Ameen Qudir

Published:
2018-06-06 18:45:47 BdST

রোগী কথনচিকিৎসা বন্ধই যখন চিকিৎসা




 


ডা. ছাবিকুন নাহার
________________________________

একবার এক রোগী এলো উথাল পাতাল জ্বর নিয়ে। কোনমতেই জ্বর কমছে না। একটার পর একটা এন্টিবায়োটিক যোগ হতে লাগল। কিন্তু জ্বর কমার লক্ষণ নাই। দামী দামী এন্টিবায়োটিকের মান ইজ্জত ধূলায় লুটাতে লাগল শাবানার আঁচলের মতো। ওদিকে জ্বর তরতর করে বেড়েই চলছে, বেড়েই চলছে স্টার প্লাসের ক্লাইমেক্সের মতো। এন্টিবায়োটিক এবং জ্বরের যাঁতাকলে বেচারা রোগী একেবারে লাল মরিচের ভর্তা যাকে বলে।

তোমরা হয়তো জেনে থাকবে, রোগীর রোগমুক্তি আর ডাক্তারের ঠোঁটে হাসি সমানুপাতিক। কাজের বিনিময়ে খাদ্য টাইপ। তো কাহাতক আর মুখ চুন করে বসে থাকা যায়? বোর্ড বসানো হলো। জ্বরের চৌদ্দগুষ্টির ইতিহাস নেয়া হলো। এন্টিবায়োটিকের পনেরো গোষ্টিও বাদ গেলো না। বাঘা বাঘা প্রফেসররা সিদ্ধান্ত নিলেন। সব ধরনের চিকিৎসা বন্ধ করো এখনি। কুইক। তারপর দেখি চিন্তা ভাবনা করে কি করা যায়। যেমন কথা তেমন কাজ। সবধরনের ঔষধ বন্ধ। বন্ধ মানে বন্ধ। নো হাংকি পাংকি। জ্বর বাবা তোর খবর আছে। দেখি কত্তদূর যাইতে পারস।

সবাইকে বিস্মিত করে জ্বর কমতে লাগল। প্রথম দিন একটু, দ্বিতীয় দিন আরো একটু, তৃতীয় দিন নাই। নাই মানে নাই। রোগীর চোখে নির্মল হাসি, ডাক্তারের চোখে কিসের যেনো ছায়া। স্বস্তির বোধ হয়। শুকর আলহামদুলিল্লাহ।

জ্বর থামাতে যে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছিলো, সেই ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় জ্বর কমার বদলে বেড়ে গিয়েছিলো। যখন সব বন্ধ করে দেওয়া হলো, আস্তে আস্তে জ্বরও চলে গেলো। এরপর থেকে আবিস্কৃত হলো যুগান্তকারী এ চিকিৎসা। যখন কোনো দাওয়াই কাজ করেনা, বন্ধ করে দাও সব দাওয়াই। দেখবে ঠিক রোগী ভালো হয়ে যাবে।

তাই বলছিলাম কি কখনো কখনো থামতে হয়। যত দামী এন্টিবায়োটিক তত বেশি সাইড ইফেক্ট। যত রকম বেশি, তত রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। একসময় মূল রোগ আড়ালে ঘাঁপটি মেরে রয়ে যায় এই ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ভীরে। কাজ কী তাহলে এসব দাওয়াই এ। থামতে জানা-ই যেখানে বড় দাওয়াই!

আসো একটু থামি। সপ্তাহ খানেকের জন্য। ভুলে যাই জুঁই চামেলি নামে কোন গ্রুপ ছিল। সবধরনের নয় ছয় কিংবা ছয় নয় আট জীবনে আসেনি। আসবে না কোন কালে। কেউ কখনো ব্যথা দেয়নি। কথা দিয়ে ভুলে যায়নি। অন্যায় করেনি। অকৃতজ্ঞ হয়নি।

ভুলে যাই কে কবে ব্যথা দিয়েছিলো এই মনে। কে কবে নিজেকে বানিয়েছি ব্রাক্ষ্মন অপরকে শূদ্র। ক্ষমা করি। নত হই। নিজেকে শুধাই কী চাই? কী লাভ এসব করে? কেনো করি?

মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলেছো তো! এখন আসো শান্ত মাথায় চিন্তা করি, আমরা কী চাই? মহাবিশ্বের এই জার্নিতে ঠিক কতটা দাগ আমি কাটতে চাই? কতটা বীজ আমি বা আমরা বপন করতে চাই, ফুলে ফলে ভরে দিতে এ বিশ্ব? আর কতটাই বা স্বার্থপর হতে চাই এক জনমে? তার আগে চলো একটা গল্প শুনি। স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টির গল্প:

: ইশ্বর শরীর সৃষ্টি করেছেন ভালো কথা। ব্যথা কেনো সৃষ্টি করলেন? আপনি কী জানেন না এ শরীরে ব্যথা সয় না!

ইশ্বর মুচকি হেসে বললেন,

: ঠিক আছে আজ থেকে তোর সব ব্যথার অনুভূতি মুছে দিলাম, তুই আর কিছুতেই ব্যথা পাবি না।

সৃষ্টিকর্তার দয়ায় সৃষ্টি তো তাক ধিনাধিন তাক। নাচতে নাচতে তার পা গেলো ভেঙ্গে, হাত গেলো খুলে! হায় হায় করল, সব লোক কিন্তু সে তো নির্বিকার! ব্যথা তো লাগছে না, সমস্যা কি? কিন্তু যখন উঠে দাঁড়াতে গেলো, দাঁড়াতে তো পারেনা আর। আবার গেলো ইশ্বরের কাছে। ইশ্বর তো অবাক!

: কী হে বাছা আবার কেনো এসেছো? তুমি তো সব ব্যথা বেদনার উর্ধ্বে।

এবার সৃষ্টি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল,

: আমাকে ব্যথা ফিরিয়ে দিন পিতা।

: কেনো বলতো? এই তো বেশ আছিস তুই নির্জঞ্ঝাট! না প্রভু আমি ভুল বলেছিলাম। ব্যথা বেদনা দরকার আছে। আমার পা টা ভেঙ্গে গেলো, হাত টা খুলে গেলো। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। ব্যথা পাইনি বলে আমি সড়িয়ে নেইনি। এই দেখুন, আমি এখন দাঁড়াতে পারিনা, হাতে কিছু ধরতে পারি না। যদি ব্যথার বোধ থাকত তাহলে এমনটা ঘটত না, আগেই আমি সতর্ক হতাম।

এবার ইশ্বর মিটিমিটি হেসে জবাব দিলেন,

: এবার বুঝলে তো বাছা, আমি কেনো ব্যথা সৃষ্টি করেছি?

: খুব বুঝেছি প্রভু। ঠিকঠাক থাকতে হলে সব দরকার আছে। সুখের সাথে দুঃখ। আনন্দের সাথে বেদনা। বন্ধুর সাথে শত্রু। মতের মিলের সাথে অমিল। সব যদি পাশাপাশি থাকে তবেই না আমরা ঠিকঠাক থাকব। ঠিকঠাক থাকতে গেলে আমাদের সবাইকে দরকার আছে, সব্বাইকে।

বুঝা গেলো ব্যাপারটা? কখনো কখনো থামতে পারা, কখনো ক্ষমা করতে পারা, কখনো কখনো ভুলে যাওয়া, কখনো কখনো নত হওয়া অনেক বিপর্যয় ঠেকিয়ে দেয়। আসো একবার সব ভুলে যাই, সব ফিরে পাওয়ার আশায়।


_________________________

ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়