Ameen Qudir

Published:
2018-09-05 18:44:33 BdST

প্রথম স্যার মজেহারউদ্দিন মাস্টারমশাই আর শেষ স্যার শেখ শাহজাহান আলী


 

কথাশিল্পী শিক্ষক দেবব্রত তরফদার তরুণদের মাঝে


দেবব্রত তরফদার
____________________________

 

যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি - একথা শুনে এসেছি ছোটবেলা থেকে । এই হিসাবে মানুষ , প্রকৃতি , সময় , অভিজ্ঞতা এ সবই তোমার শিক্ষক। আর তুমি একই সঙ্গে ছাত্র আর শিক্ষক ,আজীবন।
আমার ছাত্রজীবনের সূচনা হয়েছিল সেদিন , যেদিন বিস্টু ঘোষের দোকান থেকে বর্ণপরিচয় কিনে দিদিদের সঙ্গে স্কুলযাত্রা ( ১৯৬৮) আর শেষ হয়েছিল কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ বিল্ডিংএ ( ১৯৮৮) । প্রথম স্যার মজেহারউদ্দিন মাস্টারমশাই আর শেষ স্যার শেখ শাহজাহান আলী । মাঝখানের সবাইকে মনে করার চেষ্টা করছি আজ ।
মাস্টারমশাই বলতে যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো ছোটবেলায় দেখা বিদ্যাসাগররূপী পাহাড়ি সান্যাল এর চেহারা । ছাত্রজীবনে অনেক কেই পেয়েছি এরকম । ক্লাস সেভেনের প্রথম বাংলা ক্লাস ছিল টিফিনের পর। দেরি করে আসায় পুরো ক্লাস নীলডাউন । ভয় ছিল হেডস্যার সত্যেন রায় বাবু দেখে ফেললে শাস্তির মাত্রা বাড়বে তাই বাংলার স্যারের মুণ্ডপাত করছিলাম । চিত্ত বাবু , ছোট্টখাটো মানুষটি , প্যারালাইসিস এরজন্য শরীরের একদিক কমজোরি পা টেনে হাঁটতেন । প্রথম ক্লাসেই বলেছিলেন শিক্ষা মানে দু পাঁচটা বই পড়া নয় । শিক্ষা দেয় মানুষকে ভালোমন্দের বিচারশক্তি , জ্ঞানের আলো , যুক্তিবাদী মন । সেদিনই মনের মধ্যে গেঁথে গেছিল সে কথা । উনি পড়ানোর সময় এমন এক আবহাওয়া তৈরি করতেন যে পড়ার পরেও ঘোরের মধ্যে থাকতাম । ছিলেন প্রতুল কর বাবু । আপাত গম্ভীর চেহারার পিছনে স্নেহময় বাবা যেন । দুলাল বাবু , নির্মল সান্যাল , নির্মল বাগচী , আনন্দ বাগ , অপূর্ব বাগ , লুই প্রভাত বাবু , কমলবাবু , সুব্রত বাবু , দিলীপ দাঁ , রায়ভূষণ বাবু সবার সঙ্গেই আছে আলাদা আলাদা তিক্ত মধুর স্মৃতি , যা এখনশুধু মধুর বলেই মনে হয় । স্কুলে মার খাওয়ার স্মৃতিও কত মধুর । প্রতুলবাবু , নির্মল বাগচী বাবুর কাছে যে মার খায়নি সে ছাত্রই নয় । তবে তিক্ত স্মৃতি বলতে আনন্দ সরকার বাবু , জিতেন বাবু আর কৃষ্ণমাধব বাবুর অপমান সূচক কথা আর ক্লাস সিক্স এ দুর্গাবাবুর অত্যাচার । মনে পড়ে গেল লাইব্রেরিয়ান স্যার সুহৃদশেখর বাবুর প্রশ্রয় , প্রভাসবাবুর হাসিমুখ , সুধীরবাবুর পিতৃসুলভ চেহারা , রমেশবাবুর সদাবিরক্তি মুখ আনন্দরায় বাবুর পান চিবোতে চিবোতে ইংরিজি বলা , অশোক বাবুর স স করে কথা বলা আর মার , দিলীপবাবুর ঢপের গল্প , দুলালবাবুর পরিছন্নতা। অন্যান্য স্কুলের মত স্যারেদের নাম দেওয়ার প্রচলন ছিল তাই থর , শেয়াল , বোতল , বাখারি , মুচি , নাপিত , মাতাল , ধামা এই শব্দগুলো মনে পড়ে গেল ।এঁদের অনেকেই আজ নেই কিন্তু আছেন আমাদের হৃদয়ে । বলতেই হয় হেডস্যার সত্যেন রায়ের কথা। ব্যাঘ্ররূপ । চোখের দিকে তাকালেই গা হিম । মার খেতে দেখেছি বাসু আর একটা ছেলেকে । বাপরে । কিন্তু অন্তরে ফল্গুধারা । ১৯৭৬ সালে যখন উনি চলে যান তখন কেঁদে ভাসিয়েছিল সারা স্কুল । পরে শ্রেষ্ট শিক্ষকের সন্মান পেয়েছিলেন। ( না বলেপারলাম না , স্কুলে ছাত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করে সাসপেন্ড হওয়া শিক্ষকও শ্রেষ্ট শিক্ষকের শিরোপা পেতে পারে । কি দিনকাল । বলার অনেক কিছুই ছিল এখনকার শিক্ষককুল সম্পর্কে । আজ নয় । আমাদের মাষ্টারমশাই দের সঙ্গে এদের কথা না বলাই ভাল ।)
পেয়েছি আমার গৃহশিক্ষক দের সান্নিধ্য , স্নেহ ভালবাসা , বন্ধুত্ব । বনমালী দাদা , প্রশান্তবাবু , শ্যামল মামা , সৌমেন দা, সমরদা ,সুবলদা , সমীরদা, সুভাষদা , শাহজাহান আলী স্যার , দেবব্রত মন্ডল স্যার । শিশুশ্রেণী থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত । কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারেদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা হয়না । তবুও পড়ানো আচার ব্যবহার , সহমর্মী মনোভাব এর জন্য মনে পড়ছে এস আর সি , প্রশান্ত ভৌমিক বাবু , ব্রজেন স্যার , মৃনেন স্যার , বিপ্লব স্যার , দেবব্রত স্যার , অরুণ বসু , রতন খাসনবিশ স্যার ।
এঁদের অনেকেই আজ আমাদের মধ্যে নেই । গুরুদেব আপনাদের শতকোটি প্রণাম ।
আমার শিক্ষক জীবনের শুরু ১৯৭৯ , আমি ইলেভেন , ছাত্রী ফাইভ , মামাতো বোন । এরপর নিজের প্রয়োজনে বেড়েছে ছাত্রছাত্রী । ১৯৮৫ শাল থেকে অনার্স পড়ানো শুরু , আমার নিজেরই তখন 3rd year ( আমি ভাবি সুব্রত , প্রদীপ , পার্থ , জগন্নাথ , গৌতম নামের সেই আহম্মক গুলোর কথা যারা কোন দুঃসাহসে আমার কাছে পড়তে এসেছিল । তাদের কি ফেলের ভয় ছিলনা । যাই হোক উতরে গেছিলো সবাই )। পরের বছর শোনডাঙার বন্ধু রমেন সিংহরায় পাঠালো পুরো এক ব্যাচ । দরকার ছিল খুব তা না হলে দেখা হতো না বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা । তিনদিন ইউনিভার্সসিটি তে ক্লাস , বাকি চারদিন পড়ানো। পড়াতে গেলাম এক টিউটোরিয়াল হোমে । ছাত্ররা আপত্তি করল আমার কম বয়েসের জন্য (ওই ছামড়ার কাছে পড়ুম না ) বাধ্য হয়ে দাড়ি রাখতে হয়েছিল । তা সেই তিরিশ বছরআগেকার ছাত্রটির সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে । তারপর সংসারের প্রয়োজন , পয়সার লোভ ,আর বেরোতে পারিনি। সেই থেকে চলেছে সকাল সাতটা থেকে রাত্রি আটটা । বছরের পর বছর । ছাত্রময় জীবন । আমার বাড়ি কেনা থেকে আমার বিয়ের ঘটকালিতে পর্যন্ত আছে তারা । পড়ানো আর টাকা , এভাবে দেখিনি জীবনকে। কতো জনের কথা মনেপড়ছে । জড়িয়ে আছি তাদের সঙ্গে । তাদের সুখ দুঃখ হতাশা জয় এর সঙ্গে । মনে পড়ছে অনেকের কথা। যারা লেখাপড়া খেলাধুলোয় ভাল, স্যারে রা তাদের মনে রাখেন। তুই কাদের ব্যাচ ? এই প্রশ্নে আমার আপত্তি আছে । কিছু স্যার আছেন যারা বলেন অমুক ফার্স্ট বয় তমুক পি এইচ ডি আমার ছাত্র । আরে বাবা ছাত্রের ভালো ফলের credit স্যারের হলে খারাপ ফলের discredit কে নেবে ? আমি তোমার সঙ্গে আছি , তুমি যতদূর যাবে , পাবে আমায় পাশে।
মনে পড়ছে তাদের যারা অকালে চলে গেছে । দুর্ঘটনা , দূরারোগ্য ব্যাধি বা হতাশায় আত্মহনন । অমিতাভ পাড়ুই মনে পড়ে তোর সদা হাস্যময় মুখ । জুয়েল , মনে পড়ছে একটা অঙ্ক যেটা আমি পারছিলাম না , তুই করে দিয়েছিলি ।যতবারই করতে যাই তোর কথা মনে পড়ে । ফোটোন ,তোর বিয়ের ঠিক হয়েছিলো । জীবনে মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিসনি তাই কত উত্সাহ ছিল । ইন্দ্র , তোর মেয়েটা বড় হয়ে গেল রে । পরিতোষ , বছর বছর প্রাইমারীর পরীক্ষা হচ্ছে আর তোর কলমের কালি শুকনো । তালিকাটা অনেক বড় । পারছি না আর লিখতে । তোরা আছিস আমার হৃদয়ের এক কোণে । নিশ্চিন্তে ঘুমো।
আর যারা লড়াইয়ে জয়ী তাদের কথা ভুলিনি। বাবা রিকশা চালান , মা পরিচারিকা , বাবা প্রান্তিক চাষী দিন মজুর , ফেরিওয়ালা , ছাত্র নিজে মজুর । তারক পাল , বিমান গড়াই , স্বপন রায় , সুজিত মালাকার , সুনির্মল ধনি , পিন্টু বৈষ্ণব, গৌতম হালদার ........সাবাস।গর্ব হয় এই লড়াইয়ে তোদের সঙ্গে ছিলাম । আর মিলি তোর লড়াইটা ছিল আলাদা , সাথ দিতে পারিনি শুধু শুভকামনা ছিল, সাবাস তোকেও । আমার প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা যারা এখনো লড়ে যাচ্ছে তাদের বলছি সুদিন আসবেই। আমি আছি তোদের সঙ্গে ।
আমি হতে চাই সেই শিক্ষক যেন ছাত্রের শিক্ষক শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখ মনে পড়ে । আমি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যেন পড়াতে পারি । আমি কামনা করি পড়াতে পড়াতেই যেন আমার মৃত্যু হয় ॥

২.

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন শিক্ষক দিবসের এই হুজুগ বা হিড়িক ছিল না । সেদিন স্কুলে শিক্ষক দের ছুটি থাকতো পড়ানো থেকে ।ছাত্ররাই ক্লাস নিতো । আর ছাত্রদের সঙ্গে স্যারেদের হতো প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। বয়স্ক স্যারেরা হাফপ্যান্ট পরে নেমে পড়তেন মাঠে । স্টুডেন্টদের কাছে সে ছিল এক অভাবনীয় দৃশ্য। সবচেয়ে দারুন লাগতো বাঘের মত মানুষ প্রৌঢ় হেডস্যার সত্যেন বাবুর মাঠে নেমে পড়া। উনি স্কুল এবং মাঠে ছিলেন সমান ডিসিপ্লিন। উনিও যে এই খেলাটা দারুন উপভোগ করতেন সেটা ছোট বয়সেও বুঝতে পারতাম। মাঠে নামতেন দিলীপ বাবু, সুব্রত স্যার , কমল বাবু , ইঞ্জিনিয়ার স্যার শম্ভু বাবু , আজিতবাবু , প্রতুল বাবু এমনকি প্রায় বৃদ্ধ প্রভাস বাবুও। ছাত্র দের বাধ্যতামূলক হার। তাপস ছিল স্কুলের সেরা গোলকিপার আর সেদিন স্কুলের সেরা স্ট্রাইকার দিপকদা বা আমাদের ক্লাসের বুলান ,সব্যসাচী এরা সবাই ম্লান। ছাত্ররা দু গোল দিলে স্যারেরা যাতে তিনগোল দিতে পারে তার ব্যবস্থা আমরাই করতাম নিজেদের গোলের পিছনে দাঁড়িয়ে। স্যারেরা বল নিয়ে ঢুকলেই পিছন থেকে তাপসকে টেনে ধরতাম । নাহলে পরের দিনের ছুটিটা মার যায় যে। স্যারেদের আজ প্রায় কেউ আর নেই । মনে হয় সেদিনের কথা ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক দিবস তার রূপ পাল্টেছে । ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের যত অবনতি হয়েছে , শিক্ষক দের প্রতি যত শ্রদ্ধা কমেছে এর ধুম তত। এই সপ্তাহটা শহর চলে যাবে এই দিবসের দখলে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বাবার পকেটে পড়বে চাপ। স্যারেদের গরম পকেট কিছুটা ঠান্ডা । যত রাজ্যের অকাজের জিনিসে ভরে যাবে ঝড় । তার অনেকের স্থান হবে পরে ডাস্টবিনে। কিছু যাবে অন্য অনুষ্ঠানের উপহার হিসেবে । অনেক জায়গায় এই ঘটাপটা অনুষ্ঠানের রূপ নেয় ।বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানও প্রতিযোগিতা। আবার লজ ভাড়া করে ছাত্র খাওয়ানো,অর্কেস্ট্রা পর্যন্ত হয়। অনেক জায়গায় একমাস আগে থেকে অনুষ্ঠানের মহড়া চলে। অডিটোরিয়াম ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান । অতি আধুনিক ব্যতিক্রমী ছাত্র শিক্ষকের মধ্যে নেশা টেশাও চলে। এই সব অনুষ্ঠান পেশাদার শিক্ষকের কাছে বিজ্ঞাপন হিসেবে কাজ করে । পড়ার সঙ্গে দুর্দান্ত এক প্যাকেজ। সময় যা চায় । মন্দ আর কি।
আমার পড়ানো জীবন পয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল । আমরা ঘাটা পড়া মাল । এসব আর সানায় না আর। আমোদ আহ্লাদ থেকে দূরে থাকায় নতুন কেউ যেও হতাশ হয় বৈকি । কিন্তু তাদের সংখ্যা খুবই কম। এই সময়ে পার করেছি কয়েক হাজার তো বটেই। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়া আমেরিকা , অস্ট্রেলিয়া , কানাডা , হংকং বারমুডা , নেদারল্যান্ডস আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে এই অধমের কুলাঙ্গারেরা। নেট দুনিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে শুভেচ্ছা আসতে শুরু করেছে আজ থেকেই । কালকে অনেকক্ষণ ফোনে কাটাতে হবে। এটা বিশেষ কিছু নয় । এতো সারাবছরই চলে। ছাত্রদের সঙ্গে স্যারের যা বন্ডিং তাতে আমার কাছে প্রতিদিনই শিক্ষক দিবস।


__________________________________

দেবব্রত তরফদার। দুই বাংলার হাজার হাজার পাঠক হৃদয় জয় করা লেখক। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়