Ameen Qudir

Published:
2019-09-17 20:42:43 BdST

ফল বিক্রি করতেন: পরে তিনিই বিশ্বখ্যাত নিউরোসার্জন:জন্মস্থানে এসে এভাবেই মাথা ঠুকলেন


ডেস্ক
_____________________________


এটি একটি মর্মস্পর্শী লেখা। লিখেছেন ডা. সুব্রত ঘোষ। দেশ ভাগের মর্মবেদনায় বিষন্ন এই লেখা।

 

বিখ্যাত নিউরোসার্জন শ্রী রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত (রবীন) সম্প্রতি UK -এর NHS -এর চাকুরী থেকে অবসরে যান। অবসরে যাবার আগে তিনি ইউনিভার্সিটি অব নিউক্যাসেল এর চীফ নিউরোসার্জন ছিলেন। কোলকাতার চিকিৎসক হিসাবে পরিচিত হলেও তিনি মূলত চট্টগ্রাম -এর হাট হাজারীর নন্দীরহাটে জন্মগ্রহণ করেন।
সংখ্যালঘুর তকমা নিয়ে তার পূর্ব পুরুষকেও যথারীতি দেশ ছেড়ে কোলকাতায় আশ্রয় নিতে হয়। খুবই দরিদ্র রামপ্রসাদ ডাক্তারী পড়ার আগে ফল বিক্রি করতেন।
তাঁর ভিটে বাড়িটিও যথারীতি দখল হয়েছে। সম্প্রতি তিনি দীর্ঘ ৬৪ বছর পর চট্টগ্রাম ঘুরে গেলেন নীরবে। তাঁর জন্মস্থানে এসে এভাবেই মাথা ঠুকলেন।
একজন ধন্বন্তরী চিকিৎসক ডা. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত; এটা তাঁর পারিবারিক নাম। কিন্তু বিদেশিদের কাছে রামপ্রসাদ হয়ে গেলেন রবীন সেনগুপ্ত। সে নামেই তাঁকে চেনেন ইউরোপ, আমেরিকায় তাঁর চেনাজানা মানুষেরা। রবীন সেনগুপ্ত এমনই একজন আধুনিক ধন্বন্তরী চিকিৎসক, নিউরোসার্জারির জগতে যাঁকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিউরোসায়েন্টিস্ট হিসেবে মানা হয়। ভুবনজোড়া তাঁর আসন। তিনি থাকেন ব্রিটেনেই, ব্রিটিশ নাগরিক তিনি। কিন্তু নিউরোসার্জারিতে তাঁর অসাধারণ অধিকার ও অপারেশনে কৃতিত্বপূর্ণ ব্যাপক সাফল্যের খবর চাউর হয়ে যাবার পর ইউরোপ ছাড়াও এখন এশিয়া ও আমেরিকা থেকেও তাঁর ডাক পড়ছে এবং তিন মহাদেশে দৌড়ঝাপ করেই তাঁর বছর কেটে যায়। কারণ, নিউরো সার্জারিতে তিনি অথরিটির পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার বা ও বি ই উপাধিতে ভূষিত করেছে।
১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য তিনি কলকাতা যান। সেখান থেকে অধিকতর উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৬১ সালে বিলেতে যান। ইন্টার্নশিপ শেষ করেননি, হাতে খুব অল্পই টাকাপয়সা। লন্ডনে যাওয়ার পর মাসখানেক এখানে ওখানে ঘুরলেন। খুব একটা সুবিধে করতে পারলেন না। শেষে ম্যানচেস্টারের বেরি জেনারেল হাসপাতালে একটা চাকরি পেলেন। একবছর পরে পেলেন ডাক্তার হিসেবে নিবন্ধন। এরপর বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে শেষে নিউরোসার্জাারি বিভাগেই থিতু হলেন ড. রামপ্রসাদ সেনগুপ্ত।
চিকিৎসা শাস্ত্রের এই বিভাগটা দারুণভাবে আকর্ষণ করল তাকে। নিউরোসার্জনদের কাজ, রোগীদের জীবন-মরণ লড়াই, তাদের সুস্থ করে তোলার জন্যে চিকিৎসকদের আকুলতা–সবকিছুতেই একটা চ্যালেঞ্জিং অনুপ্রেরণা খুঁজে পেলেন। মানব শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ অংশটার চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পেলেন। কিন্তু যত সহজে চাওয়া যায়, পাওয়াটা তত সহজে হয় না। এ জন্যে লাগে সুষ্ঠু পরিকল্পনা, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ঐকান্তিকতা। ড. সেনগুপ্ত এই তিনটি জিনিসকে কাজে লাগালেন। চরম কঠিন সে দিনগুলোতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছেন তিনি। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও কাজে লেগে থাকতেন। কারণ ততদিনে সংসারে বাড়তি মুখ এসেছে। ছেলে এবং মেয়ে। তাদের ভরনপোষণও তো বাবাকেই করতে হবে। প্রতিটি পাই-পয়সা পর্যন্ত হিসেব করে খরচ করতেন। স্ত্রী-সন্তানকে ততদিনে নিজের কাছে নিয়ে গেছেন।

 

১৯৭১ সালে এডিনবরা থেকে এফআরসিএস পাস করলেন ড. সেনগুপ্ত। এসময় তার স্ত্রী ভারতে ফিরে আসার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন। ড. সেনগুপ্ত নিজেও চাইছিলেন পেশাগত ক্যারিয়ারটা ভারতেই গড়ে তুলবেন। কিন্তু ভারতের কোথাও সুযোগ পাচ্ছিলেন না। যাহোক দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ১৯৭৩ সালে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে চাকরি পেলেন। তবে সেখানে কেবল মাথার ইনজুরি ছাড়া আর কোনো ধরনের চিকিৎসার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ড. সেনগুপ্ত চাইছিলেন আরো সূক্ষ্ম ও বড় ধরনের কাজ করতে। কারণ এর আগে এর চেয়ে বড় কাজও তিনি করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলেন, ভারতে এর চেয়ে বড় কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি ফের ইংল্যান্ডে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। জানেন, কঠিন পরিশ্রম করে তাকে ওখানেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
কিন্তু সময়টা গত শতকের সত্তরের দশক। একজন ভারতীয় ডাক্তারের পক্ষে ইংল্যান্ডের স্থানীয় চিকিৎসকদের ভিড়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাটা সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। কিন্তু নিজের যোগ্যতা ও ঐকান্তিক ইচ্ছার ফল পেলেন ড. সেনগুপ্ত। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত নিউরোসার্জন ড. উইলিয়াম সুইটের কাছ থেকে ডাক পেলেন। মেস জেনারেল হাসপাতালে তার সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলেন। কিন্তু কাজটাকে উপভোগ করতে পারছিলেন না ড. সেনগুপ্ত। শেষে নিউ ক্যাসলের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে যোগ দিলেন। ২০০২ সালে ৬৫ বছর বয়সে নিউক্যাসল হাসপাতাল থেকে অবসর নেন ড. সেনগুপ্ত। নিউক্যাসল হাসপাতাল তাদের অপারেশন থিয়েটারের নাম রাখে তার নামানুসারে ‘রবিন সেনগুপ্ত থিয়েটার’। এর মানে হলো সরকারি চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এরপরও তাকে চেয়েছিল। তাই শেষ পর্যন্ত ২০১২ সালে তিনি চূড়ান্তভাবে অবসর নেন।
শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯৫৩ সালে মেট্রিক পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে পাস করলেন। মেডিক্যাল ফর প্রফিসিয়েন্সি ইন বায়োকেমিস্ট্রি সম্মাননা পেলেন ১৯৫৭ সালে, ১৯৫৮ সালে সার্টিফিকেট অব অনার্স ইন সার্জারি পেলেন। পেশাগত জীবনে ১৯৭৩ সালে পান ডেভিড ডিকসন গবেষণা পুরস্কার। এসবিএনএস ১৯৭৪ সালে তাকে কেইমস মেমোরিয়াল ট্রাভেলিং স্কলারশিপে ভূষিত করে। ডিসটিংশন অ্যাওয়ার্ড পেলেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯২ সালে পান এ মেরিট। ১৯৯৯ সালে ডাচ নিউরোসার্জিক্যাল সোসাইটি থেকে পান বেক পদক। ২০০০ সালে নিউরোসার্জিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া তাঁকে নিউরোসার্জন অব দ্য মিলেনিয়াম পদকে ভূষিত করে।
পেশাগত ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে যেমন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে ড. সেনগুপ্তের, তেমনি তার দাতব্য কর্মকাণ্ডের ভাণ্ডারও বিশাল। জন্ম বাংলাদেশে হলেও বর্তমানে তিনি ভারতেরও নাগরিক। ভারতে নিউরোসার্জারি চিকিৎসাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। নিজের টাকায় কলকাতায় গড়ে তুলেছেন নিউরোসায়েন্স সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব ভারতের ৩০ কোটি মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল হয়ে উঠেছে। স্ত্রী এবং নিজের সঞ্চয় থেকে আড়াই লাখ পাউন্ড খরচ করেছেন। এই দাতব্য প্রতিষ্ঠানটির বড় পৃষ্ঠপোষক হলেন ডাচেস এলিজাবেথ অব নর্দাম্বারল্যান্ড। মূল প্রতিষ্ঠানটি হলো নিউরোসায়েন্স ফাউন্ডেশন।

 

লেখাঃ Dr. Subrata Ghosh

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়