Ameen Qudir

Published:
2019-04-01 20:30:12 BdST

লিভার বা যকৃৎ প্রায় ৫০০ রকম কাজ করে সারাদিন, নিশিদিন: যত্নে সহায় , অযত্নে হায় হায়


 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
__________________________________

শরীরের নাম মহাশয় , যা সহাইবে তাহাই সহে, এমনটি পুরোপুরি সত্যি নয় কিন্তু। কিছুদূর বা বহুদূর অবধি সত্যি। তারপরে আর নয়।
আমাদের পেটের ডানদিক জুড়ে, ওপর দিক বরাবর, আছে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যার নাম লাতিনে এপাতিয়া (Hepatia) ,ইংরেজি তে লিভার, বাংলায় যকৃৎ। এই অবধি প্রায় সব্বাই জানেন।

তদুপরি, এই অঙ্গ এত গুরুত্বপূর্ণ যে এর নারীপুরুষ, শিশুবৃদ্ধ ভেদ অবধি নেই। তৃতীয় বা চতুর্থ লিঙ্গে ও এই অঙ্গ সঙ্গে থাকবেই।

আজ্ঞে, মাত্র প্রায় ৫০০ রকম কাজ করে এ। সারাদিন, নিশিদিন। সব উৎপাত কে চিৎপাত করার মূল দায়িত্ব ও এর।

একগুচ্ছ হরমোন, উৎসেচক তৈরী ছাড়াও, রক্ত পরিশোধনের দায়িত্ব ও দায়িত্বশীল এপাতিয়া ( Hepatia) নিজেই নেয়। নাহ, মনের বিষ বা হিংসা, দ্বন্দ্ব, ঘৃণা ইত্যাদি পরিশোধনে র দায় এর নেই। বিমূর্ত বস্তুর পরিশোধন ভারি শক্ত ও বটে।

তাই, এ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, স্নেহশীল অভিভাবকদের মতো কিছুটি বুঝতে দেয় না প্রথমে। বোঝা যায়, যখন এ নিজেই ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়ে।
তাও কিনা নিজেকে অনেকদূর অবধি পরিবর্তন ও পরিশোধন করে নেওয়ার ক্ষমতা ও এ রাখে বৈকি।
আমরা অসভ্য ( না, না সভ্য) হওয়ার পরে প্রচুর অত্যাচার করি নিজেদের শরীরে। প্রচুর ফ্রুক্টোজ , কখনো অ্যালকোহল বা সুরা, বিভিন্ন কদর্য কৃত্রিম চর্বি ( মার্জারিন ও হাইড্রোজেনেটেড ফ্যাট বা বনস্পতি) , বিভিন্ন কীটনাশক, প্রিজারভেটিভ, নানা OTC ওষুধ, রাসায়নিক রং, জলদূষণ , বায়ুদূষণ, আারো কতো সাত সতেরো।
তবে কিনা আমাদের বাঁচাতে বাঁচাতে সে বেচারি ও চর্বিতে ভর্তি , বৃহদাকার হয়ে পড়ে বৈকি!
তখনি গোলমালের শুরু।

জমা চর্বি ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কে আটকে দেয়। এরি নাম, ইনসুলিন রেজিস্টেন্স। এদিকে প্যাংক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় সেটি না বুঝতে পেরে, কাজ হচ্ছে না বলে আরো বেশি বেশি ইনসুলিন তৈরী করতে থাকে, বাড়তে থাকে রক্তে ইনসুলিনের মাত্রা।
অকারণ?

নাহ। আমরা সভ্য হয়ে যে সারাদিনমান, সুক্রোজ বা চিনি খেয়েই চলেছি। বার বার, জেনে বা না জেনে। সেই সুক্রোজ আসলে অর্ধেক ফ্রুক্টোজ আর অর্ধেক গ্লুকোজ। গ্লুকোজ কে ব্যবহার করতে ইনসুলিন যে অপরিহার্য।
তাই - ই।

আর ফ্রুক্টোজ? ফ্রুক্টোজ আদতে স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতিতে আছে, আছে বিভিন্ন মিষ্টি স্বাদের ফলে।
আর অস্বাভাবিকভাবে বা কৃত্রিম ভাবে আছে, মিষ্টিতে, আইসক্রিমে, বিভিন্ন প্রিজারভেটিভ হিসেবে প্রায় সব অন্যুন ( মানে, ইয়ে নোনতা নয় এমন) সব খাদ্যেই। প্রসঙ্গতঃ, নুন বা লবণ ও খুব ভালো ও অনেক কম ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভ, কিন্তু সর্বত্র এর প্রয়োগ করা যায় না, স্বাদ বা বিস্বাদের কারণে। সেই সব জায়গায় চিনি ই।
এই দুই ই জলে দ্রবীভূত হয় অতি সহজে। সেটাও বিরাট সুবিধাজনক।

তা, আমাদের যকৃৎ ২৪ ঘন্টায় প্রায় ২০ গ্রাম ফ্রুক্টোজ কে ' ম্যানেজ ' করতে পারে, তার বেশি আর নয়। আমাদের মানবশরীরের এত দীর্ঘ দিনের ( কয়েক লক্ষ বছর) অভিযোজনের ফল আর কি! কিন্তু এর পরে সে অক্ষম।
এর বেশি হলে সে সরাসরি চর্বি হয়ে লিভারে জমা পড়ে। যতো চর্বি জমা, ততো লিভারের কাজের কোষ কমে আসছে, এরই নাম ফ্যাটি লিভার।

এই আসলে ডায়াবেটিস ও স্থূলতার পথিকৃৎ।

অ্যালকোহলের ২০% মস্তিষ্কের কোষে পৌঁছয়, যাতে রাজা রাজা বা রাণী রাণী লাগে। কিন্তু তাকেও বিদেয় করতে হয় লিভার কেই। এক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়ে অনেকাংশেই সে ঘামে, শ্বাসে, মূত্রে ( রক্তে মেশে কিনা) বেরিয়ে যায়, বাকি সেই চর্বি হয়ে লিভারে জমা হয়।

চিনি আরো ভয়ংকর এই কারণে যে, এর ১০০% ই লিভারে চর্বি হিসেবে জমা হয়, রক্তে একটুও মেশে না, তাই মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না। খেয়েই চলে, খেয়েই চলে -- ক্ষয়েই চলে ক্ষয়েই চলে লিভার।

চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী রা আবিষ্কার করে ফেলেছেন যে যদি রক্তে HbA1c র মাত্রা ৫.৭% ছাড়ায়, তখনই লিভারে চর্বির ভান্ড পূর্ণ হয়েছে বা ইনসুলিন রেজিস্টেন্স আরম্ভ হয়ে গেছে, এবং সেই মানুষ টিকে Pre diabetic বলা হয়, আর ৬.৫% ছাড়ালে তিনি / সে Diabetic.

ধুসস । যতো বাজে কথা। আমার অসুবিধে নেইকো, আর আমি টাকা দিয়ে রক্ত পরীক্ষা করবো? পাগল নাকি আমি? আলু থেকে সোনার মেশিন আছে নাকি আমার, বা আছে নাকি টাকা ছাপানো কল! ইল্লি আর কি? সব তলায় তলায় ষড় আচে, আমরা বুঝিনে বুঝি!! দিব্যি দু পয়সা রোজগার করে ভালোমন্দ খেয়ে চকচকে চেহারা নিয়ে আনন্দে আছি, সিরিয়াল দেখছি, জি সারেগামা দেখছি, ভোট রঙ্গ দিব্যি লাগছে আর খামোখা রক্ত পরীক্ষা। ঈসস। কত কষ্ট করে এক ফোঁটা রক্ত হয়। ( আসলে মহাশয় / মহাশয়া, সঅব রক্ত ই নষ্ট হয়ে নতুন হয় ৭৫ - ৯০ দিনের পরে)।

বাদ দিন। তা সুক্রোজ আর অ্যালকোহলের জন্যে লিভারে জমা চর্বি একই ক্ষতি করে কিন্তু। তবে ফ্রুক্টোজের ক্ষতি টি একটু বেশি ই।

এই ইনসুলিন রেজিস্টেন্স থেকে রক্তে বেড়ে যাওয়া ইনসুলিনের মাত্রা থেকেই উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, স্থূলতা, PCOD, এমনকি ক্যানসার কেও আমন্ত্রণ করে ডেকে আনতে পারে।

নিরাময় -- যা যা কারণ, তার বিপ্রতীপ টি।
কার্ব ( বিশেষত ফ্রুক্টোজ কম করা) , অ্যালকোহল গ্রহণ না করা, কৃত্রিম চর্বি বন্ধ করে শুধুই প্রাকৃতিক চর্বি( ঘি মাখন, চীজ, ক্ষীর, নারকেল তেল, অলিভ তেল, পাকা নারকেলের শাঁস, কাজুবাদাম, আখরোট, আমন্ড, চীনা বাদাম, প্রাণীজ বা মাছের বা পাখিদের শরীরের চর্বি) গ্রহণ, প্রোটিন গ্রহণ , বারে কম খাদ্য গ্রহণ , যাতে
খালিপেট থাকাকালীন ইনসুলিনের ক্ষরণ কম হয়। যতো কম করা যায়, ততো মঙ্গল।

কারণ ইনসুলিন আমাদের দেহে একমাত্র হরমোন যা চর্বি জমতে সোজাসুজি সাহায্য করে। এর আরেক নাম স্টোরেজ হরমোন।

আমাদের এপাতিয়া ( Hepatia) কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পূর্বকার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে, যদি না ক্ষতি হয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র টি ই বরবাদ বা নষ্ট না হয়ে থাকে।

পছন্দ নিজের নিজের।।
___________________________

 

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়