Ameen Qudir

Published:
2016-12-25 19:43:53 BdST

কি যে ভয়ানক সে রাত: প্রচন্ড অপমান


 

 

ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী

_________________________________


ঘটনার আকস্মিকতায় আজাদ নিজেও খানিকটা বিব্রত!কেবল সাদামাটা ভাবে শুরু হওয়া দিনটাতে আর কি কি দেখতে হবে?ভয় হচ্ছে এত আলো,হই চই,টেনশন!মাইগ্রেনের ব্যথাটা না শুরু হয়।
কি আশ্চর্য পৃথিবী আর কি চমৎকার মানুষের ভবিতব্য!কোথাকার জল কোথায় গড়ায়??

 

সকাল দশটা পর্যন্ত ও আজাদ জানতো রাসেলের কনে দেখা প্রোগ্রামে সে যাবে না।নেহায়েৎ ই থাইল্যান্ডের ঐ ডেলিগেট এর ফোন এল বিকেলের মিটিং ক্যানসেল!তাই ও রাসেলকে জানাল যে ওদের সাথে সে ও যাচ্ছে।মূলত এগার জনের স্কুল গ্রুপের মাঝে একজন কার এক্সিডেন্টে মারা গেছে।আর দশজনের মাঝে আজাদ আর রাসেল দুজন ই কেবল অবিবাহিত।রাসেল আমেরিকা থেকে ফিরেছে আটদিন আগে।এর মাঝে সব বন্ধুরা আর তাদের বউ বাচ্চার দঙ্গল সাথে নিয়ে তিনটে মেয়ে দেখা হয়েছে।আজ চার নম্বর!!


চুরির টুংটাং শব্দে ফিরে তাকাল আজাদ।নিজেকে একটু সময় দিতে সকলকে অনুরোধ করেই কিছুক্ষন আগে বারান্দায় এসে বসেছে সে।বাতি নেভানো।কে? বলে উঠলে অনুপমা নীলচে বাতিটা জ্বালল!এই ভয়টা ছিল তার।প্রশ্ন!হয়ত কঠিন প্রশ্ন সম্মুখে।অনুপমা কিছু জানতে না চেয়েই নতমুখে দাঁড়িয়ে রইল।


আজাদ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল।শোভা!
মা নামকরা সুন্দরী ছিল বলেই ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীর কালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন নানাভাই।বড় দুই বোন,আজাদ ঠিক মায়ের গায়ের রং পেয়েছে।কিন্তু আজাদের পিঠাপিঠি জন্ম নেয়া ছোট বোনটি হলো বাবার মত বেশ কালো রংয়ের।উঠতে বসতে বেচারীকে সবাই এই বলে কথা শোনাত।শোভা মন খারাপ করে ঘুরত।বার বার পাউডার লাগাত।ক্রিম মাখত।সাবান দিয়ে ঘষত।কালো ছিল বলেই কিনা জানা নেই,শোভা সকলের মন জয়ের চেষ্টা করত।সবার যত্ন করত।পাড়ার মানুষ ওকে লক্মীমন্ত বলত।বাবা ডাকত মা।বড় দু বোনের বিয়ের পর বাবা নতুন ব্যবসা শুরু করে বেশ ধার করে ফেলল।শোভার বয়স বাড়ছে।কঠিন সময় যাচ্ছিল।শোভা এইচ এস সিতে স্টার পায়।ইউনিভার্সিটির ভর্তির আগেই বাবা বিয়ের উদ্যোগ নেয়।


সব আয়োজন শেষ।বাবার বন্ধুর ছেলে।সরকারী চাকুরীজীবী।পছন্দ হলে ঐ রাতেই আকদ -এমন প্রস্তুতি।শোভাকে দেখে ওরা যেন আঁতকে উঠল।বড় আপাকে দেখেছিল।শোভা কালো তা জানত না!
কি যে ভয়ানক সে রাত।প্রচন্ড অপমান।অপদস্ততা।শোভা ঐটুকুন মেয়ে খুব কাঁদছিল।সব আত্মীয়রা জেনেছে।বাবা তার বন্ধুর হাতে পায়ে ধরছিল।তারা এই সুযোগে সওদা করতে চাইল।কালো মেয়ে গছাতে হলে ধানমন্ডির বাড়ীটা লিখে দিতে হবে।বাবার ঘর আলো করা কালো মেয়ে!এক কথায় রাজী হলো।মা কিছুতেই ছেলেকে ঠকিয়ে মেয়েকে বাড়ী দিতে নারাজ।বাবার ধার!সম্পদ বলতে ঐটুক ই।শোভা খুব ক্ষেপে গেল।বাবাকে অনেক বোঝাল।বাবা বুঝতেই চাইছিল না।এক পর্যায়ে বাবার বন্ধুরা চলে গেল।কিছু আত্মীয় ইঙ্গিতপূর্ন কথা বলছিল।ঐ রাতেই অভিমানী শোভা ফ্যানের সাথে ওড়না দিয়ে হ্যাঙ্গিং করে সুইসাইড করল।শোভার লাশ দেখে বাবা হার্ট এটাক করে মারা যায়।আর এই দুই চলে যাওয়া থেকে আজ উনিশ বছর।আজাদের এখন উনচল্লিশ চলছে।

কেবল ব্যবসা,জনসেবা,পরোপকার নিয়েই আছে।মা প্রথম প্রথম খুব ভেঙ্গে পড়েছিলেন।এখন ভীষন চুপচাপ।এই উনিশ বছরে বিয়ের কথা একবার ও ভাবেনি আজাদ।জীবনেও বিয়ের জন্য কোন মেয়ে দেখেনি।।।


রাসেলের বিয়ের কনে দেখতে এসে ওরা বসার খানিক পরে অনুপমা ঢুকল।ভীষন কালো দেখতে মেয়েটি।বড় বড় চোখ আর পিঠময় ছড়ানো কালো চুলের বন্যা।এতটুকু সাজেনি সে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকোলজিতে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছে।রাসেলের বড় ভাবী হঠাৎ দাঁড়িয়ে এমন সব কথা বলতে লাগলেন!!


আপনারা ছবি দিলেন।তাতে তো ফর্সা মেয়ে।এই কুচকুচে কাল মেয়ে নিয়ে এমেরিকান প্রবাসী ছেলের স্বপ্ন দেখেন??লোকে ভাববে,আফ্রিকা থেকে নিগ্রো বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।নিরুপমা লজ্জায় এতটুকু হয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।রাসেল ও জানিয়ে দিল,এত কাল মেয়ে বিয়ে করবে না।
আজাদ নিরুপমার দিকে চেয়েছিল।যেন উনিশ বছর আগের কোন দৃশ্য।একটা চুপচাপ কালো রঙ্গা মেয়ে বিয়ের বাজারে অযোগ্য বলে নিগৃহীত।একি চোখের জল - সেদিন শোভার ঝরেছিল আর আজ নিরুপমার!
ঐ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিল আজাদ।বড় আপাকে ফোন দিল।নিরুপমার বাবা মাকে জানাল।
এখন রাত এগারটা।বাড়ী ফিরতে হবে।নিরুপমার কোমল আঙ্গুলে আজাদের পরানো আংটি।সে এখন একটু সেজেছেও!ঘন চুলের আড়ালে মুখখানা লুকিয়ে।
রাত বাতির নীল আলোয় নিরুপমা যেন রহস্যময়ী কেউ।কেমন যেন দায়মুক্তির অনুভব হলো আজাদের।
এই প্রথম বারের মত বাড়ী ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না!
সব নিয়ম ভেঙ্গে,লাভ - লোকসানের হিসেব ছেড়ে এই রহস্যময়ী অপরুপার হাত দুটি ছুঁয়ে থেকে এই অচেনা রাতকে উপভোগ করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে আজাদের।

_______________________________

 

লেখক
ডা. শিরিন সাবিহা তন্বী । জনপ্রিয় কলামিস্ট। কথাশিল্পী। মেডিকেল অফিসার, শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়