Ameen Qudir

Published:
2019-12-02 06:02:21 BdST

সৌদি বিত্তবিলাস ছেড়ে ডা. আলম দেশে এসে যখন খুন হলেন তখন কি লজ্জায় ভেসেছিলেন?


 

ডা. শামসুদ্দিন আহমেদ
________________________


নিউজিল্যান্ডে আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে ডা. এড্রিক বেকার টানা ৩২ বছর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের কালিয়াকুড়ি গ্রামের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা দিয়েছেন। তার মহাপ্রয়াণের পর আরেক মানবতাবাদী ডাক্তার দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি। মহান এই ঘটনা। ডাক্তারদের মানবতাবাদের সমুজ্জ্বল নজির এই ঘটনা। ডাক্তাররা কোন দেশের নন, তারা সারা বিশ্বের মানবতার দিশারী। সারা বিশ্বই তাদের সেবার জায়গা। ডা. এড্রিক বেকার, ডাক্তার জেসিন এবং ডা. মেরিন্ডি যেমন মানবতার ঈশ্বর; তেমনি বাংলাদেশের হাজারো ডাক্তার বিশ্বের দেশে দেশে মানুষের সেবা করছেন।
মানবতার মহান দিশারী ডা. শাহ আলম সৌদী আরবের বিশাল বেতনের চাকুরি ছেড়ে চট্টগ্রামের কুমিরায় লাখো রোগীর সেবা করতেন। প্রতিষ্ঠা করেন গরীবের হাসপাতাল। কিন্তু তাকে বাঁচতে দেয় নি এদেশের মানুষ। সামান্য কিছু টাকার লোভে তাকে খুন করে বাসের হেলপার, চালক গং।
কই ডা. আলমকে নিয়ে তো ইত্যাদিতে অনুষ্ঠান হতে দেখি নি। তার নির্মম হত্যার পরও তাকে নিয়ে শোক হয় নি। আজ ডা. প্রিয়াঙ্কার জন্য সারা ভারতবর্ষ প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ। তিনিও ট্রাক চালক, হেলপার গংএর শিকার।
প্রতিবাদের আগুন ভারত সহ বাংলাদেশেও । কিন্তু মহামানবপ্রতীম ডা. শাহ আলমের জন্য ইত্যাদিতে যেমন অনুষ্ঠান হয় নি। তেমনি তার হত্যার পরও কোন প্রতিবাদ হয় নি।
বাঙালি সবসময় আত্ম বিস্মৃত। ডা. এড্রিক বেকার, ডাক্তার জেসিন এবং ডা. মেরিন্ডির প্রশংসা করতে গিয়ে বাংলাদেশী ডাক্তার বিরোধী জেহাদীরা নাকি লজ্জায় ভেসে যাচ্ছে। তারা ভয়ঙ্কর জেহাদ শুরু করেছেন। কই ডা. শাহ আলমের জন্য তাদের এক ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখি নি।

এ নিয়ে সাংবাদিক ফারুক ওয়াসিপ সুন্দর লেখা লিখেছেন। তিনি লেখেন,
তখন কি কেউ লজ্জায় ভেসেছিলেন? ডা. শাহ আলম সৌদি আরবের মদিনা হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান ছিলেন। সেই চাকরি ছেড়ে তিনি চট্টগ্রামের কুমিরাতে নিজের গ্রামে চালু করেন বেবি কেয়ার নামে নামমাত্র খরচের শিশু ক্লিনিক। প্রতিদিন ৩০ কিলোমিটার রাস্তা চার চাকার ম্যাক্সি নামের পরিবহনে করে চলাচল করতেন। গত অক্টোবর মাসে হাসপাতালের কাজ সেরে চট্টগ্রাম শহরে বাড়ি ফেরার সময় তিনি খুন হন, রাস্তার পাশে পাওয়া যায় তাঁর লাশ। তিনি মিশনারি ছিলেন না, ধর্মপ্রচারেও নামেননি। কেবল শিশুদের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন। দেশটাকে মনে হয় ভালও বাসতেন। তাঁর মৃত্যুতে কোনো সাড়া পড়েনি।

তখন কেউ লজ্জায়ও ভাসে নি।


আমরা ডা. এড্রিক বেকার, ডাক্তার জেসিন এবং ডা. মেরিন্ডির অবশ্যই প্রশংসা করি। তারা বিদেশী বলে , বা তাদের প্রশংসা করে দূতাবাসের নানা সুযোগ সুবিধার জন্য প্রশংসা করি না। করি তারা মানবতার জন্য। প্রতিজন ডাক্তারই এরকম মানবতার দিশারী।

ডা. এড্রিক বেকার, ডাক্তার জেসিন এবং ডা. মেরিন্ডির কথা
চাইলে নিউজিল্যান্ডে আরাম আয়েশের জীবন কাটাতে পারতেন ডা. এড্রিক বেকার। কিন্তু তা না করে বাংলাদেশের মানুষের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কাটিয়েছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। টানা ৩২ বছর টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরের কালিয়াকুড়ি গ্রামের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তাদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন হাসপাতালও। স্বদেশে আরাম-আয়েশের জীবন ত্যাগ করে মানবসেবায় তার এই অবদানে মুগ্ধ হয়ে সবাই তাকে ডাক্তার ভাই বলে ডাকতেন।

দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালে মারা যান ডা. এড্রিক বেকার। অবশ্য অসুস্থ হওয়ার পর অনেকেই তাকে ঢাকা নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে চেয়েছিলেন। তবে রাজি হননি গ্রামের মানুষের চিকিৎসায় জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় ব্যয় করা এই ডাক্তার। নিজের তৈরি হাসপাতালেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এড্রিক বেকার। তবে, মৃত্যুর আগে নিজের একটা ইচ্ছার কথা বলে গিয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন এ দেশের কোনো ডাক্তার যেন গ্রামে এসে তার প্রতিষ্ঠিত এই হাসপাতালের হাল ধরেন। কিন্তু হানিফ সংকেতের ইত্যাদিতে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুসারে- এ দেশের একজন ডাক্তারও তার সেই আহ্বানে সাড়া দেননি।

বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের কেউ সাড়া না দিলেও এড্রিক বেকারের আহ্বানে সুদূর আমেরিকা থেকে ছুটে এসেছেন আরেক মানবতাবাদী ডাক্তার দম্পতি জেসিন এবং মেরিন্ডি। আমেরিকার বিলাসবহুল জীবন পেছনে ফেলে বাংলাদেশে এসে গ্রামের ধুলামাটির সঙ্গে সংসার পেতেছেন শুধু কিনা সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে চিকিৎসা দেবেন বলে। শুধু যে নিজেরা এসেছেন তা নয়, নিজেদের ফুটফুটে সন্তানদেরও সাথে করে নিয়ে এসেছেন। তাদের শিক্ষার জন্য গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। গ্রামের শিশুরা এখন তাদের খেলার সাথী।

ইতোমধ্যে তারা কিছু বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছেন। থাকছেন মাটির ঘরে। স্থানীয়দের সাথে মিশে যেতে ডা. জেসিন লুঙ্গি এবং তার স্ত্রী মেরিন্ডি পরছেন শাড়ি।

গতকাল শুক্রবার (২৯ নভেম্বর) বিটিভিতে প্রচারিত হানিফ সংকেতের ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এই দম্পতিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই তা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। দরিদ্র মানুষদের জন্য নিউজিল্যান্ডের চিকিৎসক এড্রিক বেকারের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের হাল ধরে প্রশংসায় ভাসছেন আমেরিকান এই দম্পতি।

ডা. জেসিন হানিফ সংকেতকে জানান, ডা. এড্রিক বেকার বেঁচে থাকার সময় কালিয়াকুড়ির এই হাসপাতালটি পরিদর্শন করেছিলেন। পরে ডাক্তার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শুনে জেসন অস্থির হয়ে ওঠেন। কিন্তু তখন নিজের প্রশিক্ষণ ও ছেলেমেয়েরা ছোট থাকার কারণে জেসন বাংলাদেশে আসতে পারেননি। অবশেষে সবকিছু গুছিয়ে সম্পদ আর সুখের মোহ ত্যাগ করে ২০১৮ সালে পুরো পরিবার নিয়ে আমেরিকা ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে আসেন মধুপুরে। জেসন হয়ে ওঠেন নতুন ডাক্তার ভাই আর মেরিন্ডি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় ডাক্তার বিবি। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পাঠিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন এই দম্পতি। তবে ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশি ডাক্তারদের গ্রামে গিয়ে দরিদ্র মানুষের সেবার আহ্বান জানিয়েছেন জেসন-রেরিন্ডি। তারা মনে করেন, দরিদ্র এসব মানুষের জন্য আরও ভালো চিকিৎসা দরকার।

তারা বলছেন, যে দেশে যাওয়ার জন্য দুনিয়ার সবাই পাগল সেই আমেরিকার বিলাসবহুল জীবন দূরে ঠেলে বাংলাদেশে এসে দরিদ্র মানুষের সেবা করে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা তা নজিরবিহীন বলেও দাবি করছেন। পাশাপাশি নিজের দেশের দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা দিতে কেউ এগিয়ে না আসা দেশবাসীর জন্য লজ্জার মনে করছেন তারা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়