Ameen Qudir

Published:
2019-03-19 00:07:52 BdST

৪ মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করবেনই : এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় ২০ ঘন্টা কঠিন শ্রম দেন পিতা


 

 

ডা. সোলায়মান আহসান সুজন
_________________________

দৃশ্যটা দেখে চোখে জল ধরে রাখতে পারি নি।
প্রায় মধ্যরাতে রাজধানীর ফার্মগেট পদচারী সেতু বা ফুট ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ চোখ গেল এক মরিচ বিক্রেতার দিকে। কয়েক ডজন বোম্বাই মরিচ নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন তিনি। ক্লান্ত শরীর । দেখলেই বোঝা যায়। দু চোখে যেন সারা রাজ্যির ঘুম। কিন্তু আমার বা অন্য পথচারীর পায়ের আওয়াজ পেতেই ঠিক কি এক মহা কর্তব্য পালনে অতন্ত্র জেগে উঠছেন। কোমল বিনয়ের সঙ্গে বলছেন, মরিচ কিনবেন স্যার। ভাল মরিচ।

এত গভীর রাতে মরিচ !!

মরিচ কেনার প্রয়োজন ছিল না আমার । কিন্তু তার আহবান কেন যেন আমাকে আকর্ষণ করল । মরিচের দাম জানতে চাই তার কাছে। বললেন, হালি দশ টাকা স্যার। আসল বোম্বাই মরিচ। ঢাকার সবজি বিক্রেতাদের মুখে এখন স্যার ডাক কমই শোনা যায়। , আঙ্কেল , ভাইজান ওভাই সম্বোধন শুনি বেশি।
"স্যারের" আহবানে না করা গেল না। ৪টি মরিচ কিনলাম। সেও তার ব্যাপারে বড় কৌতুহলের
কারণে। এখন এই বড় লোক সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর শহরে এমন কৌতুহল বড় বেশী বোধ করি না। বেচারা জানালেন, নাম নিখিল চন্দ্র দাস। বাড়ি মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার ভবেরচরে।

নিখিল জানান, গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীর কাওরান বাজারের কাঁচামালের আড়তে শ্রমিকের কাজ করেন। একই সঙ্গে ট্রাক থেকে পড়ে যাওয়া কিংবা ফেলে দেওয়া সবজিও কুড়িয়ে জমা করেন। এরপর কোনো আড়তের এক কোনায় শরীর এলিয়ে ঘুমিয়ে নেন কিছুটা সময়। পরে আবার নিজের কুড়ানো সবজি বিক্রির জন্য বিভিন্ন পথের ধারে বসে পড়েন তিনি।
কেন এত কষ্ট করেন তিনি। জানতে না চেয়ে পারি না। ঢাকা শহরে শ্রমজীবি মানুষের আয় এমবিএ ডিগ্রিধারীদের চেয়ে বেশী। এমন কি সদ্য পাশ এমবিবিএস বা কোর্সে ঢোকা ডাক্তারদের চেয়ে অনেক বেশী। পত্রিকায় সেসব খবরও পড়ি।

এ বেচারা এত কষ্ট করে কেন !

জানতে চাই লাম কষ্ট কথা। ভাবলাম বিশাল কোন সমস্যার কথা বলবেন। হয়তো কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার করুণ আর্তিতে বলবেন, "মাইয়াগো বিয়া দিতে পারছি না। যদি কিছু দান করেন । কত টাকাই তো রাস্তা ঘাটে ব্যয় করেন। পূণ্যের জন্য কিছু দেন।"

না। ধারণা মিলল না। তার মুখ ভিক্ষুকের মত কান্নাকরুণ হয়ে উঠল না। বরং লোকটার মুখে গৌরবে হাসি। গর্বের সঙ্গে বললেন,চার মেয়ে তার। সবচেয়ে বড় মেয়ের নাম সুইটি, তারপর তিথি, তার ছোট বৃষ্টি আর সবচেয়ে ছোট মেয়ে সাথী। বড় মেয়ে সুইটি নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় একটি কলেজে অনার্সে পড়েন। তিথি আগামী বছর এসএসসি দেবে। বৃষ্টি চলতি বছরে ক্লাস এইটে উঠেছে। আর সাথীকেও স্কুলে দেবেন। সবাইকে সাধ্যমত উচ্চশিক্ষা দেবেন। এটা তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। তার স্ত্রীও স্বামীর প্রতিজ্ঞায় একমত।
নিখিল বলেন, , নিজে পড়াশোনা করতে পারি নি। , তাই মেয়েদের শিক্ষিত করার স্বপ্ন আমার । "

মেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে দিনরাত লড়াই করছেন তিনি। বাড়িতে কিছু টাকা বেশি পাঠানোর জন্য ঢাকায় কোনো মেস বা বাসাও ভাড়া নেননি তিনি। সেজন্য ঘুমানোর প্রয়োজন হলে কোনো আড়তের কোনায় জায়গা খুঁজতে হয় তাকে। তিনবেলায় খেতে হয় রাস্তার ধারের কমমূল্যের কোনো হোটেলে।

আমি শাদা এপরন পরা ছিলাম না। তারপরও কেমন করে বুঝল জানি না। নিখিল বললেন, স্যার একটা মাইয়ারে ডাক্তারি পড়াইতে চাই। তিন নম্বর মাইয়ার মাথা খুব ভাল। গভমেন্ট মেডিকেলে চান্স পাইলে পড়ামু । না খাইয়া হলেও।

শুনে সত্যিই মন খারাপ হয়ে গেল। এভাবেই আমাদের বাবা মা আমাদের ডাক্তার বানিয়েছে খেয়ে না খেয়ে।

তবে এতেও কোনো কষ্ট নেই নিখিলের। হাতে কিছু টাকা জমলেই বাড়িতে গিয়ে সবাইকে দেখে আসেন তিনি। আর বড় মেয়ে এখন প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের খরচের অনেকটাই আয় করতে শিখে গেছে, এটা নিয়েও অনেক আনন্দ নিখিলের।
যখন ফিরছি সব কাহিনি শুনে। নিখিলের মুখে এ কালের মহাভারতের গল্প শোনানোর আনন্দ। আর আমার চোখে অজান্তিতে অশ্রু।
_______________________

ডা. সোলায়মান আহসান সুজন । ঢাকা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়