Ameen Qudir

Published:
2019-01-29 23:36:53 BdST

রোগী কথন এক বিসিএস কর্মকর্তা এবং প্রসব পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণ : পূর্বাপর


কাহিনির প্রকৃত চরিত্রের ছবি নয়। মডেল ছবি। ছবির চরিত্র বাংলাদেশ বা পশ্চিম বঙ্গের নন।

 

ডা. ছাবিকুন নাহার
_________________________

বছরখানেক আগে প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ জনিত মাতৃমৃত্যু নিয়ে আমার একটি লেখা ব্যাপক আলোড়ন তোলে পাঠক মহলে। আমি প্রবল আগ্রহ নিয়ে পাঠকদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করলাম। ভাবতাম সচেতনতামূলক এসব লেখা পাঠককে আকৃষ্ট করতে পারে না। আমার সে ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে অনেকেই প্রেগ্ন্যান্সী জনিত রক্তক্ষরন সম্পর্কে আরেকটু ডিটেইলস জানতে চাচ্ছিলেন, তাদের জন্য এই লেখা। আজকে আমরা কথা বলব প্রসব পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণ এবং এর জটিলতা নিয়ে। রোগ শোক নিয়ে কথা বলা খুব একটা আনন্দদায়ক কিছু না, তাই মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে চলেন একটা গল্প শুনে আসি।

সামিরা, বছর ত্রিশের এক ঝকঝকে তরুণী।বিসিএস কর্মকর্তা। গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি, তাই বিয়ে করতে একটু দেরীই হয়ে যায় বলা চলে। বিয়ের পর কনসিভ করার চেষ্টা করতে করতে দু'বছর। অবশেষে সুবাতাস বয় সামিরার ঘরে। নতুন এক শিশুর আগমনী বার্তায় সবকিছুই যেনো অন্যরকম হয়ে ওঠে। আলো ঝলমলে আনন্দ নিয়ে দিন অতিবাহিত হতে থাকে। হঠাৎ একদিন দেখা যায় চাপ চাপ টকটকে লাল রক্তে সামিরা ভাসছে। আতংকে ভয়ে আধমরা হয়ে তক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি হয়। কোনো, কীভাবে, কী হলো এসব চিন্তায় সামিরা তখন আধ পাগল অবস্থা। ব্যাথা বেদনা ছাড়া এ কেমন ব্লিডিং? ও দিকে গর্ভের বাচ্চার বয়স মাত্র আটমাস। গর্ভফুল একটু নীচের দিকে ছিলো বলে শুনেছে। ডাক্তার সাবধান বানী করেছিলো রক্তপাত হতে পারে। তাই বলে এমন? এখন কী হবে? আমার বাচ্চা? ম্যাম আমার বাচ্চা বাঁচবে তো? কান্নার ধমকে মেয়েটা কথা শেষ করতে পারে না।

ম্যাডাম বল্লেন, আগে তুমি আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দাও। তোমার পেটে কি কোনো ব্যাথা আছে? কোনো আঘাত পেয়েছো? না ম্যাম। বাচ্চার নড়াচড়া আছে? জ্বি ম্যাম। এর আগেও কি কোনো রক্তপাত হয়েছে? জ্বি, অল্প অল্প তবে এবারই বেশি। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, ঘুম থেকে ওঠে দেখি রক্তে ভেসে যাচ্ছি। বলতে বলতে গলা ধরে আসে। দুফোঁটা জল চোখ বেয়ে নামে। ভয়ে বুক ভেঙে কান্না আসে। আহা মা! সন্তানের অমঙ্গল আশংকায় মায়ের কান্নার বর্ননা করার স্পর্ধা কারো নেই।

ম্যাডাম খুব সহমর্মিতা নিয়ে সামিরার প্রশ্ন শুনলেন, পরীক্ষা করে দেখলেন। অবশেষে বললেন, শোনো সামিরা, মায়ের পেটে বাচ্চার সাথে থাকে পানি এবং প্লাসেন্টা বা গর্ভফুল। পানি বাচ্চাকে ভেসে থাকতে এবং নড়াচড়া করতে সাহায্য করে। আর গর্ভফুল মায়ের কাছ থেকে রক্ত ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান নাড়ীর মাধ্যমে সন্তানকে সরবরাহ করে। এটা সাধারণত জরায়ুর উপরের দিকে অবস্থান করে। কোনো কারনে নীচের দিকে অবস্থান করলে এটাকে বলে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া। ভয়াবহ এক পরিস্থিতির নাম এই জিনিস। সাধারণত বাচ্চা ডেলিভারি হওয়ার আগে আগে জরায়ুর নীচের অংশ প্রসারিত হয়ে সন্তানকে বাহির হওয়ার পথ করে দেয়। এর ফলে ফুল যদি নীচে থাকে সে একটু একটু করে জরায়ু থেকে আলাদা হতে থাকে এবং রক্তপাত হয়। কখনো কখনো এমন পরিমান রক্তপাত হয় যে, মা বাচ্চা দুজনেই হুমকির মুখে পড়ে যান। ফলে মায়ের জীবন বাঁচাতে অপরিণত বাচ্চাকেও ডেলিভারি করিয়ে ফেলতে হয়। সে ডেলিভারি আবার নরমাল ভাবে করানো যায় না। সিজারিয়ান লাগে। বাচ্চা বাঁচুক না বাঁচুক মাকে বাঁচাতে এই স্টেপ নিতে হয়। তারপরও ভয়ংকর কিছু পরিস্থিতি আসে যখন কিছুই করার থাকে না আসলে। এসব রোগীর চিকিৎসায় স্বাভাবিক ভাবে পাঁচ ছয় ব্যাগ রক্ত তো লাগেই। তবে এমন নজিরও আছে, এক মাকে বাঁচাতে একুশ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে, আরেক মাকে বাঁচাতে জরায়ু পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে।

প্লাসেন্টা প্রিভিয়া কেনো হয় তা সঠিক জানা যায়না। তবে বেশি বাচ্চা নেওয়া, বেশি বয়সে গর্ভধারণ করা, আগের বাচ্চা সিজারিয়ান ডেলিভারি করা, জরায়ুর কোন অপারেশন, কিউরেটেজ এবং ধূমপানকে রিস্ক ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হয়। ধূমপান এমন এক অভিশপ্ত কাজ, এটা করেনা এমন কিছু নেই। রিস্ক ফ্যাক্টর তো জানলেন, এগুলো এড়িয়ে চললে কিছুটা প্রিভেনশন সম্ভব। আল্ট্রাসাউন্ড করে এই রোগ ডায়াগনোসিস করা যায় সহজেই এমনকি রক্তপাতের আগেই। সামিরার ঘটনা খেয়াল করলে দেখবেন, ওর বারবার রক্তপাত হয়েছে। প্রথমে অল্প অল্প পরে বেশি টকটকে তাজা রক্ত এবং প্রতিবারই ব্যথা বেদনা বিহীন। পেইনলেস তাজা রক্ত মানেই প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার লক্ষ্মণ। এরকমই আরেকটা ডিজাস্টার আছে, যেখানে নরমাল সিচুয়েটেড প্লাসেন্টা সেপারেট হয়ে রক্তপাত হয়, তবে সেখানে ভয়াবহ ব্যাথা হয় এবং বাচ্চা মারা যায়। এটাকে বলে এবরাপশিও প্লাসেন্টা। প্রসব পূর্ববর্তী রক্তক্ষরনের জন্য এই দুই কালপ্রিট শতকরা সত্তর ভাগ দায়ী সবচেয়ে বড় ব্যপার হচ্ছে এপিএইচের ব্যাপারে কনসার্ন থেকে রেগুলার ডাক্তারের চেকআপে থাকা, রক্তপাতের সাথে সাথে তড়িৎ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, আগে থেকেই রক্তস্বল্পতা পূরণ করে রাখা এবং পর্যপ্ত ডোনার ঠিক করে রাখা যেনো যেকোনো সময় চাহিবামাত্র রক্ত দিতে পারে, তাহলে বড় ধরনের বিপদ থেকে বাঁচা কিছুটা হলেও সম্ভব হতে পারে। কোনো মতেই এই ধরনের রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসা করা যাবে না এবং মাসিকের রাস্তায় হাত দিয়ে পরীক্ষা করা যাবে না।

সামিরাকে সবকিছু বুঝিয়ে পর্যাপ্ত রক্ত এবং ডোনার রেডি করতে বলা হলো এবং এটাও বলা হলো যে, যদি কোনো মতেই রক্তপাত বন্ধ না হয়, যেকোনো পরিস্থিতিতে ইমারজেন্সি সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারি করা লাগতে পারে। আর রক্তপাত যদি বন্ধ হয় এবং বাচ্চা যদি ভালো থাকে সে ক্ষেত্রে ঔষধের মাধ্যমে বাচ্চাকে ম্যাচিউর করে অভিজ্ঞ প্রসুতি বিশেষজ্ঞ, এক্সপার্ট সার্জিক্যাল টীম, অভিজ্ঞ অবেদনবিদ, নিওন্যটোলজিষ্ট এবং পর্যাপ্ত রক্ত হাতে নিয়ে অপারেশন করা গেলে মা এবং বাচ্চাকে বাঁচানো সম্ভব। যদিও অনেক সময় ডাক্তারদের সমস্ত প্রয়াশকে মিথ্যা করে দিয়ে মা দূর আকাশের তারা হয়ে যান। পড়ে রয় শূন্য ঘর, শূন্য বাড়ি আর তার বুকের ধন। ডাক্তাররা আবার নতুন একজনকে বাঁচানোর যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। কাউকে হাসি মুখে বিদায় দেন, কাউকে চোখের কোনে চিকচিক জল নিয়ে। সে জলের আভা কেউ দেখেন কেউ দেখেন না।

আনন্দের কথা বলে শেষ করি, সামিরা তার সন্তানকে বুকে নিয়ে ঘর আলো করে বাড়ি ফিরেছে। তার আগে অবশ্য তাকে অনেক ঝঞ্জা বিক্ষুব্ধ সময় পাড়ি দিতে হয়েছে। সন্তানের জন্য প্রানপন যুদ্ধ সেটা নতুন নয়, মায়েরা এ যুদ্ধটা করেই থাকেন যুগে যুগে। আশার কথা হচ্ছে, মায়েদের এই যুদ্ধে বাবারাও সামিল হচ্ছেন, দুজন মিলেই পাড়ি দিচ্ছেন অকূলপাথার। প্রসব পূর্ববর্তী রক্তক্ষরণ প্রসূতি বিদ্যা বিশেষজ্ঞদের জন্য দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন যেনো দুঃস্বপ্নই থাকে বাস্তব যেনো না হয় সে দোয়া সবার জন্য।
___________________________

ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়