Ameen Qudir
Published:2019-04-02 06:30:25 BdST
যুক্তরাজ্যে নিউরোসার্জারির সর্বোচ্চ সম্মান পেলেন বাংলাদেশ বংশোদ্ভুত চিকিৎসক
ডেস্ক
_____________________
ব্রিটেনের সর্বোচ্চ নিউরোসার্জারি সম্মাননা সোসাইটি অব ব্রিটিশ নিউরোসার্জিক্যাল সার্জনসের (এসবিএনএস) পদকে ভূষিত হলেন প্রবাসী বাংলাদেশ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. টিপু আজিজ। গত ২১ মার্চ তাকে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়।
নিউরোসার্জারিতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি এ সম্মাননা পেলেন।
বলা হয়ে থাকে, খিচুনি,হাত পা ট্রেমর ও শক্ত হয়ে যাওয়া,কিছু কিছু ব্যথা ইত্যাদি রোগের উপযুক্ত চিকিৎসার বিশ্বের সেরা কারিগর ব্রিটিশ ডা টিপু আজিজ ।
‘যুক্তরাজ্যভিত্তিক অক্সফোর্ড ফাংকশনাল নিউরোসার্জারির’ প্রতিষ্ঠাতা প্রধান টিপু আজিজ ফাংকশনাল নিউরোসার্জারিতে নিজের অভিজ্ঞতার জন্য যুক্তরাজ্য এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন।
যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে অধ্যাপক অ্যালান ক্রসম্যানের অধীনে এমডি করা অধ্যাপক আজিজ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফাংশনাল নিউরোসার্জারি ইউনিটের’ সূচনা করেন।
সেখানে ক্লিনিক্যাল প্রাকটিসের পাশাপাশি গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এবং এ পর্যন্ত এক হাজার ৫০০টি নিউরোসার্জিক্যাল অপারেশন পরিচালনা করেছেন।
সিংগুলেট বিডিএস শুরুর মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা নিরাময়ের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে নেতৃত্বের আসন দখল করে আছেন ডা. টিপু আজিজ।
নিজের অর্জনের পাশাপাশি তিনি ২০টিরও বেশি পিএইচডি ডিগ্রির তত্ত্বাবধান করেছেন তিনি। তার এসব সহকর্মীর অনেকেই নিজ নিজ দেশে বিডিএস সেবা শুরু করেছেন। এবং অনেকে প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করছেন।
বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত এ চিকিৎসক বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ফাংকশনাল ইউনিট স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
নিজের কাজের এ সম্মানজনক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক আজিজ বলেন, ‘প্রথম নিউরোসার্জন হিসেবে আমি নির্বাচিত হয়েছি, এটি উল্লেখ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বেশিরভাগ কাজই আমি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছি। এবং আমি মনে করি, আমার পাশাপাশি এটি বিশ্ববিদ্যালয়েরও পুরস্কার। ’
পরিচয় ও অন্যান্য ----
টিপু আজিজের জন্ম ঢাকায়, ১৯৫৬ সালের ৯ নভেম্বর। বাবা মোহাম্মদ আবদুল আজিজ ও মা জাহেদা আজিজ। বাবা নিজেও ছিলেন একজন সুপরিচিত চিকিৎসক। তাঁর আবিষ্কার রিভার ব্লাইন্ডনেসের নিরাময় এখনো বিশ্বজুড়ে অনেক রোগীকে সেবা দিয়ে আসছে। টিপু আজিজের বয়স তখন মাত্র কয়েক মাস, বাবা তাঁর বড় বোন ও মাকে নিয়ে আমেরিকা আসেন। কারণ সে সময় তিনি ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটা থেকে পিএইচডি করছিলেন। সেখানে টিপু আজিজের ছোট বোন ও ছোট ভাইয়ের জন্ম। ১৯৬৩ সালে তাঁদের পরিবার পাকিস্তানের লাহোরে যায়। সেখানে পারিবারিক নানা জটিলতার কারণে তাঁর মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়। টিপু আজিজ বলেন, 'পরে মা আমাদের নিয়ে ১৯৬৫ সালে ঢাকায় চলে আসেন। মা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং ফিলোসফি নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকেন। তারপর আমরা সবাই ঢাকায় স্কুলে ভর্তি হই। সত্যি চমৎকার ছিল সে দিনগুলো। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন- সবাইকে নিয়ে বেশ আনন্দে কেটে যাচ্ছিল।' মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর পর ছেলেমেয়েদের উচ্চতর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে টিপু আজিজের মা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ব্রিটেনে পাড়ি জমান।
পারকিনসন্স ডিজিজে আগ্রহ
১৯৭৩ সালে অক্সফোর্ড কলেজে ভর্তি হন টিপু আজিজ। সেখান থেকে তিনি এ লেভেল পাস করেন। ১৯৭৫ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে বিএসসিতে ভর্তি হন। তখনই মূলত পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত পারকিনসন্স ডিজিজের ওপর আগ্রহী হন। এরপর ১৯৭৮ সালে তিনি কিংস কলেজ থেকে এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করেন। বিষয় মেডিসিন। এই পড়াশোনাকালেও পারকিনসন্স ডিজিজের বিষয়টি মনের ভেতর জিইয়ে রাখেন। পরে এ নিয়ে গবেষণার জন্য ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে এ বিষয়ে পিএইচডি করেন ও পারকিনসোনিয়ান রোগগ্রস্ত বানরকে তাঁর গবেষণায় কাজে লাগান। আর আবিষ্কার করেন কিভাবে আরো উন্নততর পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম অঞ্চল- অর্থাৎ সাবথ্যালামিক নিউক্লিয়াসে (এসটিএন) ইলেকট্রোড ব্যবহার করে দায়ী কোষকে নষ্ট করে রোগটি নিরাময় করা যায়। পরে এরই হাত ধরে ফ্রান্সের কিছু বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন যে মস্তিষ্কে দায়ী কোষগুলো নষ্ট না করে শুধু ইলেকট্রোড দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে এই রোগের নিরাময় করা যায়।
টিপু আজিজ তাঁর গবেষণালব্ধ ট্রেনিং শেষ করে উদ্যোগী হন নিজেই কিছু করার। সে সময় তাঁর পরিচিত চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে কেউ পারকিনসন্স রোগ নিয়ে তেমন উৎসাহী ছিলেন না। তবে তিনি উৎসাহ হারাননি। পাশে পান একজনকে। অক্সফোর্ডের ক্রিস্টোফার এডামস এ ব্যাপারে উৎসাহী হন এবং তিনি ১৯৯২ সালে পরিবারসমেত অক্সফোর্ডে এসে যোগদান করেন। তারপর টিপু আজিজ তাঁর ডক্টরেট রিসার্চে যে অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তার সবটাই ঢেলে দিয়ে পারকিনসন্স রোগের নিরাময়ে নিরলস পরিশ্রম করতে শুরু করেন।
'ফাইট ফর ফেলিক্স'
একটি সাত বছর বয়সের পারকিনসোনিয়ান বানরকে গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করেন আজিজ। বানরটির নাম দেন ফেলিক্স। যার লাতিন অর্থ হ্যাপি, অর্থাৎ সুখী। টিপু আজিজ বানরটি নিয়ে তখন প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছিলেন। ইলেকট্রোড ব্যবহার করে মস্তিষ্কের ক্ষতিগ্রস্ত সূক্ষ্ম অঞ্চল অর্থাৎ যার কারণে রোগটি বিস্তৃতি লাভ করে, সেটি ধ্বংস করে ফেলার প্রক্রিয়ার সাফল্যের কাছাকাছি চলে যান। যাকে বলা হয় ডিপ ব্রেইন স্টিমিউলেশন। তখনই ব্যাপারটা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। কেননা ব্রিটেনে তখন এনিম্যাল টেস্টিং- অর্থাৎ কোনো গবেষণা প্রকল্পে অস্ত্রোপচারের লক্ষ্যে বন্য প্রাণীর ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। টিপু আজিজের এক সহকর্মী এই তথ্য প্রাণী অধিকার সংস্থাকে জানিয়ে দিলে সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে 'ফাইট ফর ফেলিক্স' স্লোগান নিয়ে। এক বৃদ্ধা তো তার চারপাশে খাঁচা বানিয়ে ফেলিঙ্কে বাঁচানোর জন্য রাস্তায় রীতিমতো অনশন শুরু করেন! শুরু হয় এনিম্যাল টেস্টিং নিয়ে বাদানুবাদ। বিবিসিতে টিপু আজিজ ও তাঁর ফেলিক্সবিষয়ক পর্ব প্রচার হতে থাকে 'মাংকিস, র্যাটস অ্যান্ড মি' শিরোনামে। পত্রিকাগুলোতে চলে ঝড়। কেউ কেউ এর তীব্র সমালোচনা করেন- 'ফেলিক্স তার অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে আর দেখা করতে পারবে না, নানা ড্রাগ দিয়ে তার ওপর পরীক্ষা করা হবে, এমনকি ড্রাগের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক মৃত্যুও অসম্ভব কিছু নয়। এটা আইন পরিপন্থী।' আবার অন্যরা বলেন, 'পাচারকারীরা হাজার হাজার বানর নিমেষে শেষ করে দিচ্ছে, তাদের নিয়ে কেন প্রাণী অধিকার সংস্থাগুলো বাড়াবাড়ি করছে না? সেখানে মানব সভ্যতার উন্নয়নে কয়েকটা বানর ব্যবহার হলে ক্ষতি কী?'
কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিপু আজিজেরই জয় হয়। তিনি প্রমাণ করে দেন, এনিম্যাল টেস্টিংয়ের বিপরীতে যারা শোভাযাত্রা বের করে, প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে তাঁর গবেষণাকে বন্ধ করতে উদ্যত হয়েছিল, যারা তাঁর গাড়ি ও তাঁর অক্সফোর্ডের বাড়িতেও আক্রমণ করেছিল তারাই কিন্তু প্রয়োজনে একসময় সাহায্য নেবে ডিপ ব্রেইন স্টিমিউলেশনের কাছে। কেননা বিশ্বের চিকিৎসাশাস্ত্রের ইতিহাসে যত অভিনব আবিষ্কার হয়েছে, তার অধিকাংশই এনিম্যাল টেস্টিং- অর্থাৎ প্রাণীসংক্রান্ত গবেষণার ফল। টিপু আজিজের সফল গবেষণাও পারকিনসন্স ডিজিজের নিরাময়ে এনে দিয়েছে ভিন্ন এক নতুন মাত্রা।
গবেষণায় কেন বানর
কিছু প্রাণী আছে, যেগুলোর সঙ্গে মানবদেহের বিভিন্ন অংশের চমৎকার মিল রয়েছে। যেমন- জিনগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে ইঁদুরের সঙ্গে মানুষের মিল রয়েছে, আবার স্নায়ুগত দিক থেকে বানরের সঙ্গে। যে কারণে পারকিনসন্স রোগের সব বৈশিষ্ট্য ও অনুষঙ্গ হুবহু মানুষের মতোই একটি বানরের মধ্যেও প্রকাশ পায়। আর সে কারণেই স্নায়ুজনিত গবেষণার জন্য বানরকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বুদ্ধিমত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। কুকুর কিংবা বিড়ালের চেয়ে বানরের বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি। গবেষণার পর বানরটির বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা ও আচরণ বিশ্লেষণ করে নির্ণয় করা হয়, গৃহীত প্রকল্পটি কতটা অগ্রসর হয়েছে।
স্নায়ুতন্ত্রজনিত রোগ পারকিনসন্স ডিজিজ নিরাময়ে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি অন্যান্য জটিল স্নায়ুুরোগ যেমন- স্পাসমোডিক টর্টিকোলিস, মাল্টিপল স্ক্যালেরোসিসের নিরাময়ে খ্যাতি অর্জন করেন টিপু আজিজ। ২০ বছরের গবেষণাজীবনে তিনি প্রায় ৩০টি বানরকে গবেষণার বিভিন্ন পর্যায়ে কাজে লাগিয়েছেন।
এনিম্যাল টেস্টিং
এনিম্যাল টেস্টিং নিয়ে এনিম্যাল রাইটস গ্রুপগুলো বাড়াবাড়ি করলেও একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে, পৃথিবীর ইতিহাসে বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে যতগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়েছে, তার অনেকটাই এই এনিম্যাল টেস্টিংয়ের ফল। ১৮০০ সালে প্রাণী গবেষণাই এনে দিয়েছিল জলবসন্ত, র্যাবিস ও অ্যানথ্রাক্সের মতো মারাত্মক রোগের প্রতিষেধক। এ ছাড়া ১৯১০ থেকে ১৯৩০ সালে প্রাণীর ওপর গবেষণার ফসল হিসেবে টিটেনাস কিংবা ডিপথেরিয়ার ভ্যাকসিন এবং আধুনিক অ্যানেসথেসিয়ার ধারণাও ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। এ ছাড়া একটি বিখ্যাত আবিষ্কার পেনিসিলিন, যা পরে মানুষকে এন্টিবায়োটিকের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছিল, তাও কিন্তু একটি ইঁদুরের ওপর গবেষণার ফল।
মূলত এই এনিম্যাল টেস্টিংই ক্রমে গবেষকদের সহায়তা করে চলেছে নতুন নতুন মেডিক্যাল সমস্যার সমাধান করতে। ২০০৮ সালে তিন বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার অর্জন করে এইচআইভি ভাইরাস এবং এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ভাইরাস এইচপিভি- অর্থাৎ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস নির্ণয়ে। আর এসবই কিন্তু সম্ভব হয়েছে একটি কুকুর, খরগোশ ও গরুর ওপর গবেষণার ফসল হিসেবে। এরই হাত ধরে বানরের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে সাফল্য সূচিত হয়েছে মস্তিষ্কের সাবথ্যালামিক নিউক্লিয়াসের ডিপ ব্রেইন স্টিমিউলেশন, যা একটি পারকিনসন্স রোগগ্রস্ত রোগীকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য কাঁপুনি ও ব্যথার হাত থেকে রক্ষা করে।
সম্মাননা
সাম্প্রতিক পুরস্কার ছাড়াও টিপু অর্জন করেছেন ষষ্ঠ ফিলিপ গিলডেনবার্গ লেকচারশিপ ইন ফাংশনাল নিউরো সার্জারি পুরস্কার। ডা. ফিলিপ গিলডেনবার্গের নামানুসারে করা হয় এ পুরস্কারের নামকরণ। কেননা তিনি হলেন স্টেরিওটেকটিক নিউরো সার্জারির পথিকৃৎ। পাশাপাশি ব্রিটিশ-বাংলাদেশ পাওয়ার হান্ড্রেডে উঠে এসেছে এই কৃতী চিকিৎসাবিজ্ঞানীর নাম।
আপনার মতামত দিন: