Ameen Qudir

Published:
2018-07-03 14:35:25 BdST

রাইফা আমাদের ক্ষমা করো


 


ডা. ফরহাদ উদ্দিন চৌধুরী মারুফ
___________________________

চিকিৎসক হিসেবে প্রতিদিনই হাসপাতালে আমরা বিভিন্ন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করি। কোনোদিন মন খারাপ হয় আবার কোনোদিন স্বাভাবিক থাকি। আবার ব্যস্ত হয়ে যাই পূর্বের নিয়মে। কিন্তু বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ম্যাক্স প্রাইভেট হাসপাতালে ঘটে যাওয়া ২ বছর বয়সী ছোট্ট শিশু রাইফার করুন মৃত্যু কেন জানি আমাকে প্রচন্ডরকম ব্যথিত করেছে। বাবার কোলে রাইফার নিথর ফ্যাকাশে মুখখানি আমাকে অপরাধী করে। প্রতিনিয়ত আমার ছোট কন্যা আরমিনের কথা মনে পড়ছে। রাইফা এবং আমার মেয়ে আরমিন সমবয়সী। ফেসবুকে মৃত রাইফার করুন ছবি যেকোনো মানুষের হৃদয়কে প্রকম্পিত করবে এবং নিষ্পাপ এই বাচ্চাটির অকালমৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায়না। আমার আরো মন খারাপ হয়ে গেলো যখন দেখলাম বাচ্চাটির মৃত্যুর জন্য ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উঠলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এই ভুল চিকিৎসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলো । এরপর থেকে চট্টগ্রামে আমার পরিচিত অনেকের সাথে যোগাযোগ করলাম প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। রাইফার বাবা এবং তার শুভাকাঙ্খীদের বক্তব্যও শুনি বিভিন্ন মিডিয়াতে। আমি একজন চিকিৎসক হলেও আমি একজন মানুষ এবং একজন বাবা।

যদি একজন বাবার জায়গায় দাঁড়িয়ে ঐদিনের ঘটনাকে বিবেচনা করি তাহলে উনার ভাষ্যমতে বাচ্চাটি ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা নিয়ে ঐদিন হাসপাতালে আসছিলেন এবং রাত্রে বাচ্চাটির খিঁচুনি শুরু হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কর্তব্যরত ডাক্তার বাচ্চাকে সেডিল দেওয়ার পর বাচ্চার অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায় এবং মারা যায়।

হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ লিয়াকত সাহেবের ভাষ্য অনুযায়ী খিঁচুনির একপর্যায়ে বাচ্চাটির দাঁত ভেঙ্গে যায় এবং পার-রেক্টাল ( সাপোজিটরি বা চট্টগ্রামের প্রচলিত ভাষায় ঢুশ ) সেডিল পুশ করার একটা সময় রাইফা নিস্তেজ হয়ে যায়, গুরুতর অবস্থায় বাচ্চাকে আইসিইউতে নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে মারা যায়।

আমার ব্যক্তিগত ভাষ্য
আমি যেহেতু সশরীরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলামনা সেহেতু কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক সে বিষয়ে মন্তব্য করাটা শোভনীয় হবেনা। তবে একজন চিকিৎসক এবং একজন বাবা হিসেবে পুরা বিষয়টার পর্যালোচনা করতে চেষ্টা করছি। যদি একজন বাবা হিসেবে বিবেচনা করি তাহলে রাইফার বাবা সাংবাদিক রুবেল সাহেবের মনের কষ্টটা আমি পুরাপুরি অনুধাবন করতে পারি। উদ্ভুত পরিস্তিতিতে রুবেল সাহেবের মানসিক অবস্থা এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান হারানোর কষ্টে আমি উনার সমব্যাথী। এবং রাইফার মৃত্যুতে ভুল চিকিৎসার অভিযোগের আমিও তদন্ত চাই এবং সত্য উদ্ঘাটন হোক সেটা কায়োমনো বাক্যে প্রার্থনা করি। যদি একজন চিকিৎসক হিসেবে ঘটনা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি তাহলে আসুন প্রথমে ইনজেকশন সেডিল (ডায়াজিপাম) সম্পর্কে জানি। সমগ্র পৃথিবীতে ইনজেকশন সেডিল খিচুনিতে প্রথম চিকিৎসা হিসেবে ব্যবহার হয় এবং শিশু বিশেষজ্ঞরা এটা নিয়মিত ব্যবহার করে থাকেন। মেডিকেল সাইন্সের সব পাঠ্য বই গুলাতে এই ওষুধের কথা লিখা এবং এটা পড়েই এমবিবিএস এবং এফসিপিএস পাশ করেছি। যদি এটা ভুল হয়ে থাকে তাহলে আমরা এতদিন সেডিল সমন্ধে যা পড়ে এসেছি তার সবই ভুল। আমি ব্যক্তিগত জীবনে পেশাজীবী সংগঠন বিএমএ বা স্বাচিপের কোনো ইউনিটের কোনো পদে নেই। সুতরাং আমার ব্যক্তিগত অভিমত কার পক্ষে বা বিপক্ষে গেলো এসব বিষয়ে আমি সতর্ক নই। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও আমার পাঠ্য বই থেকে লব্ধ জ্ঞানে এটা বলতে পারি কর্তব্যরত চিকিৎসক এবং ব্যবস্থাপ্রদানকারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সঠিক ইনজেকশনই প্রয়োগ করেছিলেন । এখন আসেন মাত্রাতিরিক্ত ডোজের বিষয়, বাচ্চার বাবার কথা অনুযায়ী অতিরিক্ত ডোজে বাচ্চা মারা গেছে আবার হাসপাতালের এমডি ডাঃ লিয়াকত সাহেবের কথা অনুযায়ী ওষুধটি পুরাপুরি দেওয়ার পূর্বেই বাচ্চা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাহলে এই পরস্পর বিরোধী বক্তব্যে একটি নিরেপেক্ষ তদন্তের দাবি রাখে । কিন্তু আমরা কি দেখলাম মুহূর্তেই পুলিশ এবং প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন এটা ভুল চিকিৎসা এবং যথারীতি যা হয় ধর ডাক্তার আর নার্সকে। রাত্রে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সকে বাকী ভর্তিকৃত রোগীকে ঝুঁকিতে ফেলে নিয়ে গেলেন থানায়!

জেনে আশ্চর্য হবেন খোদ আমেরিকাতেই তৃতীয় প্রধান মৃত্যুর কারণ হলো মেডিকেল এরর বা কথিত ভুল (সূত্র: https://www.bmj.com/content/353/bmj.i2139.full). তাহলে কি আমেরিকার চিকিৎসকরা কি রোগ নির্ণয় করতে জানেননা কিংবা চিকিৎসা জানেননা ? আমেরিকায় কি রোগনির্ণয়ের উন্নত যন্ত্রপাতি নেই বা রোগের ক্লাসিফিকেশন ( ICD) জানেননা ? খিঁচুনির সময় বাচ্চার মৃত্যুর ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটেছে। এবং অনেক সময় যার কারণ পর্যন্ত উদ্ঘাটন হয়না। খিঁচুনি পরবর্তী বাচ্চার মৃত্যুতে আমেরিকান একটি গবেষণায় দেখা যায় শতকরা ৭৭ ভাগ ক্ষেত্রে ব্রেনের কিছু জন্মগত ছোট ত্রুটি ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ উদ্ঘাটিত হয়নি। বাকি ২৩ ভাগের ভিতরে মেনিঞ্জাইটিস বা ব্রেন ইনফেকশন, পালমোনারি ইডিমা বা ফুসফুসে পানি জমা, হার্টের ইনফেকশন, হার্টের রিদস্পন্দন জনিত ও জন্মগত অনির্ণীত ত্রুটিজনিত সমস্যা, ফরেন বডি বা বাচ্চার শ্বাসনালীতে কিছু আটকে যাওয়া ইত্যাদি (সূত্র: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3286023/). যে গবেষণায় তারা মৃত্য পরবর্তী প্রত্যেকেটি বাচ্চার পোস্ট মর্টেম করে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। শুধু এই গবেষণাই নয় আরো অসংখ্য আর্টিকেল পাওয়া যাবে যেখানে এধরনে মৃত্যুকে unexpected death বা অনাকাঙ্খিত মৃত্যু বলা হয়েছে (সূত্র: https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/28203222)

একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি ঐদিনের পুলিশের অপেশাদারী আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই। আমি বিশ্বাস করি পৃথিবীর কোনো চিকিৎসক তার অধীনে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর ক্ষতি হোক তা চায়না। চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে পারেন কিন্তু রোগীর জীবন দিতে পারেনা। যেটা সৃষ্টিকর্তার এক অপূর্ব লীলাখেলা। রুবেল সাহেবের সাথে ওই চিকিৎসক বা হাসপাতাল কতৃপক্ষের কোনো পূর্বশত্রুতা ছিলোনা। সুতরাং এটি একটি সম্পূর্ণ অনাকাংখিত ঘটনা। এবং আমি নিশ্চিত রোগীর উপর প্রয়োগকৃত চিকিৎসা রোগীর উপকারের জন্যই প্রয়োগ করা।

এখানে একটি মেডিকেল জার্নাালে র লেখার লিঙ্ক দেয়া হল।
https://www.bmj.com/content/353/bmj.i2139.full


__________________________

ডা. ফরহাদ উদ্দিন চৌধুরী মারুফ

FCPS (Medicine) -Fellow at Bangladesh College of Physicians and Surgeons - BCPS
Registrar in Medicine at Dhaka Medical College Hospital, Bangladesh
Former Assistant Registrar (Medicine unit 3) at Dhaka Medical College Hospital, Bangladesh
Studies MSc in Tropical and Infectious Diseases at Liverpool School of Tropical Medicine

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়