Ameen Qudir

Published:
2018-09-23 21:32:11 BdST

সি এম এইচ : সর্বোত্তম চিকিৎসা,সেবা যত্ন,ভালবাসা ও নিরাপত্তা মেলে যেখানে




মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ

___________________________

মেঘে মেঘে বয়স কম হল না! ভাবলাম ' থরো চেক আপ' করিয়ে নেই। ইউরোলজি বিভাগে গেলাম।আলট্রাসনো করবার সাজেশন দিলেন কর্নেল শামীম ওয়াহেদ। কাগজ নিয়ে হাজির হলাম রেডিওলজিষ্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জহিরের কাছে।হাতের রোগী শেষে আমার ডাক পরলো। স্ক্রীনে চোখ রেখে তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, 'আল্ট্রাসনো করা দরকার পরলো কেন? বুঝলাম গড়বড় কিছু একটা পাওয়া গেছে। রিপোর্ট আমাকে না দিয়ে এক্স রে করতে পাঠালেন তখনই। ' আর্জেন্ট ' লেখায় সাথে সাথে রিপোর্ট হল। রেডিওলজিষ্ট ফাইনাল অপিনিয়ন দেয়ার আগে নিজেই আমাকে সিটি স্ক্যান রুমে নিয়ে গেলেন।সিটি হল। ব্রিগেডিয়ার জহির জানালেন, ইউরিনারি ব্লাডারে পাথর। সাইজ ১'৪ সেমি। এ ছাড়াও ডান কিডনিতে খুব ছোট আকারের পাথরও পাওয়া গেল। তিনি প্রায় ' বাই অর্ডারে' তখনই ইউরোলজি বিভাগে পাঠালেন।

২।কর্নেল শামীম ওয়াহেদ রিপোর্ট - এ চোখ রেখে বললেন,' তুমি নিজেই ডাক্তার।সবই বোঝ । পাথর সরানো দরকার।স্পাইনাল এনেস্থিসিয়া লাগবে। আজ সোমবার, দুদিনে প্রি এনেস্থিটিক চেক আপ করিয়ে নাও,বুধবারে অপারেশন টেবিলে উঠবে। ' দুদিনে ডিপার্টমেন্ট ঘুরে ঘুরে বুকের এক্স রে,ইসিজি,হেমাটোলজিক্যাল প্রোফাইল করে এনেস্থিসিয়ার কর্নেল মাসুদের কাছে হাজির হলাম। নিজেই ওজন নিলেন, রিপোর্ট - এ চোখ বোলালেন।ঘষঘষ করে কাগজে স্পাইনালের জন্য ফিট করবার কাগজে সাইন করে দিলেন।স্মিত হেসে জানালেন এটা একটি ছোট প্রক্রিয়া। নির্ভার করলেন উষ্ণ কন্ঠে।

৩।ভর্তি হলাম। ঠাঁই মিলল অফিসার্স ওয়ার্ড,রুম ৪১৯-এ। রুমের আরেকটি নাম কীর্তন খোলা। আহা নদীর নামে নাম।ছবির মত সাজানো রুম। ঝকঝকে বিছানা। পরিস্কার টয়লেট, একচিলতে বারান্দা। রুমের সাথে অভিযোজিত তাপমাত্রায় এসি,দেখবার টেলিভিশন।টুকটাক রাখবার জন্য ছোট ফ্রিজ। কোথাও একটুও ধুলাবালি নেই। রাতে হাল্কা খাবার। পরের দিন ও টি। সকালে আমার কোর্সমেট মেডিকেল কলেজের বন্ধু কর্নেল আজিজ শুভ সকাল জানিয়ে ঘুম ভাঙাল। এরপর আমার স্ত্রী,সন্তান, মা-বাবা,ভাই-বোন সবাই একে একে এলো। এত মমতা, এত ভালবাসা। ' বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ'।'দশটার দিকে ওটিতে ডাক পরল। ট্রলিতে উঠতে ওটির এসিস্ট্যান্ট পরিচয় দিয়ে বললো, ' স্যার, আপনার সাথে উইন্টার কালেকটিভ এক্সারসাইজ করেছি। ' পৃথিবী গোল। সব ফিরে ফিরে আসে। আমাকে কনসালটেন্ট সার্জনের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। সাহস দেয়া কন্ঠে নিরাপদ ওটির শুভ কামনা করলেন।পাশেই ছিলেন ইউরোলজি বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার শহীদ। তার মুখেও এক চিলতে মিষ্টি হাসি। পথে সন্মানিত ডি জি এম এস মহোদয়ের সামনে পরে গেলাম।স্মিত হাস্যে অগ্রজের স্নেহার্দ কন্ঠে কুশল জানতে চাইলেন।

৪।ওটি তে তুলতে তুলতে কর্নেল শামীম আস্থাভাজন কন্ঠে ' এটি সামাণ্য এন্ডোস্কপিক প্রসেজিওর মাত্র ' বলে সাহস আরেকদফা বাড়ালেন।এনেস্থেসিয়ায় ছিলেন কর্নেল আসকার । তাঁর রসবোধের সুনাম বিশ্ব জোড়া। আলাপ চারিতার এক পর্যায়ে দরদভরা কণ্ঠ - এ গাইলেন' বেদের মেয়ে জোছনা আমায় কথা দিয়েছে। 'আমিও সমস্বরে গেয়ে জানিয়ে দিলাম,' জোছনা আমাকেও কথা দিয়েছে।' মনিটরে সব ভেসে উঠছে। এটা ব্লাডার,এই যে সেই পাথর-++ ঘুম পাচ্ছে,বড্ড ঘুম পাচ্ছে।

৫।জেগে দেখি পোষ্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড। মনিটরে ভাইটাল প্যারামিটার সব ডিসপ্লে হচ্ছে। বার্তা এলো, সি এম এইচের কমান্ড্যান্ট আসছেন।এলেন।কুশল জানতে চাইলেন।কোথাও কোন অসুবিধে হচ্ছে কি না ইঞ্চি ইঞ্চি করে তার খবরই শুধু নিলেন না নিজে সরজমিনে যেন ' চেকলিষ্ট ' মিলিয়ে নিলেন।প্রতিনিয়তই নার্স খোঁজ খবর নিচ্ছে ডিউটি ডাক্তার ষোলো আনা সন্ধানী চোখ রাখছে।কর্নেল মাসুদ,কর্নেল শামীম দুজনই হালনাগাদ থাকছেন।বিকেলে স্যুপ দেয়া হল। পরিস্কার তৈজসে স্যুপ মিষ্টি ঘ্রান ছড়াচ্ছিল। সবাদু সেই স্যুপ পিপাসা মেটালো,রসনাও বিলাস হল। রাতে টয়লেটে যাবার দরকার হল। মেডিকেল এসিট্যান্ট পরম মমতায় ধরে ধরে টয়লেটে নিয়ে গেলো। এন সি ই আগেই সেটিকে ঝকঝকে করে রেখেছিল।নিরাপদে রাত পেরুলো। আবার ওয়ার্ড।

৭।সকালের নাস্তায় চার টুকরো ব্রেড । ,জ্যাম,বাটার, ফল,কর্ণ ফ্লেক্স । চোখের ক্ষুধা,পেটের ক্ষুধা দুইই মিটলো। গরম চা শরীরকে ঝরঝরে করে তুললো। আমার অধিনায়ক ' কার্টিয়াস অফিসার ' হিসেবে বিশেষ আদৃত।নানা মৌসুমি ফল দিয়ে বিশাল এক ফ্রুট বাস্কেট সাজিয়ে নিয়ে হাজির। আন্তরিক কন্ঠে খুঁটিনাটি সব জেনে নিলেন।অফিসার্স কোয়ার্টার থেকে আমার স্ত্রী, পরিবার প্রয়োজনে সি এইম এইচে যেন আসতে পারে তার জন্য ট্রান্সপোর্ট -এর ব্যবস্থা করলেন।সন্ধ্যায় কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল Md Mahbubur Rahman আসলেন।উনার হাতেও বিশাল ফ্রুট বাস্কেট। চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রোগীর পক্ষ হতে কোনই অভিযোগ নেই। কোন অমর গান বাজবার সময় তার গীতি কবিতা, সুর, গায়ক, বাদ্য যন্ত্র'র যেমন সুষম মিশেল হয়, সবখানে যেন আনুপাতিক হারে সবটাই ছিল।

৮।ক্যাথেটার একটু অস্বস্তি এনেছিল। এটুকুকে মেনে নিতে হবে, সেটি মেজর আলম আরেকবার বুঝিয়ে দিল। ১৫ তারিখ ইরিগেশন বন্ধ করে দেয়া হলেও মুত্র দিয়ে রক্ত যে যাচ্ছে না সেটি নিশ্চিত হওয়া হল। ১৬ তারিখ ক্যাথেটার খুলে সবাভাবিক প্রচ্ছাব করতে পারলাম। ডিসচার্জ করা হল। কাঁচের জানলা দিয়ে দূরে দেখবার চেষ্টা করছিলাম।১১ সেপ্টেম্বর ভর্তি হয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর ছাড়া পেলাম।মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী ।হাসপাতালে সকল রোগীই কম বেশি ভয় পায় ।অথচ হাসপাতাল ছেড়ে দিতে হবে ভেবে কি ক্ষণিকের তরে মন খারাপ হল ?সি এম এইচের ইট কাঠ পাথরের মায়ায় কি পরে গেলাম ?

৯।এই পাঁচ দিনে একজন রোগী সুইপার থেকে শুরু করে চিকিৎসক এমন কি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে যে সব সেবা যত্ন আশা করে আমি তার শতভাগই পেয়েছি ।রোগী হিসেবে চিকিৎসক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দুই একটা অভিযোগ থাকতেই পারে ।ভুল না থাকলে ,প্রত্যাশা পূরণ হলে আমি কি ভাবে অভিযোগ জানাবো ?

১০।দেশ বরেণ্য কথা সাহিত্যিক আশরাফ সিদ্দিকীর অমর লেখনী 'গলির ধারের ছেলেটি' র কাহিনী নিয়ে সুভাষ দত্ত রচনা করেন 'ডুমুরের ফুল ' । সেখানে গরীব এক ছেলে হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি পেটপুরে খাবার। সুযোগ পায়।রিলিজ হলে সেই খাবার দেয়া বন্ধ হবে জেনে সে সিস্টারকে 'হাসপাতালে স্থায়ীভাবে থাকবার কোন ব্যবস্থা আছে কি না 'সেটি জানতে চায় ।বিরক্ত হয়ে নার্স বিষাক্ত টিংচার আয়োডিনের শিশি দেখিয়ে বলে এইপাত্রের ওষুধ খেলে সারাজীবন হাসপাতালে থাকা সম্ভব।সিস্টারের দুষ্টুমি ভরা কথা সরলভাবে বিশ্বাস করে ছেলেটি চুরি করে টিংচার আয়োডিন খেয়ে মৃত্যুর কবলে ঢলে পড়ে ।যাপিত জীবনে অস্তিত্বের প্রয়োজনে মূষিক দৌড়ে প্রায়ই ছুটতে হয় ।ক্লান্ত লাগে । মাঝে মাঝে ভালবাসাহীনতা আর অনিশ্চয়তায় ভুগি ।সি এম এইচ আমাকে ভালবাসা আর নিরাপত্তা দুইই দিয়েছিল। আচ্ছা ,এমন কোন যায়গা কি নেই যেখানে সবসময়ই নিরাপত্তা আছে ,ভালবাসা আছে ?
______________________________

 

লেখক মেজর ডা. খোশরোজ সামাদ;
উপ অধিনায়ক ,
আর্মড ফোর্সেস ফুড এন্ড ড্রাগস ল্যাবরটরী ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়