Ameen Qudir

Published:
2018-06-01 17:18:24 BdST

শুক্রবারের বিশেষ কলামকসাই চিকিৎসকের ফাঁসি দিয়ে গাছের কান্ড দিয়ে কিডনির চিকিৎসা মিডিয়াই করুক


 


ডা. ছাবিকুন নাহার
_________________________

কিছুদিন পর পর দু একটা তাজা খবর বেরোয়। সে খবরে আমরা জনগনরাও তাজা হয়ে উঠি। সাংবাদিকতায় নাকি নেগেটিভ নিউজই পজিটিভ কিছু। নেগেটিভ দিয়ে যদি প্রচার পায় তবে নেগেটিভই ভালো। কে না জানে প্রচারেই প্রসার। আসুন প্রচার করি গরম খবর।

* ডায়রিয়ার রোগীকে কলেরা স্যালাইন দিলেন চিকিৎসক। হইসে ডায়রিয়া দিল কলেরা স্যালাইন! এরা কী মানুষ!

* স্টেম সেল মানে গাছের কান্ড দিয়ে কিডনি রোগের চিকিৎসা। কান্ড দিয়ে চিকিৎসা করুন এবং আমাদের কান্ড কারখানা দেখতে থাকুন।

* নবজাতকের মাথা থেকে ধড় আলাদা করলেন কসাই চিকিৎসক। কসাই চিকিৎসকের ফাঁসি চাই, ফাঁসি ছাড়া উপায় নাই।

আরো এমন ভুরিভুরি উদাহরন দেয়া যাবে। টিভিতে এমন নিউজের স্ক্রলিং দেখে জনগনের মাথা নষ্ট হওয়ার যোগার। কী অবস্থা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার। হায় হায় সব গেলো গেলো। চল পালাই বিদেশ যাই, এই দেশত চিকিৎসা নাই।

আসামীদের একজন হিসাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নিশ্চয় আমার আছে। একটু সাফাই গাই। পাঠক আশা করছি কিছুটা হলেও আপনাদের ক্ষোভ কমাতে পারব। কে জানে হয়তো আশাতীত কিছুও হতে পারে। যদিও আমরা আশা তেমন করি না। তারপরও দেখা যাক কী হয়।

ডায়রিয়া একধরনের পানি বাহিত রোগ। ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ও নানারকম অনুজীবের সংক্রামকের কারনে এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের পাতলা পায়খানা হয় এবং শরীর থেকে পানি এবং ইলেকট্রোলাইট বের হয়ে যায়। রোগী ভয়াবহ পানিশূন্যতায় ভোগে। যার পরিনতি মারাত্মক। মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে ইলেক্ট্রোলাইট সমৃদ্ধ পানি বা ফ্লুইড দেয়া। রোগী মুখে খেতে পারলে ওরস্যালাইন। না পারলে শিরা পথে উক্ত ফ্লুয়িড দেয়া হয় যার নাম কলেরা স্যালাইন। এটাই চিকিৎসা। এবং একমাত্র চিকিৎসা।
ডায়রিয়া রোগীকে কলেরা স্যালাইন না দিয়ে কী ডাবের পানি, চিড়ার পানি শিরাপথে দেবে? নাকি ডায়রিয়ায় নির্গত জিনিসপাতি দিয়েই চিকিৎসা করবে, একটু যদি বলতেন সংশ্লিষ্ট নিউজ বানানেওয়ালা বিজ্ঞজন? তাহলে এদেশের নাদান চিকিৎসকের কিছুটা হলেও হাড় জুড়াত।

টিভির স্ক্রলের কান্ড নিয়ে লংকাকান্ড বেঁধে গেছে। সবাই হুড়োহুড়ি করছে কান্ড সংগ্রহ করতে। কিডনি বলে কথা। গবেট মুর্খ হাম্বাদিক ( আমি এদের সাংবাদিক বলতে নারাজ। আমি যেমন কোয়াকদেরও চিকিৎসক বলতে নারাজ) স্টেম সেলকে বলছে গাছের কান্ড! দেখো কান্ড। অথচ স্টেম সেল হলো একধরনের কোষ। সাধারনত অস্থিমজ্জা এবং শরীরের আরো কিছু জায়গায় পাওয়া যায়। যা পুনর্গঠন যোগ্য। বিজ্ঞানীরা এই সেলকে কাজে লাগিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া অংশকে বা অসুস্থ অঙ্গ পতঙ্গকে মেরামত বা নতুন করে তৈরী করার চেষ্টা করছেন। আর তাকেই কিনা গাছের কান্ড বানিয়ে দিলেন সাংবাদিকতার কোয়াক হাম্বাদিক। একটু পড়াশোনা না করে এত সহজে বঙ্গানুবাদ করে দিলেন মশায়। মেডিকেল সায়েন্স এত্ত সোজা! তারচেয়ে ভালো হাম্বা হাম্বা করেন। সেটাই আপনাকে মানাবে বেশি।

এখন আসি সবচেয়ে ভয়ংকর এবং একই সঙ্গে হট খবরে! এইবার পত্রিকার কাটতি কে থামাবি আয়। দেখায় দিব কাটতি কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি। নবজাতকের গলা কেটে ধর থেকে মাথা আলাদা করলেন চিকিৎসক। কসাই চিকিৎসকের ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই। ফাঁসি ছাড়া বাচন নাই। খাইসে! ডাক্তারদের এবার তেরটা বাজল বলে। আচ্ছা যত বাজে বাজুক। তার আগে দেখি তো ঘটনা কি?

চিকিৎসা বিজ্ঞানে মৃত বাচ্চাকে প্রসব করানোর কিছু পদ্ধতি আছে। সবগুলো পদ্ধতিরই একটি মটো থাকে, মাকে যতটা পারো কম কষ্ট দেয়া।
মা অনেক সয়েছে, তাকে আর কষ্ট দিও না। বাচ্চা তো মারাই গেছে, বরং যা যায় বাচ্চার উপর দিয়েই যাক। ফলে দেখা যায় বাচ্চা যদি উল্টা থাকে। জন্মপথে যদি মাথা আঁটকে থাকে তাহলে অনেক সময় মৃত বাচ্চার গলা থেকে মাথা আলাদা করে ডেলিভারি করা হয়। এটাকে বলে ডিক্যপিটেশন। আঁতকে উঠলেন তো, উঠেন।
এটা একটা স্বীকৃত পদ্ধতি। এমন আরো অনেক পদ্ধতি আছে, সময় সুযোগ হলে বিস্তারিত বলব।

বাচ্চাকাচ্চা রোগীদের, জন্মপথও রোগীদের। রোগীর মরা বাচ্চা তারই জন্মপথে আঁটকে গেছে। মাথা আঁটকে ঝুলছে মৃতবাচ্চা মায়ের দুপায়ের মাঝখানে। কী ভয়াবহ! খালাশ করতে গলদঘর্ম হয়ে চেষ্টা করছে ডাক্তার। কেটে কুটে বের করছে, রোগীকে মুক্তি দিতে। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে কাটতে কেমন লাগে জানেন? হউক মরা। মানুষ তো। জানেন না। জানলে বলতেন না। নির্লজ্জভাবে ফাঁসি চাইতেন না। একটু হলেও বুক কাঁপত।

সামান্যতম জ্ঞান না নিয়ে পেশাগত ব্যাপারে নিউজ করা প্রকৃত সাংবাদিকতার হুমকি সরুপ। কাজেই শিক্ষা ব্যবস্থার মান রাখতে এবং সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সুমহান সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে আগাছা দমন জরুরি। না হয় আগাছায় ক্ষেত খেয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু না।

বালক খেলার ছলে যে ঢিল ছুঁড়ছ, সে ঢিলে তো আমাদের জীবন যায়। ঢিল খাওয়া ব্যাঙের মতো আমরাও কাঁদি। তোমাদের নির্বুদ্ধিতায় আমাদের কান্না পায়। সে কান্নার মাশুল এ দেশের জনগনকে কড়ায় গন্ডায় দিতে হবে, লিখে রাখো বলে দিলাম। এখনি যদি অপসাংবাদিকতা রুখতে না পারো, পরিশ্রমের মূল্যায়ন না করো এবং মানীলোকের যোগ্য সম্মান না দাও তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে বাধ্য। ডাক্তার রোগীর সম্পর্কে চির ধরলে ক্ষতি কার একবার ভাবো। ভেবে বলো। সময় বয়ে যায়...।
______________________________

ডা. ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়