Ameen Qudir
Published:2019-01-27 05:46:37 BdST
আনটোল্ড সন্তানের অফিসে এসে জীবনদাত্রী মা হয়ে গেল কাজের বুয়া, তারপর.. : এক আনটোল্ড স্টোরি
ডা. সাঈদ এনাম
______________________
এক.
আজ সকাল থেকেই মি বশিরুল সাহেব অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। বাইরে বেশ কয়েকটি মিটিং শেষ করে লাঞ্চ করে এখন ফিরলেন নিজ দপ্তরে। ফাইল দেখতে বসলেন। আজ গুরুত্বপূর্ণ দুটি ফাইল ছেড়ে দিতে হবে। এনিয়ে গতকাল মধ্যরাত অব্দি উপর মহল, মধ্যম মহল ও নীচ মহল সব খানেই শলাপরামর্শ তাকে সারতে হয়েছে। সব মহল সহ নিজ মহল ম্যানেজ করে গুছিয়ে নিয়েছেন সব।
কিন্তু আজকের কাজটিতেই আর বসতেই পারছেন না। আজ পরিদর্শনধারী ও যেনো একটু বাড়তি। মাত্র ক'দিন হলো তার প্রমোশনটা হয়েছে। এরপর থেকে অফিসে ভিজিটর এর সংখ্যা হটাৎ বেড়ে গেছে। এ'কাজ ও'কাজ নিয়ে পাড়াতো ভাই, মামতো ভাই, খালাতো ভাই, গ্রামের ভাই, স্কুলের বন্ধু, পাঠশালার টিচার কেউ আর বাদ নাই। ভাবেন প্রমোশন টা না হলেই বোধহয় ভালো ছিলো। যত্তসব ঝামেলার পসরা বসেছে তার টেবিলের উপরে।
বশিরুল সাহেব বিরক্ত। তার মতো বড় অফিসারের কার রিক্সা চুরি গেছে, কার ক্ষেতের ধান ছাগলে খেয়েছে এ নিয়ে থানায় মামলা, কার জমির আইল কেটেছে গ্রামের মাতব্বর, আবার কারো বা নাম জারিতে কানুনগো টাকা দাবি করেছে এসব নিয়ে রোজ রোজ থানার ওসি কে ফোন করা আর ইউ এন ও কে সুপারিশ করা সাজে? ওরা কি ভাববে। স্যারের স্ট্যাটাস বলতে কিছু নেই। কি যে হলো। সব হলো গিয়ে দুধের মাছি।
দর্শনার্থীদের লিস্টে চোখ বুলালেন বশিরুল সাহেব। গুনে গুনে নয় জন। সব শেষে মিস লাইলী বেগমের নাম। চোখ আটকে গেলো তাতে। সাক্ষাতের কারন অংশে লেখা, 'ব্যক্তিগত'। এ লাইলি বেগমটা আবার কে? মনে মনে ভাবলেন, কোন ফার্মের এক্সিকিউটি হবে টবে হয়তো, বশির সাহেব মুচকি হাসেন। পি. এস. কে ইন্টারকমে সবাইকে ঝটপট পাঠিয়ে দিতে বললেন। অনেক কাজ হাতে।
দুই.
সব শেষে লাইলী বেগম ঢুকতেই বশির সাহেবের চোখ ছানাবড়া। তাঁর সামনে যেনো ভুত। ময়লা কাপড়, গায়ে এক খানা চাদর। যেন ছেঁড়া বস্তার টুকরো গায়ে জড়িয়েছেন। মুখ ভর্তি পান। মুখ থেকে বেরুচ্ছে পানের গন্ধ, আর গা থেকে বের হয়ে আসছে ময়লার দুর্গন্ধ।
তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বললেন,
'মা তুমি? একি করেছো...?'
'হরে বাপ, আমি। জানি তুই ছমকাইবি। বহুৎ দিন তরে দেখিনা। কইলজা ছটফট করতাছিলো। তাও দুইদিন আগে রাইতে আবার দু:স্বপ্ন দেখছি। সইতে পারিনি। কইলজা টা মোচড় দিয়ে উঠছে, তাই সকাল উইঠাই রহিমের পোলাডারে লইয়া রওয়ানা দিছি ঢাকায়। তোর অফিস চিনতে আমাগো কষ্ট খুব অইছে। তয় আইয়া পড়ছি। রহিমের পোলাডা খুব ছালাক। হে পুলিশ টুলিশরে জিগায়া ছইলা আইছে আমারে নিয়া..৷ বাজান রে এত্তো বড় তোর অফিস। আর তুই হেই অফিসের বড় সাব। বিশ্বাস অয়না তুই যে আমার পেটের ছাওয়াল। সকাল থাইকা তর অফিস দেখতাছি আর দেখতাছি রে বাপ। কত্ত বড় বড় মানুষ তর এইখানে আইতাছে আর যাইতাছে। আর জিগাইতাছে 'ছার' কই? এইডা দেইখা ছোখের জল আর আটকাইতে পারছিনারে বাজান। আল্লাহ আমার বাজানরে এত্তো বড় অফিসার বানাইছে...!!'
'মা তুমি চুপ করো। কি করছো এটা...?'
'ক্যানরে বাপ?!'
'আইচ্চা আগে কও, তুমি কি এইখানে আমার মা বইলা পরিচয় দিছো কাউরে?!'
'ওমা তুই এইডা কি কস বাজান?!, আমার ছাওয়াল আর আমি কমু না? আরে হুন মজার কতা, গেইটে আমারে পুলিশ ঢুকতেই দেই না পেত্তম। হেতাগো বিশ্বাস অয়না, আমি তর মায়। বার বার নাম ঠিকানা নেয়। এডা ওডা জিগায়। জিগায় আপনার পোলায় দেখতে কিরুম? কি খাইতে পছন্দ করে? হা হা...। হা হা, আমি কইলাম লম্বা কিসিমের রাজপুত্তুর , আর পছন্দ করে ছিংড়ি মাছের ডাইল। পরে কারে জানি হেরা ফোন করলো। তারপর কি আর কমু, আমারে খালা খালা কইয়া হাতে পায়ে ধইরা একশো'বার মাপ ছাইলো। কি যে খাতির করলো..!। তুই ছিলিনা , জানস হেরা দুপুরে পোলাও, বিরিয়ানি, পায়েস, দই সব আইনা খাইতে কইলো। আমি খাইনাই। কেবল দুইটা পান আনায়া খাইছি। এত্তো মজার পান, জীবনেও খাই নাই রে বাপ। যাউক পোলাও বিরিয়ানি ভাত সব রইছে, খাই নাই। তরে ছাড়া খাওন যায়, বাজান?'
'মা ক্যান আইছো..?' বশিরুল সাহেব ভীষন বিরক্ত । তার কপালে ঘাম ঝরতেছে, চোখ দুটো ক্রমশ লাল।
লাইলী বেগম এবার একটু থতমত খেলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
'না বাজান, ওই যে কইলাম। তরে নিয়া দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। দেখি কি, এক বাঘ তরে তাড়াইয়া আসতাছে আর তুই মা মা কইয়া দৌড়াইয়া আইয়া আমার কোলে ঝাপ দিছস....। তাছাড়া বাজান রে তুই কত্তদিন অইলো বাইত যাছনা, তোরে দেখার লাইগা কইলজা টা খা খা করতাছিলো '
'চুপ করো মা'। 'দিসোতো আমার সর্বনাশ কইরা। তুমাগো কি কান্ডজ্ঞান নাই। ছেড়া কাপড়, খাতা, বালিশ পইরা কেউ এভাবে অফিসে আহে? ', বশির সাহেব ধমক দিলেন।
'ক্যান বাজান কি অইসে..?'
'থাক মা। ওসব তুমি বুঝবানা। তোমরা অশিক্ষিত, গেরামের মানুষ। অফিস আদালত বুঝনা। আর কতা বাড়াইয়ো না, যাওগা, টেকা পয়সা লাগবো?'
'নারে বাপ, টেকার লাইগাতো আই নাই', লাইলী বেগমের চোখ ছলছল।
'তয় হোন তুমরা এক্ষুনি যাও, ড্রাইভার রে কইতাছি। তোমাগো'রে বাস ইস্টিশনে নামাইয়া দিবো। বাড়িত যাও। খবরদার আর এরহম আমারে ডুবাইতে আইসো না'।
'বাজান, কি অইসে বাপ, বুঝি নাই। আমারে মাপ কইরা দে', লাইলী বেগম এবার কেঁদে দিলেন।
'কথা কইয়োনা, যাওনা সামনে থাইকা', বশির সাহেব আবার ধমক দিলেন তার মা'কে।
'তুই খাবিনা বাপ। এই যে অনেকক্ষণ তোর লাইগা পোলাও নিয়া আমি বইসা আছি। হেরা আইনা দিয়া আমারে বার বার কইছিলো খাইতে। কিন্তু তরে ছাড়া কেমনে খাই...,আর তর লাইগা ছিংড়ি মাছের ডাইল আনছিলাম। জানিনা এতক্ষনে গান্দা অইয়া গেলো কিনা?'
'মা, এখন খাওনের টাইম আছে? আমি মিটিং এ গেসিলাম। ঐখানে খাইয়া নিসি। লাগবোনা । তুমি খাইলে চুপচাপ ঐখানে বইসা খাইতে পারো, নইলে লগে নিয়া যাও। ড্রাইভার'রে কইতাছি, হে তোমারে নামায়া দেবো...,। আর খবরদার মা টা কইয়া আর পরিছয় টরিছয় আর দিয়োনা...'
'বাজান আমি বুঝি নাই। মাপ কইরা দে। খামুনারে বাপ। আমার আসলে ক্ষিদাও নাই। তু এত্তোবড় অফিসার, এইডা দেইখা আমার পরান ডা জুড়াইছে বাপ। ক্ষিধা অনেক আগেই মিইট্টা গেছে। থাক আমি যাইগা। তর যদি আবার কোন অসুবিধা অয়..., রাগ করিসনা বাপ, আমারে মাপ কইরা দে বাজান, মাপ কইরা দে..', চোখের জল আচলে মুছতে মুছতে লাইলী বেগম বের হয়ে গেলেন।
রুমে পি.এস. ঢুকলেন। 'স্যার খালা কে যে ড্রাইভার নামিয়ে দিতে বলছিলেন, উনিতো দেখি এই মাত্র চলে গেলেন?'
'আরে কারে খালা বলো? তোমরা জুনিয়র অফিসার। তোমাদের বুদ্ধিসুদ্ধি কোন দিন হবেনা। এই মহিলাতো আমার 'মা' না। আমাদের গ্রামের বাড়ির কাজের বুয়া। আমি আদর করে 'মা' বলে ডাকতাম। এই একটু আদর যত্ন করতাম আর কি। গরীব মানুষতো তোমাদের বোকা বানিয়া অফিসে ঢুকছে...' বশির সাহেব মুচকি হাসলেন'ওহ, কি বলেন স্যার। আমারও একটু সন্দেহ হয়েছিলো বেশভুশা দেখে', পি. এস সাহেব সহাস্যে বললেন।
'হা হা । তোমাদের প্রমোশন হোক। বাড়ি গাড়ি হোক দেখবে এরকম কত্ত আসবে মা বাপ পরিচয় দিয়ে', বললেন রাতারাতি আংগুল ফুলে কলা গাছ নয়, বট গাছ হওয়া কোটিপতি, এ অফিসের দুর্দান্ত প্রভাবশালী আর ক্ষমতাবান বড় বাবু, চৌধুরী বশিরুল।
হঠাৎ এমন সময় বশিরুল সাহেবের লাল ফোন বেজে উঠলো। পি. এস. রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। লাল ফোন বাজলে পি. এস. দের একটু সরে যেতে হয়। তাই তিনি সরে আসলেন।
বশির সাহেব তাড়াতাড়ি ফোন ধরলেন, 'স্যার...'
ওপাশ থেকে ভরা কন্ঠে ভেসে আসলো,
'হ্যালো, স্যার আমরা দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ফোন করছি। আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ছিলো। স্যার আপনি আসবেন না আমরা চলে আসবো... '
তিন.
বশিরুল সাহেবের হাত পা কাঁপতে লাগলো। তার কানে একটু আগে মায়ের কথা গুলো বাজতে লাগলো, '...বাজান স্বপ্নে দেখি কি একটা বাঘ তরে তাড়াইয়া আইতাছে, আর তুই মাগো মাগো কইয়া দৌড়াইয়া আমার কোলে আইয়া পড়তাছস বাজান, তাই কইলজা টা মোচড় দিলো, অনেকদিন তোরে দেখিনা.....'বশিরুল সাহেবের প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে, যদিও তিনি দুপুরে লাঞ্চ করেছেন। তার ইচ্চা হচ্ছে মায়ের হাতে শেষমেশ চিংড়ি মাছের ডাল দিয়ে এক নলা ভাত খেতে।
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলেন পি.এস,
'স্যার, লাইলী বেগম নামে যে কাজের বুয়া এসেছিলো, সে ২ নং গেটে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে, গেট থেকে নিরাপত্তা কর্মীরা এই মাত্র জানালো..., 'স্যার স্যার... শুনছেন...?
______________________
ডা. সাঈদ এনাম।
২৫/০১/২০১৯
সাইকিয়াট্রিস্ট
ইউ এইচ এফ পি ও
মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন
আপনার মতামত দিন: