Ameen Qudir

Published:
2018-09-09 18:12:58 BdST

অভাবের দিনগুলিআমি যখন মায়ের টিউমার ছিলাম !


লেখকের সঙ্গে তার মমতাময়ী জীবনজয়ী মা 


ডা. জোবায়ের আহমেদ


_____________________________


আমার বাবা তখন বি এ তে পড়েন।
ফাইনাল পরীক্ষা সামনে।।খুব ব্যস্ত সময় পার করছিলেন।। একদিন পড়ার টেবিল এ দাদি গিয়ে বাবা কে বিয়ের সুখবর দিলেন।।তখনো তিনি আমার বাবা হন নি।।
সুখবর শুনে মানুষ এর চোখে মুখে আনন্দ চিকচিক করে কিন্ত উনি মুখ গোমরা করে ফেললেন।।
দাদি গিয়ে দাদা কে জানালেন উনার রিয়েকশন।।
আমার বাবা উনার বাবা কে যতটুকু সম্মান, মর্যাদা দিয়েছেন এতটুকু হ্রদয় নিংড়ানো ভালবাসা খুব কম সন্তান তাদের বাবা কে দিয়ে থাকেন।।
বাবা মা এর বিরুদ্ধাচরণ ইহজীবন এ করেন নি।।
দাদা ভাই আমার বাবা কে সাথে নিয়ে গেলেন জৈনপুর এর পীরসাহেব হযরত মাওলানা এমরান আহমেদ সিদ্দিকী এর খানকা শরীফ এ।।
হুজুর বুজুর্গ ব্যক্তি ছিলেন,আমাদের এতদ অঞ্চল এ উনার খুব সুখ্যাতি ছিল।।
হুজুর সব শুনলেন, আব্বা কে স্নেহ করতেন।
দাদা কে বললেন, আমি ইস্তিখারা করে এক সপ্তাহ পর সিদ্ধান্ত দিব।।

এক সপ্তাহ পর দাদা ভাই বাবা কে নিয়ে হাজির হলেন।
হুজুর হঠাৎ ঘোষণা দিলেন নুরুল আমিন (আমার বাবা)এর বিয়ে আমি পড়াব।।
আমার বাবার আর না করার সুযোগ থাকল না।।
জৈনপুর এর পীরসাহেব হুজুর উনার পুরো জীবনে দুইটা বিয়ে পড়িয়েছিলেন।। এর মধ্যে আমার বাবা মা এর টা একটা।।

বছর ঘুরে আমার মা এর কোল জুড়ে বড় বোন আসে।
প্রথম সন্তান যার কন্যা, সেই বাবা ভাগ্যবান।।
ছয় মাস পর আম্মা একদিন আব্বা কে জানালেন
উনার পেটে কি যেন একটা চাকা নড়ে।।
অনেকটা টিউমার এর মত।।
মা খুব ঘাবড়ে গেলেন।।
আব্বা আম্মাকে নিয়ে গ্রাম থেকে পিজি তে হাজির।।
তখন পিজির গাইনী বিভাগের সম্ভবত রেজিস্টার ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডাঃ শায়লা খাতুন।।

ম্যাডাম আম্মাকে চেকআপ করে আব্বা কে নিশ্চিত করলেন আপ্নারা যেটা কে টিউমার ভাবছেন সেটা টিউমার নয়।
ম্যাডাম মিষ্টি খেতে চাইলেন।
১৯৮৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিকাল বেলায় সেই টিউমার আমার বাবা মা এর দ্বিতীয় সন্তান ও বড় ছেলে হিসেবে এই ধরনী তে ল্যান্ড করে।

আমার মা খুব মায়া নিয়ে গালে চুমু দিয়ে প্রায়ই
উনার সেই টিউমার কে আদর করেন এবং টিউমার এর ডাক্তার হয়ে উঠা নিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে উঠেন।

লেখকের  জীবনজয়ী মা ও বাবা----------------

 

আমার মায়ের অতীতের পাড়ি দেওয়া দুঃখ নদীর কাছে আমি শিখেছি অনেক কিছু।।
ঢেঊ জানা নদীর কাছে শিখার আছে অনেক কিছু।
আমার মা একজন নির্লোভ ও নরম মনের সাহসী নারী।
কোন চাওয়া পাওয়া, কোন অভিযোগ তখনো ছিল না।
আজো নেই।

আম্মাকে প্রশ্ন করলাম কেমন সুখে আছেন?
মায়ের উত্তর সুখের শেষ নেই।।
জীবনে এমন সুখের দিন আসবে সেটা উনার ককল্পনাতীত ছিল।
উনি বিশ্বাস রেখেছেন নিজ লক্ষ্যে।।
কি পেয়েছেন, কি খেয়েছেন, কি পরেছেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি।।
এক্টাই স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করে মানুষ হয়ে মানুষ এর পাশে দাঁড়াবে।।
আমরা কুমিল্লা শহরে যেই ফ্লাট এ ভাড়া থাকি, অনেকেই বলে কাজের লোকের অভাব।
কিন্ত মা এর কাজের লোকের অভাব হয়না।
যে একবার মা এর মায়া পেয়েছে সে আর যেতে চায়না।এইবার কুরবানি তে দেখলাম অনেক গুলো ছোট ছোট প্যাকেট করেছেন,আমি বল্লাম কাকে দিবেন অনেক গুলো কাজের লোকের নাম বল্লেন।।

সেই মা ই আমার শক্তি।।আমার সাহস এর বাতিঘর।।
মা এর পাওয়া সব কষ্ট গুলো ই আমার সম্পদ।
এগুলো আমাদের আজকের এই সময়ে নিয়ে আসতে প্রেরণা দিয়েছে এবং দিয়ে যাবে।।

#পাতা কুড়ানো সেই দিন গুলি।।

আমি রান্না ঘরে গেলেই আমার স্মৃতিতে পড়ে কত কষ্ট করে মা রান্নার লাকড়ি/ পাতা সংগ্রহ করতেন।
সেদিন আমার ডাঃ নাবিলাকে অটো গ্যাস স্টোভ কিনে দিয়ে বল্লাম মায়ের পাতা কুড়ানোর কথা।
একদিন আমি কলেজ থেকে দুপুরে বাড়ি এসেছি।
এসে দেখি মা ঘর্মাক্ত কিন্ত মন ভীষণ খারাপ।
জিজ্ঞেস করাতে ছোট বোন মিনা বল্ল, আম্মা দুই পুকুর এর ভিতর থেকে পাতা কুড়িয়ে বড় উঠানে রোদে দিয়েছেন শুকাতে, এক মহান চাচা খুব চিল্লাফাল্লা করেছেন।বলছেন, এগুলো তাড়াতাড়ি না সরালে উনি ফেলে দিবেন।।
আমাদের কে ত নাই, আমার মায়ের কুড়ানো পাতাকেও উনারা সহ্য করতেন না।।
আজ আর মা কে পাতা কুড়াতে হয়না।

#ফ্রিজ কেনার গল্পঃ ২০১০ সাল
আমি তখন সিওমেক এ ইন্টার্নী ডাক্তার। একদিন সকালে বাড়ি পৌঁছে দুপুরে আমাদের আড্ডা বাজারে গেলাম।ফিরলাম সন্ধ্যায়।
আসার পর গোল্ডেন সিস্টার আফসানা বলল,আম্মা আজকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে বিকালে।
কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করাতে বল্ল, বেয়াল (খালের উপর বাশ ফেতে মাছ ধরার গ্রামীণ পদ্ধতি) থেকে অনেক গুলো কই ও টেঙরা মাছ কিনে আনছে আম্মা।
কিছু আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই সোহাগ এর জন্য ফ্রিজে রাখতে গেছিল, কিন্ত কারো ফ্রিজে জায়গা দেয়নি কেহ।।
সেদিন আমি আবার রাতে বাজারে গেলাম।
তারপর আমাদের ইউনিয়ন এর সাবেক চেয়ারম্যান বাদল কাকা এর গোল্ডেন সমবায় সমিতি থেকে এক বছর এর কিস্তি তে HAIER এর একটা ফ্রিজ কিনে আনি।
আজকের দিন গুলো তে যতবার ফ্রিজ খুলি ততবার সেই কথা মনে পড়ে।।

#সোহাগের কথাঃ
আমরা তিন ভাই এর দ্বিতীয় হল সোহাগ।।
সোহাগ যখন ক্লাস ১০ এ পড়ত তখন আমার এক চাচাত ভাইকে প্রাইভেট পড়াত।
মাসে ১০০ টাকা।প্রথম মাস পড়ানোর পর টাকা দেওয়ার দিন চাচী বলল, সোহাগ তোর আম্মার কাছে ১০০ টাকা পাই।। তোর এই মাসের বেতন দিয়ে সেই টাকা পরিশোধ হয়ে গেল।
তার সেই দিনের চাপা কান্না ও কষ্ট টা আমি ভুলিনি।

আজ সোহাগ NSU থেকে বায়োটেকনোলজি তে মাস্টার্স শেষ করে USA টে PhD করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সেই চাচাত ভাই কতদূর আগালো, সেটা আর নাই বা বল্লাম।

চলবে
_________________________


ডা. জোবায়ের আহমেদ ।সুলেখক। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪২ ব্যাচ।
এবং
Executive Director at Dr.Jobayer Medicare Center
former Resident Medical officer at ড.এম এ রহমান হসপিটাল
Former Intern Doctor at Sylhet MAG Osmani Medical College Hospital
Studied MBBS at Sylhet MAG Osmani Medical College

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়