Ameen Qudir

Published:
2019-01-06 07:57:05 BdST

আয়ু গড় আয়ু বৃদ্ধি : সম্ভাবনা বনাম সমস্যা



শতায়ু মানবসেবী জোহরা সেহগাল। যিনি ১০২ বছরের জীবনে সক্রিয় ছিলেন মানবসেবায়। পাশাপাশি অনন্য উদ্যমী অভিনয়েও।

 



ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম
________________________________

গত কয়েক দশকে আমাদের গড় আয়ু অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। গড় আয়ু বাড়া উন্নয়নের লক্ষন তবে বিশাল বয়স্ক জনগোষ্ঠী কে যদি কর্মক্ষম না করা হয় তবে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। বাংলাদেশে ১৯৬০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, প্রতিটি দশকেই গড় আয়ুর হার বেড়েছে। দু'একটি মাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া গত ছয় দশকে গড় আয়ু ৪৬ বছর থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১ বছরে।

১৯৬০ সালে গড় আয়ু ছিলো ৪৬ বছর। ১৯৬৫ সালে গড় আয়ু বেড়ে ৪৯ বছর হয়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সালে সেটা আবার কমে ৪৮ বছরে নেমে আসে। এর কারন হলো ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড় যাতে প্রায় ৫ লাখ মানুষ মারা যান।

১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত গড় আয়ু মাত্র এক বছর বৃদ্ধি পায়। এ পাঁচ বছরে গড় আয়ুর খুব একটা পরিবর্তন না হবার কারণ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ১৯৭৪ সালের যুদ্ধ পরবর্তী দুর্ভিক্ষ। এ দু:সময়ে দেশে ব্যাপক প্রাণহানী হয়।

১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সালে গড় আয়ু ৪৯ বছর থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৩ বছরে। ৮০ থেকে ৯০ দশকে পাঁচ বছর বেড়ে তা ৫৮ বছরে উন্নীত হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। এই দশকে গড় আয়ু বেড়েছে সাত বছর। এমন কি ১৯৯১ সালে একটি বড় জলোচ্ছ্বাসে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ মারা যাওয়া এবং ১৯৯৮ সালে প্রবল বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এ দশকে গড় আয়ু বৃদ্ধির উপর নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়তে দেখা যায়নি। এর কারণ জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিকল্পনা গুলোর সফল বাস্তবায়ন। তাছাড়া সরকারী বেসরকারি এনজি'ওর স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন কার্যক্রম তৃণমূল পর্যায়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রভুত উন্নয়ন হয়। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনেক কুসংস্কার দূরীভূত হয়।

২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গড় আয়ু পাঁচ বছর বেড়ে ৬৫ বছর থেকে ৭০ বছরে হয়। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত গড় আয়ু বৃদ্ধি কিছুটা স্থবির হয়ে আছে। এ দশকে গড় আয়ু মাত্র দুই শতাংশ বেড়ে থেকে ৭১ হয়েছে।

সামগ্রিক ভাবে বাংলাদেশের গড় আয়ু বাড়ার কারন হলো, স্বাস্থ্য খাতে অগ্রগতি, সরকারী বেসরকারি খাতে সারা দেশের বিভাগীয় এবং জেলা শহরগুলোতে গড়ে উঠা সদর হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ, ক্লিনিক, রোগ পরীক্ষা কেন্দ্র, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও প্রাইভেট সেক্টর বিকাশ লাভ। যাতে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধি পায়।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন হওয়ার কারণে কেবল গড় আয়ু নয়, শিশুমৃত্যু হার এবং মাতৃমৃত্যু হারও অনেক কমে যায় বাংলাদেশে। ডায়রিয়ায় ও পানিশূণ্যতার চিকিৎসা এবং প্রতিরোধে সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা ও তৎপরতায় দেশের শিশুমৃত্যু হার অনেক কমে যায়। একদিকে দূর্নীতিতে দশকের পর দশক চ্যাম্পিয়নস এর ট্রফি বগল দাবা করা দেশটির স্বাস্থ্য খাতে এমন উন্নয়ন সারা বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

এবার আসি ভিন্ন প্রসংগে। গড় আয়ু বাড়া একদিকে যেমন সম্ভাবনার অন্য দিকে শংকার। গড় আয়ু বাড়াছে ঠিকই কিন্তু এ দীর্ঘ সময় একজন মানুষ কতটা সুস্থ ভাবে জীবন-যাপন করছে সেটাই বড় প্রশ্ন। একজন মানুষ ৭০ বছর বাঁচলেন, ভালো কথা কিন্তু এই সত্তর বছরে যাপিত জীবনে তিনি কতটা সময় স্বাস্থ্যবান কর্মক্ষম হয়ে বেঁচেছেন সেটা মুল কথা।

সেজন্যে কেবল গড় আয়ু বাড়ালে হবে না, প্রয়োজন মানুষের কর্মমুখর সুস্থ জীবন। কারণ, দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকায় কর্মক্ষমতা না থাকলে সেটার অর্থনীতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

ক্রমবর্ধমান গড় আয়ুর প্রভাবে ২০১১ সালে বাংলাদেশের বয়স্ক মানুষ ছিলেন ৬'৯ শতাংশ , ২০৫০ সালে সে অনুপাত ছাড়িয়ে যাবে ২০ শতাংশ। অর্থাৎ তখন এক-চতুর্থাংশই হবে বয়স্ক জনগোষ্ঠী। ২০৫০ সালের দেশের অর্থনীতির নির্ভর করবে এই বর্ধিত বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে কিভাবে ব্যবস্থাপনা করা হবে সেটার উপর। এই বিশাল বয়স্ক জনগোষ্ঠী যেন সুস্থ থাকেন, কর্মক্ষম থাকেন , এখন থেকেই সে পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। নতুবা পরিনতি হবে ভয়াবহ। কারণ কর্মহীন বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ তখন হয় না খেয়ে মারা যাবেন নতুবা সুইসাইডের পথ বেছে নিবেন।

বিশ্বে গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি জাপানে। হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল দেখতে যেয়ে সেখানে একজন ম্যানেজার দেখলাম যার বয়স আনুমানিক ৬৫ হবে, কয়েকজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী দেখলাম যাদের বয়স ৭৫ এর উপরে, টোকিও তে একটা মানি এক্সচেঞ্জ পরিচালনায় সকলেই ছিলেন বয়স্কা মহিলা যাদের বয়স ৪৫ থেকে ৬৫ বছর। তাছাড়া বাসে ট্রামে যখনই চড়েছি সবখানেই চালক হিসেবে যাদের দেখেছি তাদের বয়স ৬০ বা তারও বেশি। অর্থাৎ বিশাল বয়স্ক এই জনগোষ্ঠীকে তারা মৃত্যু পর্যন্ত কর্মক্ষম রাখার চেস্টা করেছে তারপর ও বয়সী লোকদের আত্মহত্যায় জাপান অবস্থান বিশ্বে প্রথম সারিতে।

 

ডা. মোহাম্মদ সাঈদ এনাম

এম বি বি এস (ডি এম সি)
এম ফিল (সাইকিয়াট্রি)
বি সি এস (স্বাস্থ্য)

সাইকিয়াট্রিস্ট
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, সিলেট।

*মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
*মেম্বার, ইউরোপিয়ান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।
*লাইফ মেম্বার, বাংলাদেশ সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন।

ধন্যবাদ সুন্দর সময়োপযোগী লেখার জন্য। শুভ কামনা নিরন্তর।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়