Ameen Qudir

Published:
2018-07-05 14:04:31 BdST

'নাম প্রকাশে অপারগ, জনৈক গাইনি কনসাল্টেন্ট ,পেরিফেরি থেকে '


ছবিটি কাহিনির প্রয়োজনে প্রতিকী ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনের চরিত্র , অবস্থান ও বিবরণ স্থলের সঙ্গে ছবি সম্পর্কযুক্ত নয়। ছবি বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের নয়।

 


ডা. অামেনা বেগম ছোটন
__________________________

অফিসের মিটিংয়ে জুনিয়র এক মেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রসিয়ে রসিয়ে বলল, 'এবার তো ভালই হয়েছে। সিএস স্যার বলেই দিয়েছেন কনসালটেন্টদেরও আমাদের সাথে আউটডোরের সব রোগী দেখতে হবে। ম্যাডাম তো একদিন আমাকে যে ঝাড়ি মারলেন!'

আমি মেডিকেল অফিসারের কথার উত্তর দিলাম না। বাছারা তো কেবল পোষ্ট গ্রাজুয়েশনের কোর্সে আছে, এখনও বোঝেনি কত ধানে কত চাল! এদের ভাব দেখে মনে হয়,আমরা এক লাফে গাছের মগডালে উঠে এসেছি। তারাই কেবল কষ্ট করছে, আমরা কখনোই এই কষ্ট বুঝিনি। তাই প্রায়শই আমাকে শুনতে হয়, 'ম্যাডাম তো সুখেই আছেন,সারাদিন ফেসবুকে লেখালেখি করা ছাড়া আপনার তো আর কোন কাজ নেই'। উত্তরে আমার খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, 'বাবু,আমার বাচ্চারা পেট থেকেই শৈশব পেরিয়ে বের হয়ে এসেছে আর আমিও এমবিবিএসের সাথে সাথেই বাকী সব ডিগ্রী বোনাস হিসেবে পেয়েছি, এসব বুঝি জানোনা?'

কিন্তু এইসব নাদানদের কথার উত্তর দেয়ার মত বেকুব এখনও হইনি। আমাদের প্রশ্ন এবং উত্তর হওয়া উচিত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা আমার স্যারদের সাথে।

আসলে আমাদের স্যাররা কি জানেন, কতটা বৈরী পরিবেশে একজন কনসালটেন্ট দৈনন্দিন চাকুরি করেন? একটু বলি। আমার রুমে কোন এসিষ্ট্যান্ট থাকেনা। আমার রোগীর রেজিষ্ট্রার মেইনটেইন থেকে শুরু করে হিষ্ট্রি নেয়া, বেডে পজিশনিং করে প্রেসার মেশিন বাঁধা থেকে শুরু করে নিজের গ্লাভস নিজেই খুঁজে পরে ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন করতে হয়। এরপর ট্রিটমেন্ট লিখে সময় নিয়ে নিজেই রোগীকে প্রতিটা ঔষধ বুঝিয়ে কাউন্সেলিং করতে হয়। মাঝে মাঝে রোগী কোথা থেকে ঔষধ নিবে বা কোথায় ইনভেস্টিগেশন করাবে সেটাও দেখিয়ে দিতে হয়। কোন কোন রোগী ঔষধ নিয়ে এসে চেক করে দিতেও বলে। এক রোগী থাকতে আরেক রোগী যেন ঢুকতে না পারে, চিৎকার করে সেটা বলে দরজার বাইরে রোগীদের লাইনটাও ঠিক করে রাখতে হয়। রোগীর এক্সামিনেশনের সময় দরজা বন্ধ করে কিংবা পর্দা ঠিক করে দিয়ে আসতে হয় নিজেদেরই। পরের জন আগে এসে ঢুকে গেল কিনা সেটাও খেয়াল করে সিরিয়াল ঠিক রাখতে হয়। কোনভাবে ফার্মেসী থেকে ভুল করে ক্যালসিয়ামের বদলে কট্রিম দিয়ে দেয়,তাহলে নিজেকেই উঠে গিয়ে ফার্মাসিষ্টকে বলে ঔষধ চেঞ্জের ব্যবস্থা করে দিতে হয়। এর ভিতরে যদি বাইচান্স আমার গলা শুকিয়ে যায় তাহলে আশেপাশে কোন পিয়নের দেখা পাওয়া যায় না বিধায় ওনার নাম্বারে মিস কল মেরে ডেকে এনে অনুরোধের সুরে এক গ্লাশ পানি চাইতে হয়।

এখানেই শেষ নয়, আরও আছে। মাস শেষে পরিসংখ্যানবিদ অসহায় ভঙ্গিতে এসে ডাটা নিয়ে দাঁড়ায়,

ম্যাডাম একটু ঠিক করে দেন, বুঝতে পারছিনা।

ষ্টোরের কমিটিতে তো থাকতে হয়ই। ট্রেনিং বা সেমিনার হলে বকবক করে লেকচার দেয়া ছাড়াও প্রি এবং পোষ্ট ইভালুয়েশনের খাতা দেখে মার্ক বসাতে হয়। ইউএইচএফপিও স্যারের অনুপস্থিতিতে মাঝে মাঝে দায়িত্ব নিতে হয়। যদিও আমার মত দু'একজন ভাগ্যবতী ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওনাদের সাথে কনসালটেন্টদের একটা ইগো কনফ্লিক্ট লেগেই থাকে।

আসি, মেডিকেল অফিসারদের কথায়। একদিন একজন খুব সুন্দর করে বলে গেল,

ম্যাডাম আমার বাচ্চাটা নাকি খাচ্ছেনা,আমি বাসায় গেলাম,আপনি রোগীগুলো দেখে দেন।

ভাল কথা,দিলাম। একদিনেরই তো ব্যাপার। কিন্তু এখন তো স্যাররা লাইসেন্স দিয়েছেন। ওদের রোগী দেখে দিতে হবে। এখন আউটডোরে আসা ৫০% রোগী যদি আমাকে দেখতে হয় তাহলে প্রতিদিন কমপক্ষে ৭৫ থেকে ১০০ রোগি দেখতে হবে। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে,এত রোগীর ভীড়ে আমার স্পেশালাইজড রোগীগুলো আমি কিভাবে যত্ন নিয়ে দেখব? সিএস স্যার তো পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন, এন্টি ন্যাটাল পেসেন্ট যেন আমার যত্নেই বারবার আসে। একজন মেডিকেল অফিসার মাসে ৫/৬টা মর্নিং আউটডোর করছে,আর আমি করছি রোজ। সেও এসে যা রোগী দেখবে,আমি রোজ এসে একই সমান রোগী দেখব। ভাল তো,ভাল না?

লেবারের পেসেন্ট যখন আসছে তখন তো কোন মেডিকেল অফিসার ছুঁয়েও দেখেনা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকেই দেখতে হয়। ওরা পোষ্ট ন্যাটাল অর্ডার, এমনকি ছুটির কাগজ পর্যন্ত লিখেনা।

তাহলে, মাঝখান থেকে কি হল? আমার কাজ আমি নিজে করে আবার মেডিকেল অফিসারের অর্ধেক কাজ করে দিব। দিতে তো হবেই, ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা করে রাখার জন্যই তো আমাদের প্রহসনের প্রমোশন দেয়া হয়েছে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে কোন কাজে গেলেই আমার কাজের হিসাব চান।

তোমার ওখানে নরমাল ডেলিভেরীর সংখ্যা এত কম কেন?

স্যার, আমি কি নরমাল ডেলিভেরীর জন্য রোগী বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসব?

তোমার সার্ভিস ভাল হলে এমনিই রোগী আসবে।

কথা ঠিক। আপনারা আমি জয়েন করার আগের এএনসির হিসাবের সাথে এখনকার হিসাব মেলান। না,সেটা কোন ইম্পরট্যান্ট বিষয় না। এরপর শুরু হয় সিজারের হিসাব।

সিজার কেন করছো না?

স্যার, এনেস্থিসিয়ার কনসালটেন্ট না থাকলে আমি সিজার করব কিভাবে?

দরকার হলে বাইরে থেকে এনেস্থেসিস্টের ব্যবস্থা করে করবে।

স্যার,ওনার পারিশ্রমিক কে দেবে?

রোগী দেবে।

স্যার,রোগী তো ওনাকে চিনবে না। বাইরে প্রচার হবে,গাইনীর ডাক্তার পয়সা নিয়ে সরকারী জায়গায় সিজার করে।

তোমাকে ম্যানেজ করতে হবে।

এসবের বাইরেও কিছু উটকো ঝামেলা আছে। কেউ এটাষ্টেড করতে আসলে বাকী সবাই কনসালটেন্টের রুমেই পাঠিয়ে দেয়, ওনাদের কাছে সবসময় সীল থাকে। অফিসের ষ্টাফদের ছেলেমেয়েসহ চৌদ্দগুষ্টির সার্টিফিকেট এক বই সমান ফটোকপি করে নিয়ে আসে। মূল কপি দেখতে চাইলে দু'চার দশ কথা শুনিয়ে দেয়। চাকুরীকালের হিসাবে উনারা আমার চেয়ে সিনিয়র কি না! বাইরে কোন সিকিউরিটি না থাকায় যখন তখন যে কেউ এসে চাঁদা চায়। আমার কাওমি মাদ্রাসার জন্য দশটা কোরআন কেনার টাকা দেন,আমাদের এলাকায় ফুটবল ম্যাচের জন্য চাঁদা দেন,আমার মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। স্থানীয় পলিটিকাল নেতাদের দৌরাত্ম্যের কথা আর নাই বলি।

স্যার, আপনাদের কাছে একটা অনুরোধ ছিল। প্রমোশন পাওয়ার সাধ মিটে গেছে। অল্প বয়সে বড় ডিগ্রী করে যে বিরাট পাপ করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আপনাদের পায়ে পড়ছি, এই প্রহসনের প্রমোশন ফিরিয়ে নিন। আমাদের ডিমোশন দিয়ে আবার মেডিকেল অফিসার বানিয়ে দিন। অন্তত এই উপকারটুকু আমাদের করুন,আল্লাহ্‌ আপনাদের অনেক ভাল করবে।

....... নাম প্রকাশে অপারগ, জনৈক গাইনি কনসাল্টেন্ট ( পেরিফেরি থেকে)

আশা করি গঠনমূলক আলোচনা হবে। অন্যান্য জায়গার ডিউটির সুযোগ সুবিধা, করণীয়, পরামর্শ সম্পর্কে সকলের মতামত আশা করছি।
_____________________________

ডা. অামেনা বেগম ছোটন
Studied at Sylhet M.A.G Osmani Medical College
Lives in Sydney, Australia
সিওমেক
২০০২-০৩

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়