Ameen Qudir

Published:
2018-06-03 17:33:30 BdST

অন্ধজনে দেহ আলো: এবার চক্ষুরত্নের কর্নিয়ার ত্রিমাত্রিক ছাপার সুসংবাদ


 


আজিজুল শাহজী
______________________________

এই যুগের এক উল্টে পাল্টে দেওয়া প্রযুক্তি হলো এই ত্রিমাত্রিক ছাপার যন্ত্র বা থ্রি ডি প্রিন্টিং। ইতিমধ্যেই এর ব্যবহার বাড়ি তৈরী থেকে ছোট যন্ত্র এমনকি ড্রোন বা ধরুন খাদ্যদ্রব্য বা মহাকাশে নাসার পরিকল্পনা অনুযায়ী মঙ্গল বা চাঁদে উপনিবেশ তৈরির বাড়ি ইত্যাদি তৈরির উপকরণ ,কি না করছে বা করতে চলেছে এই প্রযুক্তি ! আর কিছু বছর পরে কৃত্রিম অঙ্গ তৈরিতেও এর ছাপ দেখতে চলেছি আমরা। তবে তার গল্প অন্য পরিসরে করবো। হয়তো কৃত্রিম অঙ্গের বিষয়ে অন্য কিছু লিখবো খুব শিগগিরই তার আগে আজকে দেব এক অন্য সুখবর।


হ্যা,শিরনাম অনুযায়ী অন্ধত্ব রোধে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন প্রচুর মানুষের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়। আমরা আবার চক্ষুরত্ন ফিরে পাই অস্ত্রপচারের মাধ্যমে। কিন্তু সমস্যা হলো যে বছরে কর্নিয়ার দরকার যেখানে ১.৫ কোটি লোকের অথচ যোগান দেখছি মাত্র ৪৪ হাজার!ব্রিটেন এর হিসেবে দেখছি স্রেফ ওই দিকেই ২০ লাখ এর উপর লোক এই কারনে অন্ধত্বের শিকার হয় বা আরো সোজা হিসেবে ৩০ জনের একজন একই কারনে দৃষ্টি শক্তি হারায়।

 

কর্নিয়া

 

উপরের হিসেবেই বুঝতে পারা যায় এত সীমিত দাতা হওয়ার কারণে বাকি দুর্ভাগা মানুষরা বসে থাকেন কোনো কর্নিয়ার প্রত্যাশায়। এইদিকে আমাদের মতো দেশগুলোতে আবার এই ক্ষেত্রে না আছে সেই সচেতনতা না আছে অঙ্গ দান এর এবং তার সংগ্রহের সুব্যবস্থা।এর উপর আবার আছে কারো কারো ধর্মীয় নিষেধ এর মধ্যযুগীয় কার্যকলাপ!অন্ধ থাকবো বা বিকলাঙ্গ নাগরিক নিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে থাকবো কিন্তু দেহ দান বা অঙ্গ দান করবো না ! অবশ্য ওই ‘ধর্মপ্রাণ’মানুষদের ঠিকাদারদের প্রয়োজনে অপবিত্র দেশগুলোতে হাত পাততে কোনো অসুবিধে নেই ! যাইহোক,এইসব বলা ঠিক না ! লাইনে আসি,মানে আবার বিষয়ে ফিরে যাই।

এই প্রয়োজন মিটিয়ে দিতে এক নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে এক অভূতপূর্ব আনন্দের খবর। নিউ ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তৈরী করেছেন একটি জৈবকালি 'বা বায়ো ইংক ' ওটা হলো মূল উপাদান যা দিয়ে মানুষের কর্নিয়া তৈরী করা সম্ভব হবে ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার এর সাহায্যে ! এই সুসংবাদ তারা জানিয়েছেন এক্সপেরিমেন্টাল আই রিসার্চ এর জার্নালে।এই অভাবনীয় কাজের জন্য যে দুজন গবেষক কে অকুন্ঠ কৃতজ্ঞতা দেওয়া উচিত তারা হলেন ডক্টর স্টিভ সীয়ক্লো (Steve Swioklo) এবং তার সহ গবেষক চে কনন (Che Connon) ।

কর্নিয়া আমাদের চোখের একদম বাইরের একটি স্তর। ওটা রোগ বা কোনো আঘাতের কারণে নষ্ট হলে আমাদের চোখে দেখার ক্ষমতা কমে যায় অথবা অনেক ক্ষেত্রে একদম দৃষ্টিহীন হয়ে যেতে পারি। এখনো পর্যন্ত ওটার চিকিৎসা বলতে এর প্রতিস্থাপন ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। আর এখানেই এই উদ্ভাবন আমাদের আশীর্বাদ হয়ে এসেছে !

কি ভাবে ওটা করলেন গবেষকরা ?
নিউ ক্যাসল এর গবেষকরা জৈব কালি তৈরির জন্য উপযোগী স্টেম সেল (ধাত্রী কোষ ?) কে এর মূল উপাদান করেছেন। এখন ওই কাজ করবো বললেই করা যায় না। ওই স্টেম সেল এর মূল বস্তুটি হতে হবে এতটা আঁটোসাঁটো যে ওটার আকৃতি অটুট যেন থাকে আর নরম মানে তরল ধাঁচের হয় যাতে ওই ত্রিমাত্রিক প্রিন্টারের নজেল মানে ওই কালি ফেলার মুখ দিয়ে ওটা বেরোতে পারে। এই কাজ করতে বহু গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

এক্ষেত্রে নিউ ক্যাসেল এর গবেষকরা সফল হয়েছেন মূলত দুটি বস্তুর ব্যবহারে , এক এলগিনেট আর দ্বিতীয় কোলাজেন। মূল ত্রিমাত্রিক প্রিন্টার কিন্তু প্রচলিত একটি ত্রিমাত্রিক কোনো বিশেষ ধরণের কিছু না আর এই কৃত্রিম কর্নিয়া তৈরী করতে নিচ্ছে ১০ মিনিট করে সময় ! এর আগে অবশ্য ওই গ্রহীতার চোখের একটি স্ক্যান করে নিতে হচ্ছে যাতে ওই প্রতিস্থাপনের কর্নিয়া যেন ব্যক্তির ওই কর্নিয়ার আকৃতির সাথে একদম মাপমতো হয়।

মনে রাখবেন, কর্নিয়া হলো বহিস্থ একটি আবরন যা বাইরের জগত আর আমাদের চোখের ভিতরের অংশের মধ্যে একটি দেওয়ালের মতো।একই সাথে এর কাজ হলো বাইরের আলো কে সঠিক ভাবে চোখের লেন্স এবং রেটিনাতে প্রবেশ করানোর সঠিক মাত্র এনে দেয়।কোনো সুক্ষ্ম কিছু ও চোখে পড়লে ওটা আটকে দেয় এবং এর সাথে যুক্ত থাকা অজস্র নার্ভ তার জানান দেয়।এই জন্য এর তৈরির কাজে দরকার হয় জৈবিক কোষ আর প্রয়োজনীয় পদার্থ যা দিয়ে ওটা মানে ওই জীবিত কোষগুলোকে একত্রিত রাখা যায়।মানে হলো ওটা তৈরির সময় মানে ওই কর্নিয়া ছাপানোর পর ওতে রাখতে হয় স্টেম সেল বা কর্নিয়া তৈরির ধাত্রী কোষ। ওটাকে এই আকৃতিতে বেঁধে রাখতেই এলগিনেট আর কোলাজেন জেল বলে দুটো জৈবিক রসায়নিক কে ব্যবহার করা হয়। আরো মজার হলো এই কাজ করার পর দেখা গেছে এই কোষ মানে ওই কর্নিয়ার একটি আবশ্যক কোষ কেরাটোসাইট এর ৮৩ শতাংশ জীবিত রয়ে যাচ্ছে এক সপ্তাহের বেশি,ওই ছাপানো কর্নিয়ার মধ্যে এবং ওটা জীবিত রাখা গিয়েছে স্বাভাবিক তাপমাত্রাতে!অর্থাৎ কোষ কে আকৃতির মধ্যে রেখে ওই কর্নিয়া কাজ করবে তার প্রমান পাওয়া যাচ্ছে।বানিজ্যিক ভাবে ভাবলে ওটা বোঝাই যাচ্ছে যে তৈরী করার পর তাকে পরিবহন করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া ও অনেক সহজ হবে এই তাপমাত্রার কারণে।আর এর মূল বস্তু মানে ওই স্টেম সেল সংগ্রহ হয় কোনো সুস্থ সবল দাতার কর্নিয়ার স্টেম সেল থেকে আর বাকি জৈব রসায়নিক এর যোগান ও খুব একটা খরচ স্বাপেক্ষ না ।

আর কত দিন লাগবে এই প্রযুক্তির মানুষের কাজে লাগতে ?
আর কিছু বছর , কারন এই কর্নিয়ার বাকি কোষগুলোর জীবিত থাকা আর পুরো বস্তুটি মানুষের উপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে কি না ওটা না দেখে স্বীকৃতি তো দেওয়া যাবে না। ততদিন , আসুন একটু বিজ্ঞানের এই দান কে হাত পেতে নিয়ে বসে থাকে।

 

কর্নিয়ার প্রত্যাশায়

 

বিজ্ঞান চায় না কোনো পুজো বা অর্চনা অথবা বিশেষ ভীতি , সে চায় তার চর্চার অবারিত দ্বার আর সুযোগ। আমরা যদি ঐটুকুই করে দিই তা হলে আগামীর দিনগুলো অসাধারন হবে যেমন হয়েছে আজকের দিন। না, পাঠক, আবার 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম ' ভাববেন না। স্মৃতি সততই সুখের তাই অতীতের ব্যর্থতা বা বাধা আজ আমাদের তেমন চোখে পরে না। আবার বলছি আগামীর দিনগুলো ভীষণ সুন্দর হবে তাই আসুন সেই আগামী কে নিয়ে আসতে সহযোগিতা করি আর না করলে অন্তত ওতে বাঁধা তৈরী না করি !
জয়তু বিজ্ঞান ! জয়তু মানব উদ্ভাবনী !

পুনশ্চ : অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখি,গুপ্তচরের ধারাবাহিক,র এবং আইএসআই আর শান্তির মরিচিকা বলে একটি কিতাব পড়ছি দিন দুই হলো, বেশ আগ্রহ তৈরির বই !আপনারা ও পড়ুন,ইচ্ছা আছে ওটা নিয়ে আরো দিন দুই এর মধ্যে একটু পর্যালোচনা মানে রিভিউ লেখার আর ট্যাকা টুকা দিলে বঙ্গানুবাদ করার ....বইটির আসল নাম সঙ্গে দিলাম,অনেক কথা আছে ওতে.সবাই পড়ুন ! THE_SPY_CHRONICLES_RAW_ISI_and_the_Illusion_of_Peace_AS_Dulat_Asad_Durrani_and_Aditya_Sinha
তথ্যসূত্র :
১. মূল গবেষনা যেখানে আছে তার সুত্র https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pubmed/29772228
২. পুরো প্রক্রিয়ার একটি ভিডিও প্রতিবেদন https://www.youtube.com/watch?v=7xoRe2OFNnI
৩. মানুষের চক্ষুরক্ষা আর এই সমস্যা নিয়ে কাজ করে এমন একটি মহতি উদ্যোগের উপর একটি সাইট,দেখতে অনুরোধ করছি https://www.fightforsight.org.uk/
৪. মূলধারার সংবাদপত্রে এর উপর দেওয়া বর্ননা https://www.thehindu.com/…/3d-printed-co…/article24039693.ece
৫. https://www.techtimes.com/…/scientists-create-the-very-first…
৬. https://www.express.co.uk/…/Science-news-3D-printed-organs-…
_____________________________
লেখ ক আজিজুল শাহজী। বাংলাভাষার জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক। থাকেন কলকাতায়।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়