Ameen Qudir

Published:
2018-11-24 23:08:49 BdST

হোমিওপ্যাথি : প্রকৃত ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোর আগেই রোগী মারা গেল


সুব্রত নন্দী
_____________________


'কথায় আছে যার না থাকে কোন গতি সে ধরে হোমিওপ্যাথি'। অর্থাৎ যে কোন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি যখন প্রচলিত চিকিৎসায় আরগ্য লাভে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন তখন সেখানে শেষ ভরসায় আশ্রয় নেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার। সামান্য শর্দি কাশি জ্বর থেকে শুরু করে পাইলস আলসার টিউমার ক্যান্সারে বিনা অস্ত্রপচারে সুস্থ করে তোলার গ্যারান্টি দিয়ে দেয় হোমিওপ্যাথি। 'ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে' এমনভাবে কিছু রোগ আপনাআপনি সেরে গেলেও আমরা ধরে নিই যে হোমিওপ্যাথি আসলেই কার্যকরি। কিন্তু হোমিও চিকিৎসা যে কোন চিকিৎসা নয় নেহায়েত অবৈজ্ঞানিক টোটকা বা প্লাসিবো ( placebo) এবং কেবলমাত্র মনস্তাত্ত্বিক নিরাময় হওয়া ছাড়া এর আর কোন কার্যকারিতা নেই এটা এখনো অনেকেই জানেন না।


সতেরশ শতকে পৃথিবীতে যখন ঝাড়ফুঁক রক্ত বের করে কবিরাজি টোটকায় রোগ নিরাময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তখনই হোমিও চিকিৎসার সুচনা হয়েছিল। 1796 খৃষ্টাব্দে জার্মানিতে স্যামুয়েল হানিম্যান নামের এক ব্যক্তি হোমিওপ্যাথির মুলনীতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন হ্যানিমেনের ধারনা ছিল মানুষের দেহে রোগ বালাই হয়ে থাকে মূলত তাদের দেহে উদ্ভুত চারটি তরলের কারনে সেগুলি হলো কালো, হলুদ , রক্ত ও কফের জন্য । তো, তিনি বললেন ঐ পদার্থগুলোর বেসিক জিনিশ হলো দেহে খনিজ ও রাসায়নিক কিছু উপাদানের উপস্থিতি । এখন যদি আমরা ঐ খারাপ পদার্থ গুলোই বাইরে তৈরি করে তাদের লুঘু মাত্রার দ্রবন ( Low dilution levels) রোগীর শরীরে দিয়ে দিতে পারি তবে বিষে বিষক্রিয়ার ক্ষয়ের মত করে রোগ সেরে যাবে। গ্রীক শব্দ হোমিওস কথার অর্থ হলো "একই মতো" আর প্যাথি শব্দটির অর্থ রোগ। একই মতো রোগ বা রোগের জন্য দায়ী পদার্থের ঔষধ হলো হোমিও ঔষধ । অনেকটা ভ্যাকসিন তৈরির মতো। কিন্তু ভ্যাকসিনে অনুপরিমান কার্যকরী উপাদান ( active ingredient) থাকলেও হোমিওপ্যাথির উচ্চ মাত্রার তরলিকরনের ফলে বিজ্ঞান সম্মতভাবে সেখানে আসলে ঐ কার্যকরি উপাদনের লেশমাত্র উপস্থিত থাকে না। রোমান হরফে X দিয়ে এই লঘুকরন বোঝানো হয় । যেমন ধরুন কার্যকরী খনিজটি যে ফোটা পরিমান ব্যবহৃত হলো তার সঙ্গে বাহক হিসেবে জল, চিনি বা এলকোহলের দ্রবন এত বেশি পরিমাণে মিশিয়ে ঝাকুনি দিয়ে মিশ্রিত করা হয় যে রাসায়নিক ভাবে বিশ্লেষন করলে আপনি সেখানে কিছুই (ppm) পাবেন না। এক ভাগ মুল ঔষধের সঙ্গে দশ হাজার ভাগ, বিশ হাজার ভাগ, পন্চাশ হাজার ভাগ,এক লক্ষ দশ লক্ষ ভাগের বাহক ম্যাটেরিয়াল হিসেবে জল, সুগার, গ্লুকোজ, আর এলকোহলের ব্যবহার করা হয়। এই মাত্রা যত বাড়তে থাকবে ততই সে ঔষধ বেশি শক্তিশালী হবে আনবিক বোমার মত। তার সঙ্গে বিশেষ কায়দায় ছোট্ট কাঁচের বোতলটি মুঠোয় ধরে ঝাঁকুনি পর ঝাঁকুনিতে পাওয়ার বাড়তে থাকবে! এই হলো হোমিও ঔষধ ।


হোমিওপ্যাথি চিকিত্সার প্রমান হিসেবে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা এখনো চলছে তো ভাল না হলে উন্নত বিশ্বে আছে কেন। শুনে অবাক হবেন উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে প্রায় চৌদ্দ হাজার হোমিও স্কুল ছিল সেগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। 1920 সালে সর্বশেষটি বন্ধ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের FDA ( foods and drugs administration) ফার্মাকোপিয়ায় কিছু হোমিও ঔষধের স্বীকৃতি থাকলেও এগুলি যে রোগ সারায় তার কোন দায়িত্ব তারা নেন না। প্লাসিবো শব্দের অর্থ নকল ওষুধ বা রোগী ভোলানো ঔষধ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্লাসিবো নেবার একটি ঘটনার কথা বলি। ঢাকার এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ সোহরাবুজ্জামান আমার উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা করতেন । হঠাৎ একদিন আমার মনে হল আমি বুক ব্যথায় মরে যাচ্ছি । সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঢাকার হৃদরোগ হাসপাতালে গিয়ে তাকে খুজে বের করে কান্না জুড়ে দিলাম যে আমাকে বাঁচান। তিনি আমার ইসিজি করে ভালমত দেখে বললেন এখুনি সেরে যাবে শান্ত হয়ে এখানে শুয়ে থাকুন। তিনি আমাকে একটা বড় চিনি জাতীয় টেবলেট দিয়ে চুষে খেতে বললেন । আমি খেলাম তারপর কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সেরে গেছে? আমি বললাম একদম সুস্থ । তিনি বললেন আপনার আসলে কিছুই হয়নি। ঔষধটা ছিল চকলেট জাতীয় একটি প্লাসিবো। এরপর এমন করলে আপনাকে মনস্তাত্ত্বিক ডাক্তারের কাছে পাঠাবো। হোমিও চিকিৎসা ঠিক এমনিই ।


বাঙালির হৃদয়ে হোমিওপ্যাথির আধিপত্য সেই আঠারো শতক থেকে। উনিশ শতকে আপনি এমন বাঙালি খুঁজে পাবেন না যার বাসায় ধর্ম গ্রন্থের মতো মেটিরিয়া মেডিকা( Materia Medica) বা হোমিও চিকিৎসার হ্যান্ডবুক থাকতো না। একটি ছোট্ট কাঠের কিট বক্সের ভেতর ডজন দুই তিন হোমিও ঔষধ থাকতো যা দিয়ে তারা সহস্র রোগের ওষুধ বানিয়ে দিতেন। আমার এক পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক তাঁর বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর আগে যদি একটু আধটু হাঁচি কাশির শব্দ পেতেন তো বলতেন..নে এবার হা কর। আমরা সব ছাত্ররাই ওনার কাছে ফ্রি চিকিৎসা পেতাম।
হোমিও চিকিৎসা নিয়ে কিশোর কুমারের একটি গান আছে.. . ..মেটিরিয়া মেডিকার কাব্য ওওওওত। এখান থেকে বোঝা যায় উনিশ শতকের বাঙালি মানেই এক একজন হোমিও চিকিৎসক!


বাঙালির কাছে হোমিও চিকিৎসার গ্রহণযোগ্যতা হলো এর কোন সাইড এফেক্ট নাই, সস্তা এবং সহজলভ্য । ঔষধ হিসেবে হোমিওপ্যাথির কোন এফেক্ট বা কার্যকারীতাই যখন নাই তখন আবার এর সাইড এফেক্ট কিসের! হোমিও চিকিৎসা মানেই জল আর এলকোহল বেচা ব্যবসা। এক বোতল ইথাইল এলকোহলের দ্রবন লঘু করতে করতে এরা সেটা এক লক্ষ টাকায় বেচেন। বাংলাদেশের সহজ সরল মানুষের মধ্যে এখনো এই বিশ্বাস আছে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় কাজ হয় আর এই বিষয়টি পুঁজি করে মানুষকে ফাকি দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাই করছেন এক একজন হোমিও চিকিৎসক যাদের অনেকের বিজ্ঞান সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান নাই। গল্প কেচ্ছা কাহিনী দিয়ে এরা সকল রোগের চিকিৎসার গ্যারান্টি প্রদান করেন মাঝখান থেকে অর্থ ও সময় নষ্ট করে প্রচলিত চিকিৎসায় ফেরার আগেই রোগী মারা যায় । ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেল গল্পটি এখানে খুবই দৃষ্টান্তমূলক ।
___________________________

সুব্রত নন্দী । সাংবাদিক, সুলেখক।
Worked at Prothom alo
Works at Freelance Journalist ,Columnist,Writer,Dramatist
Former Senior Soil Scientist at Bangladesh Agricultural Research Institute
Studied MS in Soil Science at Bangladesh Agricultural University
________

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়