Ameen Qudir
Published:2019-03-30 20:44:25 BdST
মেডিকেলে যে যৌন বিষয় প্রথম জেনে বিব্রত হতাম, তা এখন স্কুলেই পড়ানো হচ্ছে ! বাহ!
ডা. সালাহউদ্দিন আহমেদ তরূণ
_____________________
অবহেলিত , দুর্ভাগ্যের আগুনে পোড়া বাংলাদেশে যখন কোন ভাল খবর শুনি , গর্বে আনন্দে মন ভরে যায় সুদুর সাত সমুদ্র তের নদীর তেপান্তরের আমেরিকায় বসেও।
বিবিসি বাংলার কল্যাণে খবরটি জানা। একটা ভিডিও দেখেছি। দেখে অবাক হয়েছি, এই আমার চির চেনা , ছেড়ে আসা বাংলাদেশ।
স্মৃতির ভান্ডারে মনে পড়ে যায় মেডিকেল কলেজের দিন গুলোর কথা। ঢাকা মেডিকেলে সেই নব্বইয়ের শেষের দিকে প্রথম ক্লাস গুলোর কথা।
মেডিকেল ক্লাসে শারীরবৃত্তিয় নানা টার্ম প্রথম যখন শুনি , কেমন লজ্জ্বায় নেতিয়ে পড়া। মেয়ে ক্লাসমেটদের লজ্জ্বা। অস্বস্তি।
ছোটবেলা থেকে শুনে বড় হয়েছি, মেয়েরা ১৬ - ১৭ বছরে কি ১৩-১৪ বছরেই নাকি পেকে যায়। সেক্স টেক্স সব নাকি বুঝে যায়। মেয়েরা খুব খারাপ। আর সঙ্গে যে মেয়েগুলো , তারা তো আরও বুড়ি।
কিন্তু সেই সব ক্লাসে দেখতাম মেয়ে বুড়িগুলোও সেক্স মেডিকেল টার্ম বা বা বিবরণ শুনে কেমন বিব্রত হত। পড়ে জানলাম, এসব মেয়েদের জানা নেই ভাল করে।
কো এডুকেশন প্রথম প্রথম বেশ বিব্রতই করত। স্যাররা সহজেই পড়াতেন। সেক্স মেডিকেল টার্ম বলতে তাদের মুখে কোন সমস্যা দেখি নি। এক স্যার তো দেখেছি, মেয়েদের দিকে তাকিয়েই বলতেন বেশী। ক্লাসেই তিনি মেয়েদের বলতেন , তোমাদের বলছি। বিব্রত হচ্ছো কেন। এটা হিউম্যান বডি। ডাক্তার হিউম্যান বডি নিয়ে কাজ করবেই। তোমরা বিব্রত হলে মানুষের দেহ দেখে কাজ করবে কেমন করে। তাই আমি তোমাদের লজ্জ্বাটা জয় করতে বলব ডাক্তারিরর স্বার্থেই।
স্যারের এসব প্রগতিশীল কথা শুনে খুব অবাক হতাম। এসব স্যার না থাকলে বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষা এতদূর আসতোই না।
সেই দেবদূতসম স্যাররা চেয়েছেন বলেই বাংলাদেশ এগচ্ছে।
তাই আজ বাংলাদেশে শত প্রতিবন্ধক স্বত্ত্বেও স্কুল পর্যায়ে সেক্স এডুকেশন চালু হচ্ছে। পাইলট প্রজেক্ট পুর্ণ সফল।
এটা দরকার ছিল।
স্কুলে যৌন শিক্ষা: বাংলাদেশে ‘জেনারেশন ব্রেকথ্রু’ প্রকল্পের ক্লাসরুমে যা পড়ানো হচ্ছে রিপোর্টে
আহ্রার হোসেন
বিবিসি বাংলা, ঢাকার সাংবাদিক যা জানাচ্ছেন তা পড়ে আমি মুগ্ধ। তিনি বলছেন ,
বাংলাদেশের সাড়ে তিনশ বিদ্যালয়ে গত ৫ বছর ধরে পড়ানো হচ্ছে একটি কোর্স, যেটি অনেকটা পশ্চিমা দেশগুলোর বিদ্যালয়ের সেক্স এডুকেশন বা যৌন শিক্ষা কোর্সের আদলে সাজানো।
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় মাসিক, স্বপ্নদোষ, কনডম ইত্যাদি শব্দকে নিষিদ্ধ জ্ঞান করা হয়। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দরের কাছে আশকোনা এলাকার একটি বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমেই এসব শব্দ নিয়ে অবলীলায় আলোচনা করছে।
তারা বয়ঃসন্ধিকালীন এসব অবশ্যম্ভাবী ইস্যুগুলো সম্পর্কে জানছে। তারা শিখছে প্রজননস্বাস্থ্যের নানা দিক। যৌনবাহিত এবং যৌনাঙ্গবাহিত রোগ সম্পর্কে অবহিত হচ্ছে। শিখছে এসব রোগ থেকে দূরে থাকার উপায়।
এই প্রশিক্ষণের জন্য তারা সাহায্য নিচ্ছে নানা রকম কম্পিউটার গেম এবং লুডো ও মনোপলির মতো দুটি বোর্ড গেমের। সেই সঙ্গে ক্লাস লেকচার তো রয়েছেই।
আশকোনার এই বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কিশোর কিশোরী কর্নারে আমি যেদিন যাই, সেদিন তাদের পড়ানো হচ্ছিল বাল্যবিবাহ নিয়ে। বাল্যবিবাহ নিরোধ নিয়ে শিশুরা একটি নাটিকার মহড়া করছে শিক্ষার্থীরা, আমাকে সেটিও তারা দেখালো।
এই বিদ্যালয়ের একটি বিশেষ শ্রেণীকক্ষে গত ৫ বছর ধরে এসব শিখছে বিদ্যালয়টি ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীরা।
বাংলাদেশ সরকারের 'জেনারেশন ব্রেকথ্রু' নামের একটি প্রকল্পের আওতায় এই শ্রেণীকক্ষটি তৈরি হয়েছে। কক্ষটির নাম দেয়া হয়েছে 'কিশোর কিশোরী কর্নার'। আর এখানে তারা পড়ছে 'জেমস' নামে একটি কোর্স যেটির পূর্ণরূপ দাঁড়ায় 'জেন্ডার ইকুয়িটি মুভমেন্ট ইন স্কুলস'।
কোর্সটি অনেকটা পশ্চিমা দেশগুলোর বিদ্যালয়ে পড়ানো সেক্স এডুকেশন বা যৌন শিক্ষার আদলে সাজানো।
যদিও সংশ্লিষ্টরা এই কোর্সকে যৌন শিক্ষা বলতে নারাজ।
এই কোর্সটি সাজানো হয়েছে 'আমার জেমস ডায়েরি' নামের একটি বই, সাতটি কম্পিউটার গেমস, দুটি বোর্ড গেম, একটি এনিমেশন ভিডিও আর একশোটি পর্বের রেডিও ধারাবাহিক দিয়ে।
ক্লাসে পড়ানোর জন্য শিক্ষকদের দেয়া হয়েছে বিশেষ প্রশিক্ষণ।
দুই বছরের এই কোর্সে যোগ দিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থী যেসব বিষয় সম্পর্কে জানছে:
জেন্ডার সমতা
বাল্যবিবাহ
মাসিক রজঃস্রাব
স্বপ্নদোষ
বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন
শারীরিক ও যৌন সহিংসতা
যৌনবাহিত রোগ
জননাঙ্গবাহিত রোগ
জেনারেশন ব্রেকথ্রু: কী আসলে?
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে বিদ্যালয়গুলোতে যৌনশিক্ষা দেবার চেষ্টা বহু বছর থেকেই করা হচ্ছে, কিন্তু যৌন বিষয় নিয়ে সামাজিক ট্যাবুর কারণে এটা সফল করা যায়নি কখনো।
এমনকি পাঠ্যপুস্তকে যৌন শিক্ষা বিষয়ক অধ্যায় জুড়ে দেবার পরও দেখা গেছে শ্রেণীকক্ষে সেসব অধ্যায় শিক্ষকেরা পড়াচ্ছেন না। শিক্ষার্থীদেরকে বাড়িতে গিয়ে এসব অধ্যায় পড়বার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
আর অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে অভিভাবকেরা বইয়ের সেসব অধ্যায় স্টাপলিং করে আটকে দিচ্ছে, যাতে অধ্যায়গুলো শিক্ষার্থীদের নজরে না পড়ে।
ফলে বিদেশী দাতাদের অর্থায়নে ২০১৪ সালে যখন ৫ বছর মেয়াদী জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পটি শুরু হয় বাংলাদেশের চারটি জেলার তিনশো ৫০টি বিদ্যালয়ে, তখন তারা এই ট্যাবুর বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন।
এই প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলছেন, প্রকল্পটি শুরু করতে গিয়ে স্কুলগুলো থেকে বাধা আসবে বলে আশঙ্কা করেছিলেন তারা।
কিন্তু বাধা যতটুকু এসেছে তা ঢাকার বিদ্যালয়গুলো থেকে। মফস্বলের বিদ্যালয়গুলো থেকে কোন বাধা আসেনি।
চার জেলার সাড়ে তিনশ স্কুলে পাইলট আকারে চালানো হয় ৫ বছরের 'জেনারেশন ব্রেকথ্রু' প্রকল্প। এসব স্কুলের মধ্যে ছিল ৫০টি মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কোর্সটিকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছে। এমনকি প্রকল্পে যে ৫০টি মাদ্রাসাকে যুক্ত করা হয়েছিল, সেখান থেকে এসেছিল অভূতপূর্ব ইতিবাচক সাড়া।
ড. হোসেন বলছেন, 'বাস্তবে দেখা গেল মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা এ বিষয়ে অনেক অগ্রসর'।
সাফল্য এলো কি?
প্রকল্পের মেয়াদের পাঁচ বছর শেষে এসে দেখা যে বিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়টি পড়ানো হচ্ছে সেখানকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যাচ্ছে যেসব বিদ্যালয়ে এই বিষয়টি পড়ানো হয়না, সেখানকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক ছাত্র আমাকে বলছিল, "আমার অন্যান্য স্কুলের যেসব বন্ধু আছে তারা এইসব শব্দ শুনলে অনেক লজ্জা পায়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আর এসব হয় না।"
অষ্টম শ্রেণীর একজন ছাত্রী বলছিল, "প্রথম প্রথম আমি নিজেও এইসব ব্যাপারে অনেক সংকীর্ণ ছিলাম। যেসব বিষয় আমি আমার মা কিংবা বন্ধুদেরকে বলতে পারতাম না, পরামর্শ চাইতে পারতাম না, এখন অবলীলায় তা পারি।"
প্রকল্পে যে ৫০টি মাদ্রাসাকে যুক্ত করা হয়েছিল, সেখান থেকে এসেছিল অভূতপূর্ব ইতিবাচক সাড়া।
'জেমস ক্লাস করবার পর আমরা অনেক বেশী ফ্রি হয়ে গেছি', বলছিল সপ্তম শ্রেণীর আরেক ছাত্রী।
যেসব শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই জেনারেশন ব্রেকথ্রুর ক্লাসরুমে পাঠানো হয়েছিল, তারাও শুরুর দিকে জড়সড় হয়ে থাকতেন।
"আমাদের নিজেদের ভেতরেই একটা জড়তা ছিল। সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে আমাদের কিন্তু সময় লেগেছে। সেক্স বিষয়ক কোন শব্দ আলোচনায় এলে বাচ্চার লজ্জা পেত," বলছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মঞ্জুয়ারা খাতুন।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরো উলটে গেছে, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমাকে বললেন তিনি।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর একজন ছাত্রী বলছিল, 'প্রথম প্রথম আমি নিজেও এইসব ব্যাপারে অনেক সংকীর্ণ ছিলাম। যেসব বিষয় আমি আমার মা কিংবা বন্ধুদেরকে বলতে পারতাম না, পরামর্শ চাইতে পারতাম না, এখন অবলীলায় তা পারি।'
কোর্সটি পড়ানো কি বন্ধ হয়ে যাবে?
জেনারেশন ব্রেকথ্রু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০১৮ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই। যদিও অনেক বিদ্যালয়ে কোর্সটি পড়ানো অব্যাহত আছে, বিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের যোগাযোগও বন্ধ হয়নি, কিন্তু কাগজে কলমে প্রকল্পটি শেষ।
তাহলে কি বিদ্যালয়গুলোতে যৌন শিক্ষা প্রদানের নতুন এই পদ্ধতিটি বন্ধ হয়ে যাবে?
ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলছেন, তারা অচিরেই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করতে যাচ্ছেন। সেখানে বিদ্যমান সাড়ে তিনশো বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করা হবে আরো দুশোটি বিদ্যালয়।
আর পর্যায়ক্রমে এই কোর্সটিকে অবশ্যপাঠ্য করার পরিকল্পনা রয়েছে বাংলাদেশের সব বিদ্যালয়ে, অবশ্য এখন পর্যন্ত এর সবই রয়েছে আলোচনা পর্যায়ে।
বিদেশী দাতাদের অর্থায়নে বাংলাদেশের কিছু বিদ্যালয়ে ২০১৪ সাল থেকেই সেক্স এডুকেশন চালু হয়েছিল। এ সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট বিবিসি তে এলো। কিছু তথাকথিত মুক্তমনাদেরকে এই নিউজ বেশ আনন্দের সাথে ফেসবুকে শেয়ার করতেও দেখলাম। সেক্স এডুকেশনের নামে স্কুলগুলোতে যৌনতা ছড়িয়ে দিলে তাদের চেয়ে আনন্দিত আর কে হতে পারে??
তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, মহৎ উদ্দেশ্যে এটি চালু করা হয়েছিল। যাতে করে শিক্ষার্থীরা তাদের অজানা বিষয়গুলো অল্প বয়সেই জানতে পেরে সচেতন হতে পারে। কিন্তু কোনো কাজের উদ্দেশ্য মহৎ হওয়াই শেষ কথা নয়। সেই কাজ সঠিক উপায়ে সম্পন্ন করার উপরই তার ফলাফল বহুলাংশে নির্ভর করে।
____________________________
ডা. সালাহউদ্দিন আহমেদ তরূণ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী।
আপনার মতামত দিন: