Ameen Qudir
Published:2019-01-11 00:51:48 BdST
সবিশেষ ১৯৫২সাল: ঢাকা মেডিকেলের দুজন নারী শিক্ষার্থীর একজন ডা. আফজালুন নেসার স্মৃতিচারণ
ডেস্ক
_____________________
১৯৫২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের সেই ব্যাচে তখন মাত্র দু’জন নারী শিক্ষার্থী ছিলেন। একজন তিনি এবং অন্যজন ডা. জাহানারা রাব্বী (শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর স্ত্রী)। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আফজালুন নেসা। যা আমাদের দেশের ইতিহাস চিরদিনের মতো বদলে দিয়েছিল।
স্মৃতিচারণ করে অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আগের দিন রাতেই ছাত্রনেতারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন- ১৪৪ ধারা ভেঙে আন্দোলন হবে এবং সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছেলেরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে মিছিল বের করে।
সেই সময় প্রায়ই পুলিশের সঙ্গে ছোটখাটো সংঘর্ষ বাধছিল আর সেসব মেয়েদের হল থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম- পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ইট-পাটকেল ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ হচ্ছে।
বিকেল ৩টার সময় হঠাৎ গুলির শব্দ পেয়ে বারান্দায় আসেন তারা, দেখেন-মানুষ ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে পালাচ্ছে। বিকেল ৩টা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের যেই উত্তাল গর্জনে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হচ্ছিল, হঠাৎ করেই যেন তা শ্মশানের মতো নীরব হয়ে গেল, বলেন ডা. আফজালুন নেসা। তারপর বিকেল ৪টার দিকে দেখলাম, সাদা শাড়ি পরা এক বিধবা বৃদ্ধা আর একজন অল্পবয়সী মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ডিসেকশন হলের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। হল থেকে কয়েকজন মেয়ে মিলে গেলাম ডিসেকশন হলের পেছনে। সেখানে দেখলাম, স্ট্রেচারে তিনটি মরদেহ রাখা, আর তখনও সেগুলোর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি। পরে শুনেছিলাম সেখানে শহীদ সালাম আর শহীদ বরকতের মরদেহ ছিল।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন যেখানে বর্হিবিভাগ ভবনের সামনের ওষুধের দোকান, সেখানেই ছিল প্রথম শহীদ মিনার, মেয়েদের হল থেকে মাত্র দুইশ’ গজ দূরে। শহীদ মিনারটির চারদিকে লাল সালু দিয়ে ঘেরা আর দু’টি পোস্টার লাগানো ছিল তাতে। একটিতে লেখা ‘স্মৃতিস্তম্ভ’, আরেকটিতে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পরদিন সকাল থেকেই সেখানে মানুষের ঢল নামে।
স্তম্ভটি উদ্বোধন করেন শহীদ সফিউর রহমানের পিতা। সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিল।
অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা বলেন, আমার এখনো মনে আছে, এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মা সেই প্রথম শহীদ মিনারে এসে তার গলা থেকে সোনার চেইন খুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই শহীদ মিনারটিও যেন শাসক দলকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। আর তাইতো ২৬ তারিখ সকালে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ট্রাক এসে ঢামেক ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে, কারণ তারা এসেছিল শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলতে।
দড়ি দিয়ে স্তম্ভটি বেঁধে ১০-১২ জন মিলে টেনে উপড়ে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু তাতে দমে যাননি মেডিকেল কলেজ পড়ুয়া সেই সাহসীরা। অধ্যাপক আফজালুন নেসার ভাষায়, ‘সেই ফাঁকা জায়গাটিতে আমরা বাঁশের কঞ্চি গেঁথে কালো কাপড়ের নিশান লাগিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলাম’।
এর দুই বছর পরে ১৯৫৪ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আবার আসে শাসক দল। পুলিশ এসে আবার ক্যাম্পাস ঘিরে ফেলে। কিন্তু এবারে রুখে দাঁড়ায় ডিএমসির নারী শিক্ষার্থীরা। তারা প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন।
“হলের গেট বন্ধ করে ছাদ থেকে আমরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছুঁড়তে থাকি, এতে কয়েকজন আহত হয়। তালা ভেঙে পুলিশ আমাদের হলে ঢুকে ১৫ জনের মতো ছাত্রীকে গ্রেফতার করে। ধরে নিয়ে যাবার সময় আমরা চিৎকার করে স্লোগান দিতে থাকি- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আমাদের রাখা হয়েছিল সেন্ট্রাল জেলে, দিন পনের পর পুলিশ আমাদের ছেড়ে দেয়”।
শহীদ মিনার তৈরির সেই অবিস্মরণীয় রাতের কথা এখন ৬৬ বছরের অতীত। অথচ সেই রাতের প্রত্যেকটি মুহূর্ত এখনো মানসপটে জ্বলজ্বল করে। কী প্রবল দেশপ্রেমেই না আমরা তখন উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। মাত্র এক রাতে আমরা এমন এক স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করি যা ভবিষ্যতে আমাদের সকল আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে থাকবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণ থেকেই যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা একদিন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলাফল হলো আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন- স্বাধীনতা, বলেন দেশসেরা এই চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা।
______________________________
অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষে অধ্যাপক ডা. আফজালুন নেসা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে অবসরে যান।১০ জানুয়িারি ২০১৯ প্রয়াত।
লেখাটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘হিউম্যান্স অব ডিএমসি’ নামের ফেইসবুক পেজে প্রকাশিত হয়। পাঠকদের জন্য লেখাটি প্রকাশ করা হলো।
আপনার মতামত দিন: