Ameen Qudir

Published:
2016-12-17 21:44:58 BdST

ম্যাডাম, বাচ্চাটা আপনেরে দেখতে চাইছে, তাই নিয়ে আইছি


 

 

ডা. সাজ্জাদ মাহমুদ
__________________________

২০ নম্বর বেডের নতুন রোগীর অবস্থা ভাল নয়। বেডটি সুস্মিতার ভাগে। রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে ইউনিটের সকল ডাক্তাররা বসেছেন প্ল্যানিং করতে। এই মূহুর্তে কনজারভেটিভ দেয়া ছাড়া উপায় নেই। কিছুটা ইম্প্রুভ করলে হয়তো আবার অপারেশনের জন্য প্রিপারেশন নেয়া যাবে। রোকেয়া বেগম নতুন রোগীর নাম। খুলনা থেকে গল ব্লাডারের অপারেশন হয়েছিল, সফল হয়নি। স্টোন ডিসলজ হয়ে নালী বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় দফা অপারেশনের পর অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। রেফার্ড হয়ে ঢাকায়। সুস্মিতা শুরুতে ঘাবড়ে যায়। এত ক্রিটিক্যাল পেশেন্টকে ম্যানেজ করা অনেক কঠিন। ইউনিটের সিএ এবং অন্যান্য সকল ডাক্তার এই ব্যাপারে তাকে সাহস যোগালো।

ইন্টার্নী চিকিৎসকদের বেড ভাগ করা থাকে। একেকজনের ভাগে থাকে ৫/৬ টি। এই সংখ্যা ডাক্তার সংখ্যা অনুযায়ী কম-বেশি হয়। এতে করে প্রতিটি রোগী সম্পূর্ণ চিকিৎসা একজন ডাক্তার দ্বারা পান। সেই ইন্টার্নী চিকিৎসকের সুপারভাইজ করে থাকেন এসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার, মেডিকেল অফিসার এবং প্রফেসরদের মত বড় ডাক্তারগণ।


প্রতিদিন ফলোআপ, ড্রেসিং, সুগার লেভেল, সকল পরীক্ষা করানো সব কিছুতেই সে মনোযোগ আর যত্ন নিয়ে করে যাচ্ছিল। রোকেয়া বেগমের সাথে এটেন্ড্যান্ট বলতে শুধু তার স্বামী আর ৪ বছরের বাচ্চা। সেজন্য পরীক্ষানিরীক্ষার সকল কাগজ সুস্মিতা নিজেই নিয়ে যেতো ল্যাবে। ডিরেক্টরের সাইন নিয়ে সেগুলো ফ্রীতে করিয়ে নিতো। আবার ল্যাব থেকে নিয়েও আসতো। অন্যান্য বেডের কাজ সেরেও তার এক্সট্রা এটেনশন ছিল এই রোকেয়া বেগমের দিকে।


প্রায় প্রতিদিনই সকাল ডিউটি করে সে ইভেনিং-এ থেকে যাচ্ছে। আবার পরদিন ভোরে চলে আসে। কিংবা যেদিন নাইট ডিউটি থাকে সেদিন বাসায় না গিয়ে হোস্টেলে থেকে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে আবার ফিরে আসে। অথচ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আধুনিকা মেয়ে সুস্মিতা! মেডিকেলের হোস্টেলেও তার খুব একটা থাকা হয়নি। ঢাকায় উচ্চবিত্ত পরিবারের আদরের মেয়ে। প্রথমদিকে ইঞ্জেকশনের সুই দেখলেই ভয় পেত। সেই সুস্মিতা নাওয়া খাওয়া ভুলে গিয়ে রোকেয়া বেগম নামের কোথাকার এক মহিলার এত সেবা করে যাচ্ছে! চিকিৎসা যে শুধু জ্ঞানেই না মায়ায় ভরা একটা বিদ্যা। এই বিদ্যা মানুষকে মহান করে, মহানকে করে মহোত্তম।

টানা পাঁচদিন অমানুষিক পরিশ্রমের পরেও সুস্মিতার স্মিত হাসি ম্লান হয়নি। সবার সাথে আগের মতই সহজ ছিল। একদিন সকালে দেখলো রোকেয়া বেগম তার স্বামীর দিকে তাকিয়েছে। মুখে সম্ভবত কিছু কথাও হয়েছে। সেদিন ইউনিটের সবাইকে সে এই ঘটনা বলে বেড়িয়েছে। মনে হচ্ছে প্রফে পাশ করলেও এত খুশি হত না সে। আমাদের ইউনিটে প্রতিদিনই শেয়ার হতো। কার রোগী ভাল হয়েছে, কার রোগীর অবস্থার উন্নতি ছিল। এসব জানাজানি হতো আর একজন আরেকজনকে অভিনন্দন জানাতো। কখনো কখনো নিজেরাই কাজ করে ছোটখাট পার্টি হতো। খানাপিনা একটু আনন্দ। যেন অনেক কাজের ফাঁকে অক্সিজেন নেয়া। সেদিন সুস্মিতা বিকাল পর্যন্তই ছিল। যদিও তার কোন রোস্টার ডিউটি ছিল না।


পরদিন সকালে এসে শুনে রোকেয়া বেগমের অবস্থার অবনতি হয়েছিল রাতে। তাই আইসিইউতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। সেদিন সুস্মিতার সারাদিন মন খারাপ। ওয়ার্ডে কাজ সেরেই আইসিইউতে চলে যেত। রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস আর অক্সিজেন দেখতো। আর একটু পরপর অভয় দিতো বাচ্চাটাকে। সুস্মিতার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আমরা সবাই তাকে সাপোর্ট দিলাম। কিন্তু কিছুতেই আশ্বস্ত করা গেল না। পরদিন এসে শুনি রোকেয়া বেগম আইসিইউতেই মারা গেছেন। তার স্বামী আর এক আত্মীয় এসেছে লাশ নিতে। সুস্মিতা কিছু বলেনি। আমরা তার চোখে জল দেখেছিলাম সেদিন। নি:শব্দ কান্না। মাত্র ৫ দিন সেবা পেয়েছে অচেনা এক মহিলা। সেবাদানকারীর সাথে রোগীর কোন সম্পর্কই নেই। অথচ মৃত্যুর পর সেই বেশি আক্ষেপ আর চোখের জল ফেলে! চিকিৎসা পেশার যাদুটা বোধহয় এখানেই।

 

প্রায় মাসখানেক পর গাইনী ওয়ার্ডে কাজ করার সময় হঠাৎ সেই রোকেয়া বেগমের স্বামীকে দেখা গেল কাকে যেন খুজছে। আমাকে দেখেই যেন স্বস্তি । জিজ্ঞাসা করলো, "সুস্মিতা ম্যাডাম কই? তিনতলায় আপনেগে অনেকে খুচ্ছি।" আমি সুস্মিতাকে কল দিলাম। ওয়ার্ড থেকে ডক্টরস রুমে আসার সাথে সাথেই লোকটি কান্না শুরু করলো। "ম্যাডাম গো আফনে আমরারে যেমনে সেবা দিছেন আমরা ভুলতে পাইরবো না। বাচ্চাটা আপনেরে দেখতে চাইছে, তাই নিয়ে আইছি।" সুস্মিতার চোখে তখন স্পষ্ট টলটলায়মান জল।

_______________________________

 

লেখক ডা. সাজ্জাদ মাহমুদ । সুলেখক ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়