Ameen Qudir

Published:
2018-07-23 15:31:41 BdST

এক চিকিৎসকের অপূর্ব যত্নে কিভাবে সন্তান বড় হল, হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জানাচ্ছেন সাংবাদিক মা


এই শিশুটি প্রায় ১১ বছর ধরেই অপূর্ব সেবা ভালবাসা স্নেহ পেয়ে বড় হয়ে চলেছে দেশের প্রথিতযশ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা.আবিদ হোসেন মোল্লার প্রযত্নে। সেই ভালবাসার মুগ্ধতা শিশুর চোখেও। ছবি: লেখক।



সামিয়া কালাম, প্রথিতযশ বেতার সাংবাদিক
____________________________

সময়টা ২০০৭ সাল। নতুন মা হয়েছি। কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না। ছেলে ক্ষণে কাঁদে, ক্ষণে বমি করে আবার একটু পর ঘুমিয়ে যায়। আমি দিশে হারা এক নব্য মাতা। ছেলের বয়স যখন সাত দিন, তার ওভারঅল চেক আপের জন্য নিয়ে গেলাম আবিদ হোসেন মোল্লার চেম্বারে। রমনা থানার পাশে, একটি তিন তলা ভবনের তৃতীয় তলায়। যখন আমাদের টার্ন এলো আমরা ছেলে কোলে চেম্বারে ঢুকলাম। তিনি নিউ বর্ন বেবি দেখার আগে হেক্সাজল দিয়ে হাত ওয়াশ করে নিলেন। বাচ্চার ওয়েট নেওয়া হলে পর বাচ্চাটা কোলে নিলেন।

আমার ছেলে জুল জুল চোখে স্যার এর দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার বললেন,
“কিরে? কি দেখিস এতো? তুই কি জানিস, তর রিফ্লেক্স খুব ভালো??”

ভালো রিফ্লেক্সের মানে আমি কিছুটা হলেও জানি। বুকটা ভরে গেল আনন্দে! আমি বললাম, "স্যার, খালি কাঁদে, বমি করে...”

স্যার বললেন, “বাচ্চা তো কাঁদবেই, ও কি কথা বলতে পারে? ও যখন কথা বলতে পারবে, তখন আর কাঁদবে না। যখন ও কাঁদবে, তখন আপনি একেবারেই অস্থির হবেন না। ওর সাথে কথা বলবেন, আই কন্টাক্ট করবেন।”

মার্চে মাস ছিল সেটা। অসম্ভব গরম পড়েছিল, আমি জানতে চাইলাম, “স্যার এতো গরম পড়েছে, ওকে কি একটু পানি খেতে দেব?”

খুব বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন “আপনার কাছে কি পানি চেয়েছে খেতে?”

এবারে আমার বিব্রত হবার পালা। তিনি বললেন, “দয়া করে ছয় মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেতে দেবেন না, পটের দুধ বা সেরিল্যাক... এই সব হাবি যাবি থেকে দূরে রাখবেন। শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা যে কোনো সিজনে তাকে দৈনিক গোসল দেবেন। বাচ্চাকে সময় দেবেন। দেখবেন আমার কাছে আসতে হবে না।”

আমি একজন সিরিয়াস টাইপ মা ছিলাম। আবিদ স্যার এর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। আমার ছেলে হাসি আনন্দ নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তখন ফুল্ টাইম মা ছিলাম। রোজ বিকেলে তাকে সাজিয়ে গুছিয়ে, কপালে টিপ দিয়ে কোলে নিয়ে বাইরে হাঁটতে নিয়ে যেতাম। বলে রাখি, এই সব বৈকালিক ভ্রমণে আমার কোনো ‘কাজের মেয়ে’ বা সহকারী ছিলনা।

কিছু সময়ের জন্য একজন সহকারি এসে বাসার কিছু কাজ করে দিয়ে যেত, বাদ বাকিটা সময় আমার ছেলে আমার আর তার বাবার সাথে বড় হয়েছে। তার বাবাও তাকে অফিসের আগে পরে এবং ভোর বেলা সময় দিয়েছে। সে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেত, সেই সময় যেন আমি কিছুটা বিশ্রাম নিতে পারি তাই তার বাবা তাকে বেবি ক্যারি প্যাকে বুকে বেঁধে নীচে নিয়ে যেত। এরকম দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমার স্বামী সকাল গুলোতে আমার ছেলের টেইক কেয়ার করেছে। আমি তার এই সাপর্টের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ।

এর পর এলো দাঁত ওঠার পালা। ছেলে হাতের কাছে যা পায় তাই খায়। লোশানের বোতল, চামচ, প্লাস্টিকের বাটি কিছুই বাদ পড়েনা। শুরু হল পেট খারাপ। একদিনে সে উনিশ বার টয়লেট করল। আবার তাকে নিলাম স্যার এর কাছে,
সেদিনের কথা আমার মনে আছে। স্যার বলেছিলেন, “এই ছেলে, তুই যা পাবি তাই খাবি নাকি? জুতা স্যান্ডেল...হাবি যাবি? মা তোকে খাওয়া দেয় না?”

আট মাসের শিশুর সাথে আবিদ স্যার কথা বলছেন, যেন সে কত কি বোঝে! আর আমাকে বললেন,
“এখন একটু আন স্টেডি টাইম যাবে। ওর দিকে এক্সট্রা নজর রাখবেন। আপনারা ঘরে যা খান সেই খাবার গুলোই ওকে চোটকে খেতে দেবেন। খবরদার, ব্লেন্ডারে খাবার ব্লেন্ড করবেন না। এবং ওর জন্য আলাদা করে কিছু রাঁধবেন না। আপনাদের ঘরের রান্নায় ঝাল মসলা কিছুটা কমিয়ে আনুন। তাহলেই বাচ্চা সেটা খেতে পারবে।বাচ্চাকে সময় দিন, দেখবেন, একদিন এর ফল পাবেন।”
এতো বার পাতলা পায়খানা হবার পরেও আবিদ স্যার, শিশুটিকে কোনো ঔষধ লিখে দিলেন না। কেবল বললেন, সেলাইন খাওয়ান, ফ্লুয়িড দিন, বুকের দুধ তো চলবেই।

এই একটা কারনেই স্যার এর প্রতি আমাদের এতো ভক্তি। স্যার, পারত পক্ষে তাঁর পেশেন্টকে কোনো ঔষধ দিতে চান না। এবং গার্জিয়ানদের কাউন্সেলিং করেন। এতো ব্যাস্ততার মাঝেও তিনি উপদেশ দেন। যখন সময় কুলিয়ে উঠেতে পারেন না, তখন সিল দিয়ে দেন প্রেসক্রিপশানে। শিশুদের পিতামাতার প্রতি একজন অভিজ্ঞ মা হিসেবে আমার অনুরোধ রইল, সিলে লেখা নির্দেশনা গুলো যদি সঠিক ভাবে পালন করা হয়, তাহলেও শিশু অনেক উপকার পাবে।


ধীরে ধীরে আমার ছেলে বড় হল।তাকে আমি বই পড়তে, ছবি আঁকতে উৎসাহ দেই। ডাইরি কিনে দেই, নিজের মত নিজের কথা লিখতে উৎসাহ দেই। যদিও লেখালেখির প্রতি তার তেমন কোনো আগ্রহ দেখতে পাইনা। এটা ওটা ভাঙা মটর, এবং ডিভাইস জোড়া তালি দিয়ে সে নানা কিছু বানায়। আমি তাকে উৎসাহ দেই। ইদানিং একটা ট্যাব উপহার পেয়েছে, সেইদিকেই বেশী ঝোঁক। যদিও বিষয় টা আমরা খুব একটা পছন্দ করছি না। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তার ট্যাবে গেইম খেলার অনুমতি দেই।


এডোলেসেন্স এইজ প্রায় চলেই এলো। কদিন আগে হুট কর তার শ্বাস কষ্ট শুরু হল, যদিওবা আমাদের পরিবারে কারো হাঁপানি কিংবা শ্বাসকষ্টের কোনো রেকর্ড নেই। আমরা ভাবলাম গরম থেকে বুঝিবা এরকম কিছু হয়েছে। কিন্তু শ্বাস কষ্টের ইশুটি ধীরে ধীরে বেড়েই যেতে লাগলো। তাকে বিমর্ষ দেখাতে লাগলো। একটি শিশু, সে বেড়ে উঠছে, তার মনের অলি গলির সব খোঁজ আমার জানা নেই। আমি খুব হতাশ এবং দুশ্চিন্তা নিয়ে দীর্ঘদিন পর আবার আবিদ স্যার এর স্মরণাপন্ন হলাম। স্যারের সামনে বসে আমি এবারে কেঁদেই ফেললাম,
“স্যার, এতোদিন সে শিশু ছিল, বলেছিলেন সময় দিতে। স্যার, অসম্ভব চেষ্টা করেছি তাকে সময় দিতে। এবারে সে বড় হচ্ছে, এডলেসেন্সকে হ্যান্ডেল করার উপায় তো স্যার জানিনা। আমি এখন কি করব?”
স্যার আমার ছেলের হাত ধরলেন, বহু দিন পর আমার ছেলের মুখে হাসির ঝিলিক দেখা গেল।
“কিরে? তোর তো কিছু হয়নাই। মুখ গোমড়া করে থাকিস ক্যান? দেখি হ্যাঁ কর, দেখি, জোরে শ্বাস নে। যা ভাগ, তোর কিচ্ছু হয়নাই। ফের যদি দেখি মুখ গোমড়া করে আছিস... আর শোন, ওজনটা তো বেড়ে যাচ্ছে। ফুটবল-ক্রিকেট খেলবি কি করে? ওজন কমা। আজ থেকে চিকেন খাওয়া বন্ধ। রুটি সালাদ আর মাছ খাবি। বুঝলি?”
ফিরে আসার আগে স্যার আমাকে আবার বললেন, “আপনি তো ধৈর্য হারা ছিলেন না, এরকম করলে কি চলবে? আবারো বলছি, আপনি স্থির থাকুন এবং ওকে সময় দিন। আপনাদের মত মা’ এরাই পারবে আদর্শ সন্তান গড়ে দিতে।”

হয়তো আমার লেখায় আবেগ চলে এসেছে। দীর্ঘ এগারো বছরের আবিদ স্যারের পরামর্শ এবং অভিজ্ঞতার কথা ছকে বাঁধা কলামে এতো সংক্ষেপে লিখে ফেলা সম্ভব না। তার পরেও চেষ্টা করলাম। আমার ছেলে এখন নিয়মিত মাছ – শাক সবজি খায়। সে সুস্থ হয়ে উঠছে। আলহামদুল্লিয়াহ। ভাবতাম শিশুকালটাই বুঝি সবচেয়ে কঠিন। এখন দেখছি এডোলেসেন্স কে মোকাবেলা করার জন্য আরো অনেক ধৈর্য আর সাহস দরকার। আবিদ স্যার আমাকে তা যুগিয়েছেন। তাঁর কাছে আমি এবং আমার পরিবার কৃতজ্ঞ। এমন আন্তরিক আর স্নেহপরায়ণ চিকিৎসক এর একটা কথাতেই রোগ সেরে যায়। খুব ইচ্ছে করে সেই বাংলাদেশ দেখতে যেখানে প্রতিটা চিকিৎসক এরকম আন্তরিকতার সাথে কাজ করবেন।
____________________________

সামিয়া কালাম।
প্রোডিউসার এবং আর জে
সিটি এফ এম ৯৬.০

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়