Ameen Qudir

Published:
2019-10-17 22:19:01 BdST

একজন মহান চিকিৎসকের নীরব মৃত্যু: কিভাবে তিনি অক্লান্ত সেবা করতেন, সেই কাহিনি


ডা. সুফিয়ান মিয়া
__________________________


বেশির ভাগ ডাক্তারই তাদের জীবন জুড়ে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার মত মানবসেবা করেন। কিন্তু এই মহান মানবসেবার ব্রত থেকে যায় মিডিয়ার প্রচারের অন্তরালে । তারা জীবন বাচাঁন । জীবন রক্ষা করেন অক্লান্ত পরিশ্রমে। তাদের অকাল মৃত্য বা মহাপ্রয়াণ ঘটলেও মিডিয়ার চোখে তা অপাংক্তেয়। কেউ জানেন না এসব মহান মানুষের চলে যাওয়ার খবর। যদি তাদেরকোন আত্মীয় সন্তান অনলাইনে লেখেন, তা আসে সামান্য কিছু লোকের চোখে। এমন একজন মহান মানবসেবী ছিলেন প্রফেসর ডাঃ রেজাউল ইসলাম স্যার। তার সম্পর্কে অনেক কথাই লেখা যায়। বড় ভাল মানুষ ছিলেন।এলাকার মানুষ উনাকে পাশে পেয়েছেন সর্বদা। কেউ বড় কোন অসুস্থ হলেই শেষ ভরসা ছিল রেজা স্যার । সেই মানবসেবাব্রতী রেজাউল স্যারই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। গত সেপ্টম্বরে প্রয়াত হন তিনি। কিন্তু কোন মিডিয়ায় তা আসে নি। তার সম্পর্কে লিখেছেন খান আরিফুল হক। আরিফুলকে ধন্যবাদ স্যারকে নিয়ে লেখার জন্য।
·
একজন আলোকিত মানুষের চিরবিদায়/ডা. খান আরিফুল হক

অধ্যাপক ডাঃ_রেজাউল_ইসলাম।
এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমডি (এনেস্থিসিয়া)

শেষ দেখা টা হলনা কাকা। কাল রাতেও মু. বিল্লাল হোসেন এর সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাট হচ্ছিল। আমি আবার ও বললাম অক্টোবর এ ঢাকা আসতেছি। রেজা কাকার সাথে দেখা করতেই শুধু ঢাকা যাব আমি।
কিন্তু নির্মম বাস্তবতা সেটা আর হতে দিলনা।

ছবির মানুষটার কথাই বলছিলাম। উনার পরিচয় হয়তো অনেকেই জানেন না। উনি কে ছিলেন আর কি ছিলেন শুধুমাত্র যারা উনাকে চিনেন তারাই জানেন।

প্রফেসর ডাঃ রেজাউল ইসলাম এর জন্ম ঝিনাইদহ এর কালীগঞ্জ উপজেলার চাপরাইল গ্রামে। বেশ দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। অত্যন্ত কষ্ট করে পড়াশোনা করে রাজশাহী মেডিকেলে চান্স পান এবং সেখানেই এমবিবিএস পাশ করে এনেস্থিসিয়া তে এফসিপিএস ও এমডি কম্পলিট করেন।
তার স্বপ্নই ছিল দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষ যাদের অর্থের অভাবে পড়াশোনা করা সম্ভব নই তাদের পিছনে দাঁড়ানো। নিজ অর্থায়নে তাই চাপরাইল গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন "বাঁচার জন্য সংগ্রাম লাইব্রেরি " যেখানে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত সকল ছেলে-মেয়েরা এসে পড়াশোনা করত। তাদের জন্য খাতা,কলম,বই সহ পড়ালেখার সমগ্র সামগ্রী বহন করতেন তিনি নিজেই। এমনকি বিভিন্ন উৎসবের সময় তিনি তাদের জন্য পোশাক ও সংবহন করতেন।

তিনি পরবর্তীতে মোট দুইটা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে দুই এলাকার সুবিধা বঞ্চিত ছাত্র-ছাত্রীরা পড়শোনা করে।
একবার উনার সাথে আলোচনা কালে মনে আছে যখন শুনলেন এলাকার ছেলেরা মাদক এর নেশায় পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখন উনি বললেন আমি পিস্তল কিনব। শেষ করব সেই সব মানুষের যারা এরকম সোনার ছেলেদের ধ্বংস করতেছে। একজন অরাজনৈতিক মানুষের মুখে এরকম কথা শুনে থ হয়ে গেছিলাম!
ভাবতে পারেন! কতটা ভালবাসা এলাকার মানুষের প্রতি না থাকলে এমন কথা বলতে পারেন?

এতো গেল পড়াশোনার কাহিনী।
সরকারী চাকুরী শেষ করে তিনি জব শুরু করেন ঢাকার আদ-দ্বীন হাসপাতালে। অত্যন্ত ব্যস্ত এবং নামকরা একজন এনেস্থেশিওলজিষ্ট ছিলেন তিনি।
এর মধ্য থেকেও এলাকার মানুষ উনাকে পাশে পেয়েছেন সর্বদা। কেউ বড় কোন অসুস্থ হলেই শেষ ভরসা ছিল আমাদের সবার রেজা কাকা।

তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও তাদের সকল সহযোগিতা করতেন এমনকি সবার সাথে সময় করে দেখাও করতেন। যেটা আমার এই ব্যস্ততার মাঝে আমি নিজেই পারিনা অনেক সময়।

ঈদে কিংবা কোন ছুটিতে বাসায় আসলেই এলাকার কম বেশি সকল স্টুডেন্ট দের খোজ নিতেন তিনি।
কখনও যদি শুনতেন এলাকার কোন সম্ভাবনাময় ছেলের কথা, উনি তার ফোন নাম্বার রাখতেন। নিয়মিত খোজ খবর রাখতেন তার।
উনার অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতার এলাকার অনেক ছেলে/মেয়ে ডাক্তার হয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন, ঢাকা ভার্সিটি কিংবা অন্য কোন পাবলিক ভার্সিটি পড়ুয়া বহু ছেলে উনার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সহযোগিতায় কেউ বা হয়েছে পুলিশ অফিসার কিংবা বিসিএস এর ক্যাডার কিংবা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

এবার আসি আমার কথাতে! মেডিকেলে চান্স পাবার আগে চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারে উনাকে যে কতবার জ্বালিয়েছি আমি তার ইয়ত্তা নেই। ঢাকা গেলে শত ব্যস্ততায় ও সময় করে দেখা করতেন ও সময় নিয়ে কথা বলতেন। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় আমি চরম মাত্রায় অসুস্থ হয়ে যায়৷ তখন ঢাকাতে ডাক্তার দেখানো সহ যাবতীয় সকল সহযোগিতা উনিই করেছিলেন।

ঈদের ছুটিতে বাসায় আসলে সবসময় খোজ খবর নিতেন। আমার প্রফের রেজল্ট কিংবা বিসিএস এর রেজাল্ট এর খবর আমার আত্মীয় স্বজন না নিলেও তিনি নিতেন।

বারবার পোষ্টগ্রাজুয়েশন এর জন্য পড়তে বলতেন।

ইচ্ছা ছিল কোন একদিন পোষ্টগ্রাজুয়েশনে চান্স পেয়ে বাবা-মায়ের পর উনাকেই প্রথম জানাবো আমি।

সেই সৌভাগ্য আমার আর হলনা।
মানুষের অনেক আশা শুনেছি পূরন হয়না।
আমার টাও হলনা।
এমনকি জীবনের শেষ মুহুর্তে দেখা টাও হলনা।

তবে কাকা! কোন একদিন ইনশাআল্লাহ আপনাকে এই এই সুসংবাদ আমি দিবই ইনশাআল্লাহ।

শুনেছি ভাল মানুষ খুব দ্রুতই চলে যায়। তার আরেকটা উদাহরণ স্পষ্ট।
প্রথমে উনার থাইরয়েড ক্যান্সার ধরা পড়ল। চিকিৎসা করে সুস্থ হলেন।

এবার ধরল পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ ব্যধি 'মোটর নিউরোন ডিজিজ' (স্টিফেন হকিং এর যে রোগ ছিল)

আস্তে আস্তে নিস্তেজ করে উনাকে না ফেরার দেশে নিয়ে গেল।

ঈদের ছুটিতে বন্ধু বিল্লাল ও M A Amin Raj এর সাথে কথা হচ্ছিল। ওরা বলছিল কাকা ওদের বলেছে আমি হয়ত আর এই ডিসেম্বর পর্যন্ত আছি!
বাট অক্টোবর পর্যন্তও যে থাকবেন না সেটা ভাবতে পারছি না।

কোন একটা প্রোগ্রামে যার বক্তৃতা শুনার জন্য বসে থাকতাম আর সমসময় নিজেকে অনুপ্রেরণা নিতাম জীবনের শেষ মুহুর্তে তার সাথে দেখা হলনা এইটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছি না।
ওপারে ভাল থাকবেন প্রিয় কাকা, এলাকাবাসীর মত আমারও অভিভাবক।

ওপার থেকে দোয়া করবেন, আমি যেন আপনার মতই আলোকিত একজন মানুষ হতে পারি। দেশের না হোক দশের উপকারে যেন আসতে পারি।

বিদায় প্রফেসর ডাঃ রেজাউল ইসলাম কাকা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়