Ameen Qudir

Published:
2016-12-24 22:38:04 BdST

দুর্গন্ধে স্ত্রী উধাও : ভালবাসার ফেরিওয়ালা ডাক্তার সেবায় জাগ্রত তবুও


একটি প্রতিকী ছবি

 

_______________________________

ডা. জামান অ্যালেক্স

 

___________________

গত মঙ্গলবারের ঘটনা।স্থান- এক নিভৃত পল্লীর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।সময়- আনুমানিক রাত ৮ টা।আমার ইমার্জেন্সী নাইট ডিউটি চলছে। কিছুক্ষণ আগে এক পেশেন্ট ম্যানেজ করে হাসপাতালের গেইটে নীরবে দাঁড়িয়ে আছি।আধো আলো, আধো অন্ধকার, হালকা বৃষ্টিও পড়ছে, চমৎকার আবহাওয়া উপভোগ করছি।

--আপনি কি ডাক্তার জামান স্যার?
--( একটু চমকে উঠলাম) জ্বি, কিছু বলবেন?
--আমি মোসলেম, আমারে চিনছেন? ..

চেনার কোন সুযোগ নেই, আমার স্মৃতিশক্তি দূর্বল প্রকৃতির, নিজের আত্মীয় স্বজনের চেহারাও অনেক সময় ভুলে যাই।এ নিয়ে 'আমার নাক উঁচা' টাইপ কথাবার্তাও তাদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে, যদিও কথাটা সত্যি নয়।আধো অন্ধকারে তাই প্রশ্নকর্তাকে চেনার কথা না। ইতঃস্তত করে তাই সত্যি কথাটাই বললামঃ

--না, চিনতে পারি নাই, আমার মেমোরী খারাপ, আপনি আমাকে চেনেন কি?
--আপনে ঢাকা মেডিকেলে ছিলেন না?
--জ্বি, ছিলাম( কথা সত্য, ২০০৩ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেলে ছিলাম।২০০৯ পর্যন্ত ছাত্র হিসেবে, তারপর চিকিৎসক হিসেবে প্রায় ৫ বছর)
--আমি ২০৫ নাম্বার ওয়ার্ডে এ ভর্তি ছিলাম।বারান্দায় আপনে আমারে ড্রেসিং করতেন, মইরা যাওনের কথা ছিলো আমার....

আমি ক্যারিয়ার করছি মেডিসিনে, ড্রেসিং ঠিক আমার কাজ নয়।যেহেতু ড্রেসিং এর কথা বলছে তার মানে ইন্টার্নী পিরিয়ডের কথা।সার্জারীতে তখন আমার প্লেসমেন্ট ছিলো ২০৫ নং ওয়ার্ডে।২০০৯ সালের কথা!!! Holy cow!!!

কথা বেশীদূর আগাতে পারলাম না, ইমার্জেন্সীতে ততক্ষণে আরেক রোগী এসেছে।যাবার আগে বললেন, একটু আগে যে রোগীকে দেখলাম, তার আত্মীয় তিনি, বাড়ী পদ্মার ওপারে, তিনি আজও আমার প্রতি কৃতজ্ঞ.....

পরবর্তী রোগী ম্যানেজ করে ঠান্ডা বাতাসে হাঁটছি আর ঘটনাটা নিয়ে চিন্তা করছি।২০০৯ এ ইন্টার্নীতে আমার ফার্স্ট প্লেসমেন্ট ছিল সার্জারী ওয়ার্ডে।সিএ ছিলো ডাঃ শোভন ভাই, খুবই অ্যাকটিভ লোক, প্রতিদিন রাতে ওয়ার্ডে একটা চক্কর মারতেন।

প্রথম দিনই আমাকে ওয়ার্ডের বারান্দায় নিয়ে গিয়েছিলেন।গায়ে পচন ধরা রোগীগুলো এখানে থাকতো।দুর্গন্ধে আমার বমি আসার দশা।শোভন ভাই জানালেন, ড্রেসিংগুলো নিয়মিত আমাকেই করতে হবে, সিনিয়ররা নাকি এখানে খুব একটা পা মাড়ায় না। আমি একটু দমে গেলাম।তখনও প্ল্যান ছিলো--ক্যারিয়ার সার্জারীতে করবো, তাই ভয়াবহ দুর্গন্ধে দমে গেলেও নতুন উদ্যমে ড্রেসিং করা শুরু করলাম।

পভিসেপ সল্যুশন, কখনোও বা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, কখনোও বা হেক্সিসল এক হাতে, আর অন্য হাতে তখন থাকতো ফোরসেপস্, গজ্, কটন আর কিডনী ট্রে, আমার পিছনে থাকতো ওয়ার্ড বয় আনোয়ার ভাই, এই ছিলো নিত্যদিনকার রুটিন।

মনে পড়লো, অ্যাক্সিডেন্টের এক রোগীর কথা।বাম নিতম্বের মাংস উঠে গিয়ে পচন ধরেছিলো।একদিন অন্তর অন্তর ড্রেসিং করি, স্লাফ উঠতে উঠতে নিতম্বের মাংস বলে আর কিছু নেই।আমার স্পষ্ট মনে আছে- ফিমারের( পায়ের উপরের হাড়) ট্রোক্যান্টরও দেখা যেত। আমি আর আনোয়ার ভাই মিলে নাক চেপে ড্রেসিং করতাম।দুর্গন্ধের চোটে আস্তে আস্তে রোগীর স্ত্রীও উধাও হলো।রোগীর তখন "কোথাও কেউ নেই" অবস্থা।

সিএ শোভন ভাই অত্যন্ত কড়া লোক, রোগীর স্বার্থে গালিগালাজ করে ওয়ার্ড গরম করে রাখেন, যাতে ইনফেকশন রেট কম থাকে। ভাইও এই রোগীর সামনে এসে চুপ থাকেন।

দীর্ঘ দেড় মাস রোগীটিকে সেবা দেয়া হলো, রোগীর লোকজন উধাও, অ্যান্টিবায়োটিক লাগবে, কাজেই Poor fund থেকে তা ম্যানেজ করা হলো। আমরা যখন রোগীর আশা ছেড়ে দিলাম, রোগী তখন আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলো। আমরা আশান্বিত হয়ে Plastic Surgery তে নিয়ে Skin Graft ও করে নিয়ে আসলাম।মনে পড়ে Plastic Surgery তে(এখন যেখানে Burn Unit) এই রোগীর ট্রলিটিও আমি ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলাম।দীর্ঘ সময় পর রোগীটি একা একা বাড়ী ফিরে যায়। আমি বুঝতে পারলাম, রোগীটির নাম ছিলো মোসলেম.....

আমরা চিকিৎসকরা ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে থাকা একটি প্রজাতি।আমরা ম্যাজিস্ট্রেট দের মত কাউকে সাজা প্রদান করতে পারিনা, আমরা পুলিশের মত কোন লোককে জেলে পুরতে পারিনা, আমরা সচিবদের মত ক্ষমতা উপভোগ করতে পারি না, আমরা সাংবাদিকদের মত ' যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা'র মত যা ইচ্ছে তাই লিখে একটি প্রোফেশনকে ধ্বংস করতে পারিনা,আমরা কোন জনপ্রতিনিধিও নই--তবে আমরা আমাদের কর্মের মাধ্যমে মানুষের যতটা নিকটবর্তী হতে পারি, সে পরিমাণ নিকটবর্তী হবার ক্ষমতা নিয়ে অন্য কোন প্রোফেশনের জন্ম ঘটেনি।

ভাবতে পারেন, একজন লোক তার মস্তিস্কের গহীন কোণে আমাকে কিভাবে ঠাঁই দিয়ে রাখলে ৭-৮ বছর পর এক নিভৃত পল্লীর অন্ধকারে শারীরিক গঠনে পরিবর্তনের পরও ঠিকই আমাকে ঠাওর করতে পারেন? আমরা কি আসলেই ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করি? নাকি, আমরা যে ক্ষমতার বৃত্তে অবস্থান করি-তা জাগতিক ক্ষমতার বাইরে অতিজাগতিক কিছু?

অামার অনেক বন্ধু প্রায়ই আমাকে ডাক্তারদের নিয়ে ইনস্পায়ারিং কিছু লিখতে অনুরোধ করেন। আমি এড়িয়ে যাই।পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনায় ইনস্পায়ারিং কিছু লিখতে ভরসা পাই না।যারা অনুরোধ করেছিলেন, এই ইনস্পায়ারিং লেখাটা তাদের জন্য।আমি জানি, প্রতিটা ডাক্তারের জীবনে এরকম কোন না কোন ঘটনা রয়েছে। অন্ধকার সময়গুলোতে এই আলোকময় ঘটনাগুলো আমাদের অনুপ্ররণা যোগায়...

মানুষের উপর বিশ্বাস যখন তলানিতে পৌছে, তখন এমন কিছু আলোকীয় ঘটনার সম্মুখীন হই যে বিশ্বাস আবার ফেরত আসে। মিডিয়াগুলোতে যেভাবে আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হয়, যদি তার এক-দশমাংশও সত্য হতো(কিছু অবশ্যই সত্য), তবে বহুআগেই এদেশে স্বাস্থ্য সেবা কলাপ্স করতো।

যে পেপারে নিয়মিত ডাক্তারদের অপপ্রচার চলে, সে একই পেপারে খবর বের হয় আবুল বাজনদার( Extremely rare Tree man syndrome এ আক্রান্ত হয়ে DMCH এ ভর্তি ছিলেন, তার অসাধারণ সুন্দর শল্যচিকিৎসা এখানেই হয়) তার ছেলেকে চিকিৎসক বানাতে চান।হায়রে সাংবাদিকতা! তারা কিভাবে জানবে, মানুষের জন্য আমরা চিকিৎসকরা যে ভালোবাসার হাতটি প্রসারিত করি, যত অপপ্রচারই হোক, তা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এই মানুষদের নেই....

মার্টিন লুথার কিং, জুনিয়রের একটা উক্তি বলি--" Darkness cannot drive out darkness; only light can do that. Hate cannot drive out hate; only love can do that...."...... কথাটা চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। চিকিৎসকদের ঘৃণা করে কাঙ্খিত সেবা কি নিশ্চিত করা সম্ভব? Darkness cannot drive out darkness... গুটিকয়েক অন্ধকার জগতের এক্সপেরিয়েন্স থেকে লব্ধকৃত ঘৃণাকে দূরে ঠেলে আপনারা আমাদের ভালোবাসুন, কথা দিচ্ছি, ভালোবাসার ফেরিওয়ালা হয়ে হিজল ফুলের মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধ নিয়ে আমরা সবসময় আপনাদের পাশে থাকবো।

______________________________

 

লেখক ডা. জামান অ্যালেক্স। জনপ্রিয় কথাশিল্পী। ডাক্তার প্রতিদিনে তার লেখা লাখো পাঠক পড়ে থাকেন।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়