Ameen Qudir

Published:
2018-06-02 19:33:51 BdST

তবুও ভালো থাকি


এক মুমূর্ষু রোগীর প্রতিকী ছবি। হাসপাতালে নিয়ে এলে জীবনের সুস্থতার সম্ভাবনা ; কিন্তু কোয়াক চিকিৎসায় ঘটে অনেকসময় জীবননাশও। ছবির সঙ্গে এই কাহিনির সংশ্রব নেই।

 


ডা. মৃণাল সাহা
_____________________________

বছর দুয়েক আগে আমি একটা বাড়িতে যাই একজন মুমূর্ষু রোগীকে দেখবো বলে। আমি গিয়ে দেখলাম উনি স্ট্রোক এর পেশেন্ট। প্রথমে একদিক সামান্য অবশ থাকলেও এখন তিনি অজ্ঞান। বমিও করেছেন। দুই দিন ধরে উনি পড়ে আছেন, উনার প্রস্রাব পায়খানা পরিষ্কার এর দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। উনার ছেলে মেয়ে বিদেশ থাকেন, ওরা ফোন করে ডাক্তার দেখাতে বলেছেন। আমি রোগীকে দেখতে গিয়ে দেখলাম উনার আশেপাশে অনেক মানুষ। সবাই তাকিয়ে আছেন, এদের মাঝে কেউ আছেন যারা শেষ বিদায় এর অংশ হিসেবে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করছেন।

আমি যে উনাকে ভালোভাবে দেখবো তার উপায় নেই, কেউ এগিয়ে এসে পেশেন্ট এর পজিশান ঠিক করে দিচ্ছেনা। বারবার বলার পরও সবাই বললো, স্যার উনারে নড়াচড়া করানো সমস্যা। অগত্যা আমি বিছানার উপর উঠলাম, দেখলাম, দেখে কিছু ঔষধ আর টেস্ট করতে বললাম।

আমি উনাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করার কথা বললাম উনারা শুনলেন না। আমি দেখলাম রোগীর স্ট্রোক এর কারনে রোগী যতটা না খারাপ হয়েছে তার চেয়ে বেশী খারাপ হয়েছে উল্টাপাল্টা খাওয়ানোর কারনে এসপিরেশান আর পায়খানা প্রস্রাব পরিষ্কার না করার কারনে ইনফেকশান। উনাদের বুঝিয়ে বলে আমি ফিরলাম।

ঔষধ দেয়ার পর কিছুটা উন্নতি হলো। এন্টিবায়োটিক দেয়া হলো পল্লী চিকিৎসক দিয়ে, উনারা আমার কথা শুনলেন না। নাকে নল, প্রস্রাব এর নল কিছুই দেয়া হলো না। মুখে খেতে দিতে নিষেধ করা হলেও উনারা অতি আন্তরিকতায় সেটা থোড়াই কেয়ার করলেন। আমার সন্দেহ ছিলো এর সাথে হয়তো ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স আছে। উনার পরীক্ষার জন্য আরেক পল্লী চিকিৎসককে ডাকলেন যিনি রোগীর রক্ত টানলেন এবং সেই রক্ত ল্যাবে পৌঁছালেন। সেই ল্যাব রিপোর্ট দিলো। আমার জানা মতো সেই ল্যাবে সিরাম ইলেকট্রোলাইটস এর রিপোর্ট হবার কথা না।

রোগী হালকা একটু সুস্থ্যতা অনুভব করলে ওরা উনাকে ধরাধরি করে নিলেন সিটি স্ক্যান করতে। এরই মাঝে রোগীর রক্তের রিপোর্ট দেখেছে পল্লী চিকিৎসক। আমি খবর নিতে গেলাম, আমাকে জানানো হলো, আমি যা যা দিয়েছি সব উনারা করেছেন।

এরপর শুনলাম পেশেন্টের জ্বর, আবার অজ্ঞান। একদিন পর রোগীটা মারা গেলো। আমি দ্বিতীয় বার খবর নিতে গিয়ে উনার মৃত্যু সংবাদ পেলাম। বুঝলাম এসপিরেশান নিউমোনিয়া থেকেই হয়তো সেপটিসেমিয়া হয়েছে। দেখলাম রোগীর লোকের কোন ভাবান্তর নেই!

আজ বহু বছর পর যখন ভাবতে বসলাম, নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হলো। রোগী দেখে টাকা নেয়াটাই যদি আমার প্রফেশান হয় তাহলে আমার কেন কষ্ট লাগবে? কি জানি জানি না, পকেট যখন শূন্য থাকলে, এমন হোম কল বহুদিন আমাকে উজ্জীবিত রেখেছে। এদের বেশীর ভাগই বেঁচে গিয়েছে, যাদের বাঁচাতে পারিনি, তাদের কাছে আমার আজন্ম ঋণ। খুব কষ্ট হয়!

সেই সাথে এটাও ভাবি যারা মুমূর্ষ রোগীর প্রতি এতটুকু মানবতা দেখায় না, তারা কোন গ্রহের বাসিন্দা? নিজের আত্মীয় কিম্বা ঘরের মানুষকে যারা অনাদরে ফেলে রাখেন, এতটুকু নার্সিং কেয়ার পর্যন্ত করেনা তারা কিভাবে এই দেশে সুচিকিৎসা আশা করেন?

চ্যারিটি বেগেইনস এট হোম, প্লিজ, কর্তব্যের খাতিরে কাউ ডাক্তার ডেকে ডাক্তারের হতাশা বাড়াবেন না। কিছু টাকা না পেলে ডাক্তারের জীবন যাবে না। বরং রোগীর সেবা করে ডাক্তারকে সাহায্য করুন, সবাই মিলে সাফল্যের অংশীদার হউন। একজন মানুষের বেঁচে ওঠা দেখার মত সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। আজ আপনি যা করছেন, সেটাই আপনার সন্ত্বান শিখছে, কাল আপনি বৃদ্ধ হলে আপনার সন্ত্বনা আপনার শেখানো পথেই আপনার জন্য করবে।
________________________

ডা. মৃণাল সাহা। সুলেখক।

 

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়