Ameen Qudir
Published:2018-12-16 11:30:59 BdST
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির স্মরণীয় তেলিয়াপাড়া চা বাগান
ডা. কামরুল হাসান সোহেল
_____________________
তেলিয়াপাড়া চা বাগানের বাংলোর পূর্ব দিকে নির্মাণ করা হয়েছে ২, ৩ ও ৪নং সেক্টরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণে তেলিয়াপাড়া স্মৃতিসৌধ। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে এ স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন প্রাক্তন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ। বুলেটের আকৃতিতে তৈরি এই সৌধের সামনে দু’টি ফলকে অঙ্কিত রয়েছে শামসুর রাহমান’এর বিখ্যাত “স্বাধীনতা তুমি” কবিতা। চারপাশের চা-বাগানের সবুজের বেষ্টনীতে স্মৃতিসৌধসহ রয়েছে একটি লেক। লাল শাপলা ফোটা এই লেক বর্ষাকালে আকর্ষণীয় রূপ ধারণ করে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তেলিয়াপাড়ার ঐতিহাসিক তাৎপর্য
১৯৭১ সাল এ দেশের মানুষের কাছে যেমন গৌরবের তেমনি বিভীষিকাময়ও। গৌরবের এ জন্যে যে, রাষ্ট্রীয় নগ্ন নির্দেশপুষ্ট সুসজ্জিত ও সুশৃঙ্খল একটি হিংস্র বাহিনীর বিপরীতে কেবলমাত্র আত্মবিশ্বাসসমৃদ্ধ একদল নিরস্ত্র মানুষ মাত্র ৯মাসে ছিনিয়ে এনেছিল একটি নতুন পতাকা ও নতুন মানচিত্র। যার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বিভীষিকাময় এ জন্যে যে, বর্বর পাকসেনারা সেদিন বাংলার বুকে এঁকে দিয়েছিল পৈশাচিকতার এক ভয়ঙ্কর চিত্র। ওদের নখরাঘাতে ক্ষরিত শোণিত ধারায় সেদিন শ্যামল-সুন্দর এ দেশে প্রবাহিত হয় রক্তগঙ্গা। ক্ষত-বিক্ষত হয় প্রতিটি থানা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। আজও সে ভয়াল স্মৃতি প্রতিটি মানুষের মনে জাগরুক।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ওদের পশুত্বের ছোবল দেশের সর্বত্র সমান ছিল না। সে বিবেচনায় মাধবপুরের একটি পৃথক অবস্থান বিদ্যমান। মূলত এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়। এখানকার তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোটি সেই ইতিহাসের সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধ সূচনাকালে প্রায় প্রতিটি মূল ক্রিয়া এখান থেকে সম্পাদিত হয়েছে। সেইসব গৌরবগাঁথার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য :
১.মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ২৭ মার্চ দিবাগত রাতে মাধবপুর এসে এখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করে বিভিন্ন স্থানের প্রতিরক্ষা-প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে ২৯ মার্চ তাঁর সদর দপ্তর তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজার বাংলোয় স্থানান্তর করেন। সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়নের এলাকা সিলেট পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়।
২.মাধবপুর এবং তেলিয়াপাড়া থেকেই সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী ইউনিটগুলোর পাশাপাশি ভারতীয় ঊর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নেয়া হয়।
৩. মেজর খালেদ মোশাররফের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সর্বপ্রথম ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহ কিশোরগঞ্জ থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া এসে সেখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন।
৪. ১ এপ্রিল থেকে তেলিয়াপাড়ায় ২য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের যৌথ সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়।
৫. ১ এপ্রিল বিকেলে ভারতীয় বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে তেলিয়াপাড়া বাগানে এসে লে. কর্নেল এস এম রেজা, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে কর্নেল ওসমানীর সীমান্ত অতিক্রম এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী মেজর জিয়ার রামগড়ে অবস্থান নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সংবাদ দেন।
৬. ২ এপ্রিল আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল তেলিয়াপাড়া বিওপি-র কাছে এসে মেজর খালেদ মোশাররফ ও মেজর শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের পদক্ষেপ নেন। ৩ এপ্রিল মেজর জিয়াউর রহমান সম্মেলনে যোগদানের জন্য চট্টগ্রাম থেকে তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলোতে আসেন। ৪ এপ্রিল সকালের মধ্যে লেঃ কর্নেল আব্দুর রব, লেঃ কর্নেল এস এম রেজা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীসহ বহু সেনা কর্মকর্তা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন সেখানে আসেন।
৭.ঐ দিন সকাল ১০ টার দিকে ব্রিগেডিয়ার পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে সঙ্গে নিয়ে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে উপস্থিত হন।
৮. ৪ এপ্রিলের ঐতিহাসিক সেনা সভায় কর্নেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী এমএনএ, লেঃ কর্নেল আব্দুর রব এমএনএ, লেঃ কর্নেল এস এম রেজা, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী মহকুমা প্রশাসক কাজী রকিব উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিএসএফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল উপস্থিত ছিলেন।
৯. তেলিয়াপাড়াকে প্রথম অস্থায়ী সেনা সদর গণ্য করে মুক্তিযুদ্ধ কালে মুক্তিবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারণী সর্বমোট ৩টি সভার মধ্যে প্রথম দুটি সভাই এখানে অনুষ্ঠিত হয়।
১০. পাক সেনাবাহিনীর বাঙালি সেনারা যার যার অবস্থান থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত প্রথম সেনা সভার মাধ্যমেই বিদ্রোহী সকল সেনা ইউনিটগুলো বজ্রকঠিন শপথের মাধ্যমে একক কমান্ডের অধীনে চলে আসে।
১১. ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক এ সেনা সভা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা এবং মুক্তিবাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
১২. তখন পর্যন্ত কেনো সরকার গঠিত না হওয়ায় ঐ সেনা সভায় কর্নেল এম এ জি ওসমানী ও লেঃ কর্নেল এম এ রবকে একাধারে গণপ্রতিনিধি ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা বিবেচনায় যথাক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও উপ সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কর্নেল ওসমানী ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠনের পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং এরপর হতে মন্ত্রীর মর্যাদায মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৩. এ সভায়ই ভারতীয় প্রতিনিধি দল তাদের সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ সরবরাহ ও মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করে।
১৪. এখানেই রাজনৈতিক সরকার গঠনের প্রথম প্রস্তাব হয়।
১৫. কর্নেল এম এ জি ওসমানীর তৎপরতায় জননেতা তাজউদ্দীন আহমেদ অন্যান্য নেতৃবৃন্দসহ ১১ এপ্রিল আগরতলা এসে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করেন। স্থানটি ঢাকা-সিলেট সড়ক ও রেলপথের খুবই নিকটবর্তী এবং এখানে বিমান হামলার সম্ভাবনা থাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকির চিন্তা করে প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়।
১৬. ৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায়ই মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ও মূল কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়।
১৭. তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে অনুষ্ঠিত ৪ এপ্রিলের সভায় ৪ টি ও ১০ এপ্রিলের সভায় সমগ্র দেশকে ৬ টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলের জন্য একজন অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। তেলিয়াপাড়া সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত সভায়ই সাধারণ ছাত্র-জনতাকে স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণের মাধমে মুক্তিবাহিনীতে সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। যার ফলশ্রুতিতে মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে ইতঃপূর্বে সংগঠিত ছাত্র-যুবক সমন্বয়ে তেলিয়াপাড়াস্থ বাঁশবাড়ি ক্যাম্পে সর্বপ্রথম গেরিলা প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। প্রথম ব্যাচে এখানে ২০০০ যুবক দুসপ্তাহের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
১৮. মাধবপুর ও চুনারুঘাট এলাকায় ৩ নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর কে এম সফিউল্লাহর অধীনে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাক হানাদার বাহিনীর অন্তত ২০টি গেরিলা ও সম্মুখ সমর সংঘটিত হয়।
১৯. ১৯ মে পর্যন্ত তেলিয়াপাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে ছিল। কেবলমাত্র তেলিয়াপাড়া দখলে রাখতে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে হয়। এতে মোট ৮৩ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন; পক্ষান্তরে প্রায় ২১০ জন পাকসেনা নিহত হয়।
এ ছাড়া আরো অনেক ঘটনার জন্য তেলিয়াপাড়া চা বাগান মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
___________________________
ডা. কামরুল হাসান সোহেল :
আজীবন সদস্য, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ , কুমিল্লা জেলা।
কার্যকরী সদস্য স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ
আজীবন সদস্য,বিএমএ কুমিল্লা।
সেন্ট্রাল কাউন্সিলর, বিএমএ কুমিল্লা
আপনার মতামত দিন: