Ameen Qudir

Published:
2018-08-20 16:03:42 BdST

রোগী কথনসন্তান ছেলে না মেয়ে, দায় কার ?





ডা.ছাবিকুন নাহার
______________________________

সালেহা। সাত মাসের পোয়াতি। ক্লান্ত বিষন্ন দুটো চোখ অনেক কিছু বলতে চায়, অথচ বলে না। বিহ্বলতা যেনো সারা শরীর লেপ্টে আছে। লিকলিকে হাত পা ছাপিয় বেঢপ সাইজের পেটটা চোখে পড়ে আগে। মনেহয় ওখানে জমা আছে মুক্তি অথবা আরো বেশি বঞ্চনা।

- আচ্ছা তোমার তিনটা বাচ্চা, আবার বাচ্চা নিলা যে?

- আফা যে কী কন! একটা পোলা না অইলে কি অয়? ছেলে অইল বংশের বাত্তি। মাইয়া দিয়া আশা কি? পরের বাড়ির খুটা। মানুষটা কয়, এত দিন কিছু কই নাই, তয় এইবার পোলা না অইলে আমার কিছু করন থাকব না। আবার...

সালেহা ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, আফা আমারে যেনো আল্লাহ একটা পোলা দেয়। তাইলে আমার সংসারটা টিক্কা যাইব আফা। বলেই আবার নিঃশব্দ কান্না...

আসলেই কি সংসার টিকে যায় নাকি একে সংসার বলে? আমি জানিনা। আমার অস্থির লাগতে থাকে!

রোজ রোজ এসব ঘটনার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। ভালো লাগে না। কেমন যেনো এক দমবন্ধ গুমোট অবস্থা। তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে শেয়ার করি।

জানেন কী, একজন নারী কতটা পিচ্ছিল পথ পারি দেন সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে? কতটা নির্ঘুম রাত জমা হয় তার আপন ডায়রীতে? কতটা পরিবর্তন পরিবর্জনের ভিতর দিয়ে যায় শারীরিক ও মানসিক ভাবে?

সৌন্দর্য প্রিয় মেয়েটি, যার ওজনে মারাত্মক এলার্জি, 'ওজন কেন বাড়ছে না, বাচ্চা ঠিক আছে তো?' বলে আতংকিত হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, অথচ 'বাচ্চা ভালো আছে তো আপা?'
বলে আবার হা করে শ্বাস নেয়! আমি অবাকের পর অবাক হই। মা কি দিয়ে তৈরী?!

অথচ সন্তান কেন মেয়ে? এই প্রশ্নে মা কে কাঠগড়ায় দাড়াতে হয় সবচেয়ে বেশি। একজন মায়ের প্রতি এ যে কত বড় অবিচার! কত জঘন্য নীচতা, বলে বুঝানো যাবে না। কিছু কিছু পুরুষ এটাকে ইস্যু করে নতুন বিয়েতে উত্তরণ খোঁজে। নতুন এক সময় পুরনো হয়। আবার...

আসুন জেনে নিই,
" সন্তান ছেলে না মেয়ে?" কার দায় কতটুকুঃ

প্রতিটা শরীর কোটি কোটি ছোট ছোট কোষের সমন্বয়ে তৈরী। এই কোষ শরীরের একক। আবার এক একটা কোষে থাকে ৪৬ টা ক্রোমোজোম। এর মধ্যে ৪৪টা অটোজোম (শরীর তৈরী কারক), ২টা সেক্স ক্রোমোজোম (লিঙ্গ নির্ধারক)।

নারীর ক্রেমোজোম ৪৬ XX এবং
পুরুষের ৪৬ XY

এখন বাচ্চাকাচ্চা আসতে হলে নারী পুরুষ উভয়ের থেকে অর্ধেক অর্ধেক সংখ্যক ক্রোমোজোম আসবে অর্থাৎ-
নারী পুরুষ
৪৬ XX( ২৩X+২৩X) ৪৬XY(২৩X+২৩Y)

বাবার ২৩ X+ মায়ের ২৩X= ৪৬XX= মেয়ে
বাবার ২৩Y+ মায়ের ২৩ X= ৪৬ XY= ছেলে

এখানে লক্ষ্য করে দেখুন, ছেলে বা মেয়ে দুটো ক্ষেত্রেই মায়ের অংশের ক্রোমোজম কিন্তু ২৩X.

সন্তান ছেলে না মেয়ে হবে এটা নির্ভর করে Y ক্রোমোজোমের উপর, আর নারীদের Y ক্রোমোজোম- ই নেই। অথচ ছেলে কেন হলো না? এই প্রশ্নবাণ তাকে সয়ে যেতে হয় পলে পলে। সামাজিক ও পারিবারিক উদ্ভট এবং অবিবেচক আচরনের শিকার হতে হয়। কখনো কখনো ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন...বাপের বাড়ি।

একটা জন্ম= একটা ডিম্বাণুর অাধেক + একটা শুক্রাণু র আধেক = একটা প্রান। এই প্রাণ হাসবে, খেলবে, প্রেমে পরবে, বিয়ে করবে, বাচ্চা নিবে, এভাবে চলতে থাকবে...চলতেই থাকবে... সব প্রোগ্রাম করা। শুরু কবে হয়েছিলো, জানিনা, শেষ কবে হবে, তাও জানি না।
এই না জানার বাইরে একচুলও যাওয়ার উপায় নেই। তবে কেন এত অনাচার? নারী তো সয়ে যায়, সৃষ্টিকর্তা সইবে তো!

এবার একটা গল্প দিয়ে শেষ করছি-

এক দম্পতি, টম এবং জেরী টাইপ। তাহাদের দুই পুত্র সন্তান। একদিন বর (টম) আবিস্কার করল, তারা নানা নানী হতে পারবে না, কারন তাদের মেয়ে নাই। দুঃখ!
তারা মেয়ের মিশনে যেতে চায়। তবে জেরীর শর্ত একটাই, মিশনে যেতে আপত্তি নেই, তবে তার মেয়েই চাই। কত দিনের স্বপ্ন! টলমল পায়ে ঘুরে বেড়ানো ছোট্ট এক মেঘ বালিকার!

টমকে বলে, 'এবার যদি আমাদের মেয়ে না হয়, তাইলে কিন্তু তোমার খবর আছে! আমি তোমার সাথে সংসার করব না।'

এখানে জেরী সব বঞ্চিত নারীর হয়ে কথাটা বল্ল। যা এতদিন পুরুষরা সন্তান ছেলে না হলে, অন্যায় ভাবে নারীকে বলে আসছে।

টম দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। একটা লাল ফ্রক পরা মেয়ে তার চোখের বারান্দায় ঝুলে ঝুলে দোল খায় কিন্তু সে মুখে বলে, 'কী দরকার মেয়েতে? সন্তান তো সন্তানই। ছেলেই কী, মেয়েই কী?'

ইশ! সব স্বামীরা যদি টমের মতো হতো, তাহলে সালেহাদের জীবনটা কতই না সুখে কাটত।

'অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে... ' টম এবং জেরী গল্পের সমাপ্তিতে থাকলে ও মানুষের জীবনে থাকে না। আফসোস, মানুষের জীবনটা কেন গল্পের মতো হয় না?
_________________________________

ডা.ছাবিকুন নাহার। সুলেখক।
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ , ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়