Ameen Qudir

Published:
2018-09-08 15:34:42 BdST

অভাবের দিনগুলি :আম্মা বলতেন জীবনের কষ্টগাঁথা লিখলে হাজারো পৃষ্ঠার উপন্যাস হবে


লেখকের ছবি

 

 


ডা. জোবায়ের আহমেদ
__________________________________


অতীত কে ভুলা যায়না।
অতীত এর শক্তিশালী স্মৃতি সামনে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়।
আম্মা বলতেন উনার জীবনের কষ্টগাঁথা লিখলে হাজারো পৃষ্ঠার উপন্যাস হয়ে যাবে।।
আমার মা, বাবা আমাদের কে এমন একটা পৃথিবী তে বড় করেছেন যেখানে আমাদের মামা ছিল না,খালা ছিল না, চাচা জেঠা কেহ ছিল না।
আমাদের কোন আত্মীয় ছিল না।
বেড়ানোর কোন জায়গা ছিল না।
আমার জীবনে রক্তের সম্পর্কের মানুষ দের কোন ভুমিকা নেই।কোন স্নেহের স্মৃতি নেই।
এই যে আমি লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছি,ক্লাসে ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করেছি, বৃত্তি পেয়েছি কেহ কোন দিন আদর করে ১ টাকা দিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন বলতে পারবে না।
মানুষ দাদাবাড়ি তে বঞ্চিত হলেও নানা বাড়িতে আদর
পায়,আমরা কোথাও পাইনি।
#দাদীর স্মৃতি ও ভালবাসাঃ
আমার দাদা ভাই হজ্জে গেলেন।
কুরবানির ঈদের পর গরুর চামড়া বিক্রির ১২০০ টাকা আমার দাদি আমাকে দিয়েছিলেন।
কাগজ কলম কেনার জন্য।সেই ১২০০ টাকা দেওয়ার অপরাধে আমার দাদি অন্য চাচী দের তোপের
মুখে পড়েছিলেন।।দাদী অপমানে কেঁদে ছিলেন।
সেই দিন কে ভুলা যায় না।
আমাদের কে খুব ভালবাসিতেন দাদী।
বাবা ছিল দাদীর কলিজা।কিন্ত ৬ ছেলে ২ মেয়ে এর বিশাল সংসারে দাদি ছিলেন অসহায়।
আমাদের কে দেবার মত শুধু ভালবাসা ও দোয়া ছাড়া আর কিছু ছিলনা উনার।
এস এস সি এক্সাম এর সময়ে আমার বড় বোনের এক জোড়া জুতা ছিল না।সে দাদির কাছে বায়না ধরল,এক জুড়া জুতার টাকার জন্য।দাদী দাদার আলমারি থেকে চুরি করে ২৫০ টাকা এনে দিয়েছিলেন।সেইদিন দাদির মুখে একটা সুখের ছায়া দেখেছিলাম।
আমাদের বায়না ধরার এই একটা জায়গা ছিল।
আম্মাকে দাদি মাঝে মাঝে ২০/৫০ টাকা এনে দিতেন সাবান, লবন, ডাল কেনার জন্য।
২০০০ সালে আমাদের ঘরের সবার চিকেনপক্স হল।
বাবার এত বেশী হয়েছিল, এখন মনে করলেও ভয় লাগে। সেদিন দাদী একটা ছাগল সদকা দেওয়ার মানত করেছিলেন, বিনিময় আল্লাহ যেন বাবা কে সুস্থ করে দেন।
দাদী গরুর মাংস খুব পছন্দ করতেন।
আমি মেডিকেল এ চান্স পাবার পর যতদিন বাসায় গিয়েছি,যাওয়ার সময় দাদির জন্য গরুর মাংস নিয়ে যেতাম।।দাদীর গরুর মাংস খাওয়ার দৃশ্য টা আজো ভুলিনি।।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে দাদী আমাদের উপর খুব নির্ভর হয়ে গেলেন।আমাদের ঘরে ঢুকে নিজ হাতে খাবার নিয়ে খেয়ে দাদাভাই এর জন্য নিয়ে যেতেন।
এই স্বাধীনতা অন্য কোথাও ছিল না।
আমরা যেদিন ১১ সেপ্টেম্বর ২০১১ তে কুমিল্লা শহরে চলে আসি সেদিন দাদী ও দাদাভাই খুব কেঁদে ছিলেন।
বলেছিলেন আমাদেরকে কার কাছে রেখে যাচ্ছো তোমরা।আমরা যখন চলে আসি, অশ্রুসিক্ত দাদির আমাদের পথ পানে চেয়ে থাকাটা আজো ভুলিনি।
ভালবাসার মানুষ এর অশ্রুজল এর কথা ভুলতে নেই।
দাদি ইন্তেকাল করেন ২৫ জানুয়ারি ২০১২ এর বিকেল বেলা।
আমি তখন ফেনীর কসমোপলিটন হাসপাতাল এর Resident Medical Officer.
ছুটি ম্যানেজ করে পরদিন ভোরে গ্রামে ফিরি,দাদির দাফন কাফন এর সব খরচ আমি দেই,একটি টাকাও উনার সন্তান দের লাগেনি।
ভালবাসি দাদি কে। কিছু ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে পারায় মন হাল্কা লাগছে।

#দাদার স্মৃতিঃ আমার দাদাভাই প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আব্দুল মান্নান ওয়াজেদী ছিলেন আমাদের এলাকায় সু-পরিচিত এক ইসলামী ব্যক্তিত্ব।।
হাজারো আলেম এর উস্তাদ তিনি।
অন্য ছেলেদের বিরোধিতায় তিনি আমাদের জন্য খুব বেশি ভুমিকা রাখতে না পারলেও দোয়া দিয়ে গেছেন প্রাণভরে।
উনি প্রতি মুনাজাত এ বলতেন আল্লাহ যেন আমাকে উনার বংশের প্রদীপ বানিয়ে দেন।।
এই দোয়া আমি ভুলি কেম্নে।
দাদীর ইন্তেকাল এর পর আব্বা বাড়ি গেলেন উনাকে দেখতে,টাকা দিলেন,তখন আমি ব্যাংকক এ Australian Medical Council CaT 1 দিতে।
আব্বা দাদাভাই কে বললেন, জোবায়ের এর জন্য দোয়া করবেন,দাদাভাই বল্ল তার দোয়া চাইতে হবেনা।
দোয়া যে পৌঁছে তা কি টের পাচ্ছো না।
আমাদের জীবনে দাদাভাই এর দোয়ার ভুমিকা বিশাল।
দাদাভাই কে যখন ল্যাব এইড এর আইসিইউ তে নিয়ে যাই তখন এম্বুলেন্স চলতে শুরু করার পর দাদাভাই গাড়ি থামিয়ে আব্বাকে আবার ডাকিলেন।
আব্বার হাত ধরে বলেছিলেন " সফর যদি সংক্ষিপ্ত হয় তাহলে তোমার সাথে দেখা হবে, আর যদি সফর দীর্ঘ হয় তাহলে হাশর এর মাঠে দেখা হবে"
দাদার সফর দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল।
কুমিল্লা মেডিকেল সেন্টারে দাদাভাই এর টেস্ট এর টাকা দেওয়ার লোক ছিল না সেদিন।
যারা উনার সব সম্পদ গিলে খেয়েছে তারা কেহ দেয়নি।
আমাদের তখন ক্রাইসিস। আমি ব্যাংকক থেকে ফিরছি মাত্র,বেকার,মাত্র ৫০০০/= টাকা ছিল,আমি আব্বার হাতে দিয়ে বল্লাম আমার কাছে আর ১ টাকাও নেই,দাদাভাই এর সময় আর বেশি নেই, এটা উনার হাতে দেন।
দাদাভাই মৃত্যুর আগে আমার দেওয়া টাকা ই হাতে নিলেন।আর কারো সেই সুভাগ্য হয়নি।
ল্যাব এইড এ যখন দাদাভাই কে ভেন্টিলেটর এ দেওয়া হয় তখন তিনি আমার হাতে ধরে বলেছিলেন, তোদের অনেক বঞ্চিত করেছি,তোদের জন্য মায়া হয়।
রাতে ফ্লোরে ঘুমিয়ে দাদার অন্তিম সময়ে সেবা করে পাশে থেকে যে দোয়া পেয়েছি, তার জন্যই আজকের এই আলোময় জীবন।।।

#অভাবের দিনগুলি তে খাবারের পাশাপাশি কাপড়চোপড় এ আমরা অনেক কষ্ট পেয়েছি।
আম্মার একটা কাপড় ছিল। দিনে গোসল করতেন না।
রাতে গোসল করে পেটিকোট আর ব্লাউজ পরে ঘুমাতেন,ভেজা কাপড় টা শুকালে সকালে পড়তেন।
১৫ দিন পর আব্বা বেতন পাওয়ার পর দুইটা জনি প্রিন্টের কাপড় এনেছিলেন।
সেই দিন ভুলতে পারবো না।।
তাই এখন আমি যতবার কুমিল্লা যাই আম্মার জন্য আড়ং থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাই।।
আজকে যখন আম্মাকে বল্লাম সেই দিনের কথা, আম্মা বলল সেইদিন কাপড় ছিলনা বলে আজ শুধু আড়ং এর ৫০ টা কাপড় আলহামদুলিল্লাহ।
একদিন বিকেল বেলা, সবাই ঘুমাচ্ছে, আমি উঠে দেখি সকালে যেই কাপড় টা সিলেট থেকে নিয়েছি সেটা
একা একা গায়ে জড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছেন।
আমি চুপিচুপি পুরো ব্যাপার টা খেয়াল করলাম।
যদিও সকালে কাপড় টা নেওয়াতে খুব রাগ দেখালেন,মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য লেকচার দিলেন।

বাবা মা এর জন্য আমি আজীবন অপচয় করব।
সেই দৃশ্য যে কতটা সুখের তা আমি জানি।

#১৯৯৩ সালে কুয়েত গিয়ে ১৯৯৬ সালে বাবা দেশে চলে আসেন।আমি তখন সিক্স এ পড়ি।
১৯৯৬ থেকে ২০০৪ এই আট বছর আব্বা বেকার ছিলেন।আমাদের জীবনের বেশি নিষ্ঠুরতা এসেছিল এই সময় টাতে।
অভাব আস্তে আস্তে আমাদের গ্রাস করে নিল।
আব্বা ১৯৯৬ সালে একটা লুঙ্গি কুয়েত ফেলে এসেছিলেন,৪ বছর পর জেঠা ২০০০ সালে দেশে আসার সময় এই লুঙ্গি টা নিয়ে এসে উনি বাড়িতে তিন মাস পরেন।যেদিন উনি আবার বিদেশ গেলেন সেদিন আম্মা সেই লুঙ্গি এনে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে শুকিয়ে আব্বাকে দেন।আব্বা সেই লুঙ্গি এক বছর পরেছিলেন।
সেই মলিন লুঙ্গির চেহারা আজো ভুলতে পারিনি।
কত টা খারাপ ছিল সেই সময়।।
গত বছর শুধু আব্বার কাপড় রাখার জন্য আমি ৪৬হাজার টাকা দিয়ে হাতিল থেকে একটা আলমারি দেই।
# আমি যখন এস এস সি পরীক্ষা দেই,তখন আমার এক্টা প্যান্ট ছিল না।আমি আমার বাবার একটা পুরাতন প্যান্ট ছোট করে পড়েছিলাম।
আমি ক্লাস ৮ এ যেই প্যান্ট বানিয়েছিলাম সেটা ক্লাস ১০ এ গিয়ে ছোট হয়ে গেল।সেটা পরলে
ক্লাসের বান্ধবী রা হাসাহাসি করত।
স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এস এস সি এক্সাম দিয়েছি।
এক জোড়া জুতা ছিল না।।
কাপড়চোপড় এর কষ্ট গুলো আমি নিতে পারিনা।
যখন এইস এস সি এক্সাম দেই তখন পুরো পরীক্ষা একটা ৪০ টাকার বাঘ এর চিত্র আঁকা টি শার্ট পড়ে দিয়েছি।
আজ আমার জামা কাপড় অনেক মানুষ গায়ে দেয় আলহামদুলিল্লাহ।।
অনেক কে আমি জামা কাপড় কিনে দেই।
কিন্ত সেই দিনের কথাগুলো কেম্নে ভুলিব।
প্রথম ও ২য় লেখার প্রতিটি শব্দ আগের লিখা পড়ে যারা অশ্রুসিক্ত হয়েছেন, সেই অশ্রুজল এর মত পবিত্র ও সত্য।এটা আমাদের নিষ্ঠুর যাপিত জীবনের কিছু খন্ড চিত্র।
চলবে

_______________________________

ডা. জোবায়ের আহমেদ ।সুলেখক। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪২ ব্যাচ।
এবং
Executive Director at Dr.Jobayer Medicare Center
former Resident Medical officer at ড.এম এ রহমান হসপিটাল
Former Intern Doctor at Sylhet MAG Osmani Medical College Hospital
Studied MBBS at Sylhet MAG Osmani Medical College

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়