Ameen Qudir

Published:
2019-04-04 19:19:40 BdST

আমার জন্মের ১৩দিনের মাথায়ই মা মারা যান, তাই ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব


 

 


অধ্যাপক ডা. আ ন ম ফজলুল হক পাঠান
____________________________

১৯৫৬ সালে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার মোক্ষপুর গ্রামে এক স্কুল শিক্ষকের ঘরে আমার জন্ম।জন্মের মাত্র তেরো দিনের মাথায়ই আমার মা 'Puerperal Sepsis' এ মারা যান।মায়ের চেহারাটাও আমি মনে করতে পারি না,মনে থাকার কথাও নয়।তাই ছোটবেলা থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হব।

 

আমাদের গ্রামে তখন কোন ডাক্তার ছিল না। মোক্ষপুর গ্রামের মত প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক্তার পাওয়া যাবে ----- এমন ধারণা করাও সম্ভব হতো না তখন।কাউকে দেখে ডাক্তার হব কিংবা কাউকে আইডল মেনে আমি এই পেশায় আসি নি। মায়ের মৃত্যু, ডাক্তারবিহীন এলাকায় মানুষের সেবা করার মনোবাসনা থেকেই মনে ইচ্ছা জেগেছিল ডাক্তার হবো । অন্তত, গ্রামের মানুষগুলো শেষ সময়ে সান্ত্বনা শোনার জন্য হলেও যেন একজনকে পায় , অন্তিম প্রয়োজনে বিশ্বাস করার জন্য তাদের নিজেদের যেন কেউ থাকে ।

আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয় মোক্ষপুর হাই স্কুলে । সেখান থেকে ১৯৭৩ সালে তিনটি লেটার নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হই ময়মনসিংহ শহরের আনন্দমোহন কলেজে ।
পঁচাত্তর সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহে মাত্র সতেরো জন প্রথম বিভাগে উর্ত্তীন হয়েছিল । সেই সতেরো তরুণ জ্ঞানতুর্কির একজন হয়ে ভর্তি হই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। ১৯৭৬ সালে এই কলেজে প্রথম আসা , এখনো এখানেই রয়ে গেলাম । কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে, সাথে হাসপাতালের ICU এর ডিরেক্টর ।

আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৯৫ সালে। ১৯৯১ সালে অনেকটা জোর করে আমাকে এনেস্থিসিয়ায় পাঠানো হয় । তারপর ২০০৫ সালে ICU প্রতিষ্ঠার পর ২০০৯ সালে যোগ দেই হাসপাতালের ICU তে ।যেহেতু আমার মা মারা গিয়েছিলেন Sepsis এ তাই ICU তে যোগ দিয়েই আমি Sepsis এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি। আমার চেষ্টা ছিল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ICU কে দেশসেরা ICU তে রূপান্তর করার।অনেক চেষ্টা সাধনার পর ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি আমার স্বপ্ন পূরণ হয় । হাসপাতালের নতুন বিল্ডিং এ স্থানান্তর করি ICU , সাথে আমার হাতে গড়ে উঠে দেশসেরা এক ICU সেন্টার ।

এখানে আমরা ডাক্তারদের ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি, স্টুডেন্ট ও নার্সদেরও ট্রেনিং দিয়ে থাকি।অলরেডি স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় থেকে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশের যত সরকারী ICU আছে সেগুলোর শিক্ষক ও নার্সদের ট্রেনিং হবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ICU তে। এবং মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয় ইতোমধ্যে আমাদের ICU কে দশ শয্যা থেকে বিশ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন এবং এটি এখন প্রক্রিয়াধীন আছে।আমাদের জন্য এটা অবশ্যই অনেক গর্বের, অনেক আনন্দের একটি খবর।
.
ICU খুব কঠিন একটা জায়গা । জীবন সেখান স্থবির হয়ে গম্ভীর দাঁড়িয়ে থাকে । মৃত্যু করে আনাগোনা ।বাইরে দাঁড়ানো স্বজনদের উদ্বিগ্ন মুখ,অসহায় পায়চারি,সৃষ্টিকর্তার কাছে আকুতি, মৃত্যুর হৃদয়বিদারকতা আর জীবনের নতুন ঝিলিক সবকিছুর সাক্ষী হতে হয় নিয়মিত।
হরেক রকম মানুষের হরেক রকম ক্রিটিকাল কন্ডিশন। আমি দাঁড়িয়ে থাকি তাদের পাশে । চেষ্টা করে যাই সর্বোচ্চ।

ডাক্তারি একটা অনগোয়িং প্রসেস । একটা সাধনার ব্যাপার । যুদ্ধের ব্যাপার । মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ । যুদ্ধের অস্ত্র আমাদের জ্ঞান, আমাদের শিক্ষা ।অন্যের মৃত্যুর সাথে যুদ্ধের প্রত্যেকটিতে আমি জয়ী হতে চাই ।তাই আমাদের ICU এর মূলমন্ত্র হিসেবে নিয়েছি : "মোরা সবকটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি।"

সেই যুদ্ধে আপ টু ডেট থাকার জন্য আমি এখনো নিয়মিত রুটিন মেনে পড়াশোনা করি । হাসপাতাল থেকে ফিরে একাডেমিক বই নিয়ে বসি । জানতে চেষ্টা করি । নতুন জানা ছোট একটা ইনফরমেশনও পরবর্তীতে আমাকে সাহায্য করবে এমন বিশ্বাস নিয়ে পড়তে বসি ।
জ্ঞানের পিপাসা থেকে একাডেমিক বইয়ের বাইরেও পড়া হয় । বই পড়া অনেকটা নেশার মত । সাথে থাকে লো ভলিউম এর ননস্টপ রবীন্দ্র সংগীত । আমার জীবনের বিলাসিতা আর বিনোদন এই দুটোই ---- জ্ঞান সুধা আর সুর সুধা সাথে বিশ্বভ্রমণ।

 

নিজের গ্রামের মানুষের সেবা করার ইচ্ছা নিয়ে শুরু করেছিলাম পথচলা । সেই পথচলার সঙ্গী এখন সারা বাংলাদেশের মানুষের সেবা করা।
আমার জীবনদর্শন, জীবনের লক্ষ্য, জীবনের চূড়ান্ত ইচ্ছা ---- সবগুলোর উত্তর মানুষের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ।
'পরের কারণে স্বার্থ দিয়া দাও বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তারমত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।'

নতুন ডাক্তার, নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি আমার দিকনির্দেশনা থাকবে "Fight for life. You are the warrior of healer. Keep the death away & healing closer."
এমনভাবে শিখতে চেষ্টা করো যেন কারও শ্বাস আর লাশের মাঝে নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে জীবনের আলো জাগাতে পারো ।

একজন ডাক্তার জীবন দিতে পারেনা, চেষ্টা করতে পারে । অনেক চেষ্টার পরও অনেকে চলে যায় । খারাপ লাগে । মৃত মানুষটার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি । নীরবে সেই আত্মাকে অনুরোধ করি মায়ের কাছে বলার জন্য যে তার ছেলে কতখানি চেষ্টা করেছিল ।

মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা কোন মাকে সন্তানের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় ভাবি : কোন অলৌকিক ভাবে আমার মাকেও যদি ফিরে পেতাম !মা ফিরবেন না জানি , তবে আমি বিশ্বাস করি তিনি আমার পাশেই থাকেন সবসময় । 'যেথা আমি যাই নাকো,তুমি প্রকাশিত থাকো। '
______________________________

অধ্যাপক ডা. আ ন ম ফজলুল হক পাঠান । সদ্য প্রয়াত লোকসেবী চিকিৎসক।
মমেক-১৪
সাবেক অধ্যক্ষ , রংপুর মেডিকেল কলেজ।
সাবেক উপাধ্যক্ষ ,ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়