Ameen Qudir

Published:
2018-10-25 02:10:33 BdST

ঢাকায় বিশ্বের বৃহত্তম বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের যাত্রা শুরু



ডা. সুনীতি কুমার সাহা

___________________________

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য; যেমনটা বলেছিলাম, ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় বিশ্বের বৃহত্তম একটি হাসপাতালের যাত্রা শুরু হল। আজ ২৪ অক্টোবর, ২০১৮ সাল সেই মাইলফলক ক্ষণ। লাখো আগুন পোড়া রোগীর কান্না কষ্ট উপশম করতে মহান এই হাসপাতাল চালু হল।


এদিন আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় বিশ্বের বৃহত্তম বার্ন ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রমান করলেন , বাংলাদেশ ও বাঙালী মাথা নোয়াবার নয়। তারা বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠ কীর্তি দিয়ে মাথা উঁচু করল।
শুধু বাংলাদেশ নয়, উপমহাদেশের বার্ন রোগীরাও উন্নত চিকিৎসা পাবেন এখানে। সিঙ্গাপুরের সঙ্গে চিকিৎসা সহযোগিতা বিনিময়ের চুক্তির কথাও রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রয়াস , উদ্যোগ ও কল্যাণ প্রচেষ্টায় এই মহাযজ্ঞ সম্পন্ন হল। তিনি চিকিৎসা কল্যাণ মানবতার দিশারী।
ইতিহাসে এই মহত্তম কাজের সঙ্গে একজন ক্ষণজন্মা চিকিৎসক মহাপুরুষের নাম লেখা থাকবে ; তিনি হলেন উপমহাদেশের গৌরব , আগুন পোড়া রোগীর পরম ভরসা অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন।
তিনি লাখো রোগীর প্রাণে দিয়েছেন বাঁচার আশ্বাস; তেমনি এই মহাকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে অাগামীর কোটি কোটি রোগীর হৃদয়ে তার নামও চিকিৎসক হিসেবে অক্ষয় হয়ে থাকবে।

বুধবার ২৪ অক্টোবর সকালে রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন নিমতলীতে শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ১৮ তলা ভবনটির উদ্বোধন করেন তিনি।


বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বল্প পরিসরে একসময় মাত্র ৫টি বেড নিয়ে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা চলত। সেই পাঁচ বেডকে অক্লান্ত পরিশ্রম ও অদম্য স্বপ্নে সামন্তলাল স্যার ৫০০ বেডের বিশাল হাসপাতালে রূপান্তর করলেন। শেখ হাসিনা ন্যাশনাল বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনের ফলে এখানে ৫০০ শয্যায় চিকিৎসা সেবার বিশাল যজ্ঞের উন্মোচন হলো।
গণমাধ্যমকে সামন্ত স্যার জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধীনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইনস্টিটিউট, যেখানে একইসঙ্গে চিকিৎসা, সেবা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণার সব সুযোগ রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল এই ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং মূল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল।

 

 


৫ বেড থেকে ৫০০ বেডের অদম্য স্বপ্ন বাস্তবায়ন যেভাবে

______________________


অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন স্যার মিডিয়ার কাছে খুলে বললেন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাহিনি। স্যার বলেন,

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘৩৫ বি’ বলে একটা ওয়ার্ড ছিল। মাত্র পাঁচটা বেড বার্ন রোগীদের জন্য আলাদা করে চিকিৎসা শুরু করেছিলাম। একটা আলমিরা আর একটা চেয়ার-টেবিল ছিল। সেই আলমিরা এখনও আমার কাছে রয়েছে। আর এখন আমরা যাচ্ছি ৫০০ শয্যার ইনস্টিটিউটে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধীনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের দায়িত্বে রয়েছেনঅধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন।মিডিয়াকে স্যার বলেন,
বাংলাদেশের চিকিৎসকদের মেধা-দক্ষতা সব আছে, প্রয়োজন শুধু সুযোগের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। তার কাছে আমরা ঋণী, তিনি আমাদের এত বড় ভবন দিয়েছেন, বিশ্বের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হচ্ছে, একটি ইনস্টিটিউটে প্রায় ২ হাজার দুইশ পদ সৃজন করা হয়েছে।

পরম সন্তোষে তিনি বলেন, একজন প্রধানমন্ত্রী যদি এ ধরনের সাপোর্টে দেন, তাহলে আমরা সবাই অনেক বল পাই, আমাদের সাহস অনেক বেড়ে যায়।

 

ড. সামন্ত লাল সেন জানান, ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন ড. রোনাল্ড জোসেফ কাস্ট আসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। তখন একজন প্লাস্টিক সার্জন জরুরি বলে সেখানে লুধিয়ানা থেকে আসেন পারভেজ বেজলিন। এটাই ছিল বাংলাদেশে প্লাস্টিক সার্জারির প্রথম কনসেপ্ট।
তখন আমি তরুণ চিকিৎসক। চোখ ভরা স্বপ্ন— চিকিৎসা করতে এসে, রোগীদের সংস্পর্শে এসে বদলে গেল আমার সেই অনেক টাকা আর বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন।


তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেই। দেখি, দগ্ধ রোগীরা জায়গা পাচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়, মেঝেতে, বাথরুমের পেছনে মশারি টানিয়ে। অথচ এসব রোগীরা খুবই সংবেদনশীল, একটু সংক্রমণেই তাদের আরও সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্লাস্টিক সার্জন ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ স্যার যোগ দিলেন ১৯৮২ সালের দিকে। তখন আমাদের শিক্ষক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কবীরউদ্দিন স্যার বলতেন, সামন্ত, বার্ন রোগীদের জন্য কিছু করো। এসব রোগীরা হাসপাতালের এখানে-সেখানে পরে থাকে। ১৯৮৬ সালের দিকে সরকারের কাছে আবেদন করি পৃথক একটা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জন্য। সেই কাগজটা এখনও আমার কাছে আছে।

২০০১ সালে ঢামেকে এই ইউনিট পৃথক হয়ে একটি ভবন হয়। কিন্তু এখানে তখন একটা বস্তি ছিল। সেই বস্তি সরাতে গেলে আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়, হুমকি দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকারের সহায়তায় বস্তি সরিয়ে এই ভবন তৈরি হয় এবং ২০০১ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে কার্যক্রম শুরু হয়। আর এটি এখন ৩০০ শয্যার হাসপাতাল।ভগবানকে সবসময় বলেছি, আমাকে আরেকটু বাঁচিয়ে রাখো, যেন হাসপাতালটা বানিয়ে মরতে পারি।

বার্ন ইনস্টিটিউটের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রকল্প মেয়াদ অনুযায়ী, কাজ শেষ হওয়ার কথা এই বছরের ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় দুই মাস আগেই উদ্বোধন করা হয়।
অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ এই ইনস্টিটিউটে থাকছে একশটি কেবিন। হাইডেফিসিয়েন্সি ইউনিটে থাকছে ৬০ বেড, ১২টি অস্ত্রোপচার থিয়েটার এবং অত্যাধুনিক পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড। বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারির অত্যাধুনিকচিকিৎসা এখানে দেওয়া হবে।

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বার্ন ইনস্টিটিউট। এই বিষয়ে এত বড় বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট পৃথিবীর আর কোথাও নেই। কারণ, বাংলাদেশে যত মানুষ দগ্ধ হয়, বিশ্বে আর কোনো দেশে এত মানুষ দগ্ধ হয় না। দুই একর জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে ১৮ তলা ভবনের এই ইনস্টিটিউট। মাটির নিচে তিন তলা বেজমেন্ট রাখা হয়েছে। গাড়ি পার্কিং ;রেডিওলজিসহ আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভাগ থাকবে সেখানে। বহুতল এই ভবনটি তিনটি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে- একদিকে থাকবে বার্ন, অন্যদিকে প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট আর অন্য ব্লকটিতে করা হবে একাডেমিক ভবন। দেশে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারি হাসপাতালে হেলিপ্যাড সুবিধা রাখা হচ্ছে।


জানা যায়, জন্মগত ঠোঁটকাটা-তালুকাটা, আঙুল জোড়া লাগানো, পায়ের ত্রুটি, ক্যান্সার, দুর্ঘটনা, ট্রমা, হাত-পা সার্জারিসহ একটা বড় অংশ বার্ন ইউনিটে আসে। এজন্য দেশে প্লাস্টিক সার্জন দরকার ন্যূনতম চারশ জনের মতো। কিন্তু বাংলাদেশে এখন প্লাস্টিক সার্জন রয়েছেন ৬৫ জন। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বের হবেন ৮০ জনের মতো। এখন আমাদের লক্ষ্য, আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে এই ইনস্টিটিউট এবং ঢামেক হাসপাতালের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ প্লাস্টিক সার্জন তৈরি এবং নিয়োগ দেওয়া।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়