Ameen Qudir

Published:
2018-11-22 22:44:49 BdST

সুস্থ থাকবেন কেমন ক'রে, সহজ পথ বাতলে দিলেন ডা. সিদ্ধার্থ




ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
___________________________

একজন মানুষ জীবনে কি চায়? টাকা, সুখী পরিবার, জ্ঞান, কিছু যশ বা সুনাম, নিশ্চিত বৃদ্ধাবস্থা, সন্তান দের প্রতিষ্ঠা, দেশে বিদেশে মিলে কয়েকটি নামী বা অনামা জায়গায় ঘুরে আসা, সুখাদ্য এবং পানীয় গ্রহণ করা। ব্যস???
নাহ্। সে চায় একটি তুলনামূলক রোগমুক্ত, কর্মঠ জীবন ও যাতে যথাসম্ভব দেরি করে বা আদৌ কখনো প্রাকৃতিক কাজকর্মের জন্য ও অপর কারো ওপরে নির্ভরশীল হতে না হয়।
সত্যি জিজ্ঞাসা করে দেখুন শতকরা ৯০% মানুষ ই রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, বা মারাদোনা কি ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো বা ভিরাট কোহলি কি রোহিত শর্মা বা নরেন্দ্র মোদী কি মমতা ব্যানার্জি হওয়ার কথা চিন্তাই করে না।
প্রথমটি অর্জন করতে গেলেও কিন্তু কিছু হোম ওয়ার্ক করে নেওয়া টাই বুদ্ধির কাজ। অবশ্যি কেউ বলতে পারেন, কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করেও তো অমুক বাবু কি তমুক দিদি দিব্যি আছেন। আজ কলকাতা, কাল পারি, লন্ডন, সেশেলস, ফ্লোরেন্স, জ্যনেভ, বের্লিন, নায়েগ্রা, মেহিকো বা পেরু ঘুরছেন। হ্যাঁ মানছি। অমন ও হয়। কিন্তু এইবারে বলবো এমন টি শতকরা কত জন। ( আপনি আমি কেউ জানিনে তাঁদের মধ্যে কারা কারা শরীর নিয়ে কখনো মাথা ঘামান নি, 'ফেস লাইভ অ্যাজ ইট কামস ' এই মনোভাব নিয়ে বসেছিলেন।) জানিনা, তাই অমন ভাবি বা বলি।

আপনি আপনার পুত্র বা কন্যা বা পুত্রকন্যাদের কি শিশু চিকিৎসক এর কথামতো পোলিও, ট্রিপল অ্যান্টিজেন, এম এম আর দিয়েছিলেন তো? চিকেন পক্স সচরাচর ভয়ংকর হয় না, তবুও তার ভ্যাকসিন দিইয়েছেন। বাড়িতে আর ও না হোক আরো ওয়াটার পিউরিফায়ার লাগাননি? যদি পথে তৃষ্ণা লাগে তখন বাড়ি থেকে জীবাণুমুক্ত ও পরিশ্রুত জলের বোতল নিয়ে যান কি যান না? আপনার কোন আত্মীয় বা পরিচিত কারো কে পথের কুকুর বা বেড়াল কামড়ালে বা আঁচড়ালে, অ্যান্টি র‍্যাবিস ইনজেক্সন, দামী হলেও দিতে বাধ্য করেন কি করেন না, দাম ঢের হলেও।
কেন করেন বা করান এইসব? যতই অস্বীকার করুন কারণ আপনার জানা। আমাদের শরীর যদি বেহাল হয়, বাকি সবই অর্থহীন।
বাল্যে স্কুলে রচনা লিখতে হতো স্বাস্থ্যই সম্পদ বা হেলথ ইজ ওয়েলথ বলে। আমি আবার পাকামো করে ইংরেজি রচনা তেও দেবনাগরী হরফে " শরীরমাদ্যং খলু ধর্মসাধনম " লিখেছিলুম। আমাদের স্যার কিন্তু কেটে দেন নি। বরং নম্বর একটু বেশী ই দিয়েছিলেন।
এই অবধি সব ই ঠিক আছে, কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রে চল্লিশের উপান্তে পৌঁছে, নারীদের ক্ষেত্রেও তাইই ( আজকাল কত শতাংশ শিক্ষিতা নারী ই বা বাড়িতে বসে শুধুই ঘরদোর সাফ করেন?) । একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে জীবনের মধুরতম বয়েস টি ওইরকম ই, আরো খোঁচাখুঁচি করলে বলবো ৩৭।
কারণ, অ্যাদ্দিনে একটি নিজ বাড়ির মালিক হয়েছেন, একটি চারচক্রযানের ও অধিকারী হয়েছেন, পুত্র বা কন্যা ও একটু বড় হয়েছে, তারা স্কুলে টুলে ভালোই ফল করছে।
আপনারো মন টি দিব্যি ফুরফুরে। যা খাচ্ছেন সঅব হজম হয়ে যাচ্ছে, সুধা খেলে দিব্যি স্বর্গে আছি টাইপের ফিলিং হচ্ছে, ব্রান্ডেড পোষাক, জুতো পরছেন, সুখী - সফল ভাব চকচকে মুখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে। বাহ।

এখন তো সবকিছু ই ঠিকঠাক,কিন্তু নদী দিয়ে জল যে বহে চলেছে, ক্যালেন্ডার গুলোও পালটে যাচ্ছে। সময় বহে যাচ্ছে, বয়স বাড়ছে। আরো ১০- ১২ বছর পরে যে ৫০ এর কাছে পৌঁছবেন। তখনো শরীর সুস্থ থাকবে তো? সিঁড়ি তে চারতলা উঠে হাঁফ ধরবে না তো? পাক্কা?
কি করে জানলেন, আইজ্ঞা?
আমাদের যে বর্ধিত আয়ু তা কিন্তু উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের দান। কিন্তু কিছু প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি যে মেনে চলতেই হবে।
প্রধানত এই সাফল্যের সঙ্গী হয়, স্থূলতা ( আদিখ্যেতা করে চেহারা ভালো বলে লাভ নেই কোন) , একাধিক থুতনি, আর শরীরের মধ্যপ্রাচ্যে স্নেহপদার্থের আধিক্য শরীরের আগেই চলবে সর্বদা ; এই গুলি কিন্তু ভালো নয় আদৌ।
রহু ধৈর্যং, কেন ভালো নয় বলি।

১। এই বয়সেই বাড়ে রক্তচাপ, রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল এর কোলাহল।
২। ডায়বেটিসের পরী এসে কপালে টি দিয়ে যায়।
৩।যত ই খাওয়া হোক না কেন আরো খেতে ইচ্ছে করে। মোরে আরো আরো আরো দাও....
তাহলে সব্বাইকে ই ৩৫ এর কোঠা পার হলেই কিছু পরীক্ষা করে নিতে হবে। প্রথমে একজন চিকিৎসক কে দেখাবেন। তিনি দেখে নেবেন আপনার শরীরে, আপনার উচ্চতায়, আপনার বয়সে ঠিক কত ওজন হওয়া উচিত। তিনি ব্লাড প্রেসার টি দেখবেন, আপনার থাইরয়েড অন্তক্ষরী গ্রন্থির অবস্থা জানার জন্যে পরীক্ষা করবেন৷ যদি মধ্যপ্রাচ্যের ঔদার্য নাতিবৃহৎ হয়ে থাকে, পেটের একটি উলত্রাসনোগ্রাফী করাতে বলবেন, হৃদয়ের দূর্বলতা 'নেগেট ' করার জন্যে উপযুক্ত পরীক্ষা করাতে বলবেন, রক্তের কিছু পরীক্ষা করাতে দেবেন।
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এই রে এখনকার ডাক্তার রা কথায় কথায় পরীক্ষা করতে বলেন, নাড়ী টিপে কিছুটি বুঝতে পারেন না৷ এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ছিলেন অমন নামী সদাহাস্যোজ্জ্বল ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, রোগী দেখেই অসুখ টি ধরে ফেলতেন।
এখানে আমার দুইখান কতা আসিলো। ১. বিধান রায় কি দু বছর অন্তর মোবাইল পাল্টাতেন না ৪ বছরের মাথায় গাড়ি বদল করে নতুনতর প্রযুক্তির গাড়ি চড়তেন? ২.বিধান রায়ের আমলে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষ দের গড় পরমায়ু কত ছিল আর এখনই বা তা কতো?
প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরোতো জানা।
মনে হতে পারে, ধুস এতো টাকা খরচ খামোকা করবো কেন, আমি সুগার টি আর ব্লাড প্রেসার টি দেখিয়ে নি। এমন মানুষ ই সংখ্যাগুরু। এঁরাই কিন্তু কয়েক মাসের শিশু পুত্র বা কন্যা কে বার বার ইঞ্জেকশন দিয়ে ভ্যাকসিন দিইয়েছেন, তারপরে জ্বর আর বাচ্চার ঘ্যানঘ্যানানি হবে, বিলক্ষণ তা জেনে।
নামী স্কুলে ভর্তি করার জন্যে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ফর্ম নিয়েছেন।
জীবন আপনার, সিদ্ধান্ত ও আপনার। তবে, ইয়ে মানে পরীক্ষা গুলো করিয়ে নেওয়াই বোধহয় ভালো।
কারণ, আজ অবধি, কোন বড় অসুখ বিসুখ কারো জীবনেই, কখনো আগে থেকে বলে কয়ে বা ক্যালেন্ডার দেখে আসেনি কিন্তু।
এবারে, চিকিৎসক এর কথা অনু্যায়ী ওষুধ পত্র খাবেন। নিজের ওজন খুব একটা বাড়িয়ে লাভ নেই কোন, কারণ বেশি টাকা বা শেয়ার বা সোনা, হীরে ইত্যাদি ভালো, কারণ তাকে সুরক্ষিত রাখা সহজ এবং তাকে বহে বেড়াতেও হয় না সর্বদা।
নিজের ওজন কিন্তু নিজেকেই বহে বেড়াতে হয়, কারণ এটির ভার সহযোগী বা সেক্রেটারি র হাতে দেওয়া কোন অর্থেই দেওয়া সম্ভব নয়।
বাড়তি ওজনের প্রধান কারণ ঘুমানো বাদ দিয়ে সারা দিন কিছু না কিছু খেয়ে যাওয়া। আমাদের শৈশবে সাধারণত স্কুলে যাওয়া ছেলে মেয়েরাও ( বাড়ন্ত বয়সের ছেলে মেয়েরা) দিনে রাতে বার তিনেকের বেশি খেত বলে মনে পড়ে না। স্কুলে যাওয়ার আগে ভাত খেয়ে যাওয়া, স্কুল থেকে ফিরে আরেকবার ভাত বা রুটি খাওয়া আর রাতে ১০ টা নাগাদ রাতের খাওয়া, ব্যাস। আমার স্কুলের জীবনেও টিফিন নামক ছুটি ছিল, এমনকি ক্লাস সিক্স থেকে দুবার করে টিফিন ও হতো, আমাদের ভাষ্যে ফার্স্ট টিফিন আর সেকেন্ড টিফিন, আমরা মাঠে ঘুরে বেড়াতুম, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরী তে গিয়ে গল্পের বই পালটে নতুন গল্পের বই নিতুম, কিন্তু জলপান বিনে আর কিছু করতুম বলে মনে তো পড়ে না। সহপাঠী রাও কেউই টিফিন আনতো না ; ভাত খেয়েই স্কুলে যেতুম কিনা।
বাড়িতেও সারা দিনে আটবার খাওয়ার পাট ছিলো না। খুব কি অপুষ্টি তে ভুগেছি আমরা কেউ? মনে তো পড়ে না।
এইসব লেখার উদ্দেশ্য ই হলো নিজের জীভ কে সংযমে রাখা, দিনে ৩ বার খাওয়াই যথেষ্ট এবং এর মাঝে শুধুই জলপান ( বাংলা অর্থে, হিন্দীতে জলপান মানে জলখাবার) ।
সব রকম, সব ভাবেই তামাক শরীরের জন্য আদৌ ভালো নয়, বর্জন করাই কাম্য।
মনে রাখুন যতোবার আপনি খাবেন, ততবার ই ইনসুলিন ক্ষরিত হবে এবং এই ইনসুলিনের অন্যতম কাজ হলো মেদবৃদ্ধি ঘটানো। চা বা কফি খেলেও তাইই, যদি না লিকার চা বা লিকার কফি হয়।
এরপরে ওষুধপত্র নিয়ম মেনে খান আর, নিয়ম মতো ডাক্তারের কাছে যান।
আর, আমার নিজের অভিজ্ঞতায় বলি যা হওয়ার তা হবেই, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ তো নেইই বরং ক্ষতি। একটি গান শোনা, বা বই পড়ার মতো অভ্যাস তৈরী করুন। যদি নিজে গান গাইতে বা বাজনা বাজাতে পারেন, তো আরো ভালো। লিখতে পারেন যারা, সে কবিতা হোক কি প্রবন্ধ কি উপন্যাস, আরো ভালো। ছবি আঁকতে পারলেও ভীষণ ভালো।
মাঝে মাঝে কোথাও কোন কাজ ছাড়াই বেড়িয়ে আসুন। প্রকৃতি যেখানে উন্মুক্ত, অসীম, দূষণহীন। তিন চার দিনের জন্য অন্ততঃ। এটিও সুস্থ শরীর ও মনের জন্য ভারি প্রয়োজনীয়।
ভালো, অন্য পেশার বন্ধুর সাহচর্য ও খুব স্বাস্থ্যকর। সময় দিন আপনার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গিনী কে। আপনার পুত্র কন্যাকে।
অন্য আত্মীয় স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখুন। মনে রাখুন আপনার বয়স যত বাড়বে, এঁদের সংখ্যাও তত ই কমতে থাকবে, জীবনের নিয়মে।
আমার জ্ঞানবুদ্ধি অভিজ্ঞতায় আর কিছু নির্দেশ তো আর মাথায় আসছে না।
ভালো, সুস্থ থাকুন সক্কলে। নমস্কার।
___________________________

ডা. সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
সুলেখক । কবি।

Diabetes & Endocrinology Consultant
M.D. at University of Madras । প্রাক্তন :
Calcutta National Medical College and Madras Medical College (MMC

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়