Ameen Qudir
Published:2019-06-24 21:36:34 BdST
দারিদ্র, পুত্রশোক সহ নানা বাঁধা কাটিয়ে সেরা নিউরোলজি সেন্টার গড়ে তুললেন যে ডাক্তার
ডেস্ক/ বঙ্গদর্শন পত্রিকা 
________________________
পরিবারের আর্থিক অবস্থার হাল শোচনীয়, তাই একসময় বাধ্য হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কলা বিক্রিও করতে হয়েছে তাঁকে। এইভাবেই চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। পাশ করেছেন ডাক্তারি। 
তারপর কত শোক, ছেলে হারানোর বেদনা, নানা চড়াই উৎরাইয়ে দমে যান নি মানুষটি। ডাক্তার বলে কথা। মানুষের সেবায় সেরা কাজটি তিনি করবেনই। এই প্রত্যয় তাকে নিয়ে গেছে অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রতিজ্ঞায়। কিভাবে তা সম্ভব হল। সেই কাহিনি। 
বাঙালি ও বাংলার জন্য উপমহাদেশের সেরা নিউরোলজিকাল কেয়ার গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন মানুষটি। যাকে বলা যায়, নিউরোলজিকাল কেয়ারের সুপ্রিম কোর্ট। যার সামনে উপমহাদেশের অন্যান্য নিউরোলজি কেয়ারগুলি গুণমানে হাই কোর্ট বা নিম্ন আদালতের মর্যাদা পাবে। স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করতে করতেই খোদ কলকাতার বুকে তিনি তৈরি করলেন ‘ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস কলকাতা’ (আইএনকে)। একটি বিশ্বমানের নিউরোলজি সেন্টার। এই প্রতিষ্ঠানকে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিউরোলজিকাল কেয়ারের মর্যাদা দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ডিএসআইআর’ এমনকি সিএনবিসি-ও। পশ্চিমবঙ্গকে এইভাবে বিশ্বের চিকিৎসা মানচিত্রে যুক্ত করে দেওয়ার পরেও স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি সেই মানুষটি। এবারে তাঁর স্বপ্ন, এই রাজ্যের বুকেই আস্ত একটি নিউরো মেডিকেল কলেজ গড়ে তোলার। যেটি হয়ে উঠবে দেশের সেরা ও সবচাইতে বড়ো নিউরোলজির ইনস্টিটিউট।
মানুষটির নাম ডাঃ রবিন সেনগুপ্ত। নির্দ্বিধায় উপমহাদেশের সেরা নিউরো সার্জেন বলা যায় তাঁকে। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নিউরো সার্জেনের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। বিশ্বের আনাচে-কানাচে বহমান তাঁর খ্যাতি। বাংলা ও বাঙালির গর্ব এই মানুষটি তাঁর মধ্যেই স্বপ্ন দেখেন নিজের রাজ্যকেও কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার। স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে জানেন বটে তিনি। তাঁর তৈরি করা ‘ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস কলকাতা’-তে আজ চিকিৎসা করাতে আসেন ভিন রাজ্যের মানুষরাও। এনআরএস-এর আহত জুনিয়র ডাক্তার পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের চিকিৎসাও চলছে এখানেই। নতুন নিউরো মেডিকেল কলেজের জন্যও জমি চিহ্নিত করা হয়েছে কল্যাণীতে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সমস্ত রকমের সহযোগিতার আশ্বাসও মিলেছে। এবারে সেই স্বপ্নের আকাশ ছুঁতেই ফের প্রস্তুত হচ্ছেন ডাঃ রবিন সেনগুপ্ত। তাঁর সমগ্র জীবনটাও তো যে-কোনো মানুষের চোখে স্বপ্ন বুনে দেওয়ার মতোই।
১৯৫৫ সালে কয়েক হাজার উদ্বাস্তুদের স্রোতে মিশে চট্টগ্রাম থেকে এসে আছড়ে পড়া কলকাতায়। পরিবারের আর্থিক অবস্থার হাল শোচনীয়, তাই একসময় বাধ্য হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কলা বিক্রিও করতে হয়েছে তাঁকে। এইভাবেই চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। পাশ করেছেন ডাক্তারি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে খ্যাতি তখন থেকেই। এরপর, তিনি পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ড। উদ্দেশ্য চিকিৎসার জ্ঞান আরো বাড়িয়ে নেওয়া। ১০ বছরের মধ্যেই চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ল বিদেশে। সাফল্য যখন তাঁকে সবটুকু দিয়ে আলিঙ্গন করতে চাইছে, সেই সময়েই সিদ্ধান্ত নিলেন দেশে ফেরার।
কিন্তু, সে-যাত্রায় বেশিদিন দেশে থাকা হয়নি ডাঃ সেনগুপ্তর। সেই বছর, ১৯৭১-এই বাংলাদেশকে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ঘিরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হল। দেশে চাকরি নেই। অতএব, ফের বিলেতেই ফিরতে হল তাঁকে। ক্রমে ব্রিটেন, আমেরিকা-সহ বিশ্বের নানা দেশের ছড়িয়ে পড়ল তাঁর নাম। যে-কোনো জটিল অপারেশনের জন্য তাঁকে পাড়ি দিতে হত নানা দেশে, মাঝেমাঝে আসতেন ভারতেও। ইতিমধ্যেই ১৯৮৫ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জৈল সিং-এর স্ত্রীর মস্তিষ্কে কঠিন অসুখ ধরা পড়ে। রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং প্রখ্যাত নিউরো-সার্জেন ডাঃ রামামূর্তি পরামর্শ দেন, এই অপারেশন পৃথিবীতে একমাত্র একজনই সফলভাবে করতে পারবেন। তিনি ব্রিটেন-প্রবাসী চিকিৎসক ডাঃ রবিন সেনগুপ্ত। ডঃ সেনগুপ্ত অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্নও করেন সেই অপারেশন। দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রপতির স্ত্রী।
অপারেশনের সূত্রে বারবার দেশে আসার সময়েই বাংলার মাটিতেও বিশ্বমানের নিউরোলজি সেন্টার তৈরির স্বপ্নটা ফের দানা বাঁধতে শুরু করে ডাঃ সেনগুপ্তর মনে। বিলেতের নিউ ক্যাসল জেনারেল হসপিটালের সঙ্গে সুদীর্ঘ সম্পর্ক ছিলই, এবারে কলকাতাতেও কয়েকটি বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন তিনি। এইসবই আসলে নিজের কৈশোরের শহরে ফেরার তাগিদ থেকেই। বিদেশে কাজের পরিবেশ ও পরিকাঠামো আলাদা। ফলে অসুবিধে হচ্ছিলই। কিন্তু হাল ছাড়তে চাননি ডাঃ রবিন সেনগুপ্ত। ইতিমধ্যেই, তৎকালীন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয় কলকাতার বুকেই নিজস্ব একটা ইনস্টিটিউট তৈরি করার। বলা হয়, রাজ্য সরকার প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে। এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে বাংলায় বিশ্বমানের নিউরোসায়েন্সের প্রতিষ্ঠান তৈরির কাজে সবটুকু দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডাঃ সেনগুপ্ত। শুরু হল তহবিল গড়ার প্রস্তুতি।
এরমধ্যেই বিপর্যয় নেমে এল ডাঃ রবিন সেনগুপ্তর জীবনে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন তাঁর একমাত্র পুত্রসন্তান। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, চিকিৎসাও ছেড়ে দেবেন। কিন্তু, কর্তব্য আর স্বপ্ন ফের হাতছানি দেয়। স্ত্রীর উৎসাহে কাজে ফেরেন ডাঃ সেনগুপ্ত। কলকাতার বুকে নিউরোসায়েন্সের প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজেও গতি আসে। তিনি চাইছিলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়তে, যার সঙ্গে দেশের কোনো নিউরোসায়েন্স প্রতিষ্ঠানের তুলনাই হবে না। সে পাল্লা দেবে বিশ্বসেরা হার্ভাড, নিউ ক্যাসেল নিউরোসায়েন্স সেন্টারের সঙ্গে। কলকাতা পৌরসভা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। মল্লিকবাজারের জমি হস্তান্তরও হল। ধীরে ধীরে গড়ে উঠল ‘ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস কলকাতা’।

এই প্রতিষ্ঠান কিন্তু ডাঃ সেনগুপ্তর নিজস্ব মালিকানাধীন নয়। একমাত্র সন্তানকে হারানোর পর মাসে ২০ দিন কলকাতা আর বাকি ১০ দিন ব্রিটেনবাসের অসম্ভব-প্রায় জীবন তিনি বয়ে নিয়ে গেছেন টানা। তা কিন্তু মুনাফার স্বার্থে নয়। বাংলা-কে কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার নেশাতেই।
সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর। ১৫০টি শয্যার ‘ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস কলকাতা’ এখন প্রশ্নাতীতভাবে দেশের অন্যতম সেরা নিউরোলজি সেন্টার। কিন্তু, ডাঃ সেনগুপ্তর স্বপ্ন আরো চড়াই ভাঙছে রোজ। তিনি যে চান এই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বের সেরা করে তুলতে। চান নতুন নিউরো মেডিকেল কলেজ গড়তে। তাঁর স্বপ্নের কোনো শেষ নেই।
রাজ্য সরকার ফের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কল্যাণীর মেডিকেল কলেজও গড়ে উঠবে নিশ্চয়ই। বিশ্ব মানচিত্রে ফের একবার গর্বিত হবে বাংলা।
এর বিনিময়ে আমরা আপনাকে আর কীই বা ফিরিয়ে দিতে পারি।
আপনার মতামত দিন:

 
                 
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                        
                                       