে কাশি শুরু করেন, পরের দিন তার জ্বর হয় এবং দুদিন পরে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ৩০শে জানুয়ারী তার শরীরে সনাক্ত হয় করোনাভাইরাস।
চীনে সবাইকে সতর্ক হয়ে চলতে মাস্ক পরার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
চীনে ভাইরাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি
চীন এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আরও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
বেইজিংয়ে জন্মদিন এবং বিবাহের মতো অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের একসাথে খাওয়া দাওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
হ্যাংঝৌ এবং নানচাং-এর মতো শহরগুলোয় যেসব পরিবার থাকেন, প্রতিদিন এসব পরিবারের কতজন সদস্য বাড়ি থেকে বেরোতে পারবেন তা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
হুবেই প্রদেশের বাসিন্দাদের বাইরে দিকে যেতে নিরুৎসাহিত করার জন্য উঁচু উঁচু ভবনগুলো লিফট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
শহরটির এক প্রবীণ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উহানের বিছানা ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে। দুটি হাসপাতাল দ্রুত নির্মাণ করা সত্ত্বেও, রোগীদের ভলিউম মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে উহান সরকার বাসিন্দাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করবে।
চংকিংয়ের জন্য বরাদ্দ একটি মাস্কের চালান ইউনান প্রদেশের ডালি শহর সংগ্রহ করেছে বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
ডালির সরকার বলছে যে বাক্সগুলি ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়ে গেছে, তাদের এখন কিছুই করার নেই।
কিংদাও এবং শেনইয়াং শহরও এই মেডিকেল চালান নিয়ে এক অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে বলে জানা গেছে।
ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনাও কম হচ্ছে না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে চীন "হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে জন স্বাস্থ্য সুরক্ষার চেষ্টা করছে"।
এদিকে, হংকংয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার বাজারে মানুষ আতঙ্ক চোখে পড়ে। টয়লেট রোলসহ মাস্কের মতো পণ্য ক্রয়ে বিশাল লাইন দেখা যায়।
সংক্রমণের সর্বশেষ পরিস্থিতি কী?
এই ভাইরাসটি চীনের বাইরে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রায় ২৫টি দেশে এই ভাইরাস সংক্রমণের খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখনও পর্যন্ত চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে মাত্র দুজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে - একটি হংকং এবং একটি ফিলিপিন্সে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছে, প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় যদি এখনই তহবিল বরাদ্দ করা না হয় তাহলে পরে আক্রান্ত দেশগুলোকে এর চরম মূল্য দিতে হবে।
করোনাভাইরাস: এটি শরীরে কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে
চীনের সরকারী পরিসংখ্যানে ৩১ হাজার সংক্রমণের খবর বলা হলেও, কিছু বিজ্ঞানী অনুমান করেছেন যে প্রকৃত হার এর ১০ গুণ বেশি হতে পারে।
কেননা এতে সংক্রামিত বেশিরভাগ লোকের মধ্যেই হালকা কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এজন্য তারা চিকিৎসা গ্রহণ করে না, কিন্তু তারা মারাত্মক এই রোগটি ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে তৃতীয় কারও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ডায়মন্ড প্রিন্সেস ক্রুজ জাহাজের প্রায় ৩৭০০ যাত্রীকে দুই সপ্তাহ ধরে কোয়ারান্টিন করে রেখেছে জাপান।
তারা ওই যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে।
চীনের বাইরে অন্তত ২৫টি দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে।
শুক্রবার, জাপানি গণমাধ্যম এনএইচকে জানিয়েছে যে ওই জাহাজে নতুন করে ৪১জনের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬১জনে।
ফিয়াট, ইউরোপ কার প্রকল্পকে করোনাভাইরাস ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করেছে
হংকংয়ে ৩৬০০ যাত্রী ও ক্রু সহ আরেকটি ক্রুজ জাহাজকে কোয়ারান্টিন করে রাখা হয়েছে। কারণ ওই জাহাজে তিনজনের ভাইরাসে সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে।
আপনার মতামত দিন: