Ameen Qudir

Published:
2018-05-30 18:00:16 BdST

ছ'আনার মালেক প্রফেসর : যিনি একটি মেডিকেল কলেজ করতে চেয়েছিলেন


 

কর্মবীর মালেক প্রফেসর



মাসুদ আলম বাবুল
_________________________________

প্রফেসর আবদুল মালেক আখন্দর সত্য কাহিনি।

দোষ ত্রুটির ঊর্ধ্বে কোনো মানুষ নয়। হয়তো মালেক স্যারও সেরকমই একজন মানুষ ছিলেন। যার সারাটি জীবনই ছিলো সংগ্রাম আর টিকে থাকা। শিক্ষাক্ষেত্রে অসামান্য অবদানে আজ একটি অজপাড়া গাঁয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল এক শিক্ষা কমপ্লেক্স যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। আর এও বিশ্বাস করা যায়না যে এটি গড়ে তুলেছেন একজন হতদরিদ্র মালেক আকন যাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে অন্যের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গনিতে অনার্স মাস্টার্স করা এ মানুষটি সব সময়ই নিজেকে ছ'আনার মালেক আকন বলতেন অবলীলায়। অনেক দরিদ্র ছাত্রকে ঘর থেকে ধরে এনে তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন শত শত আমার মতো আধা শিক্ষিত বেকারদের। মৌকরণে তিনি গড়ে তুলেছেন প্রাইমারী স্কুল, নিজ নামে হাইস্কুল, বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় (যেটি তিনি তার এক শিক্ষাগুরুর নামে নামকরণ করে গুরুদক্ষিণা দিয়েছেন)। বিএড কলেজ, ডিগ্রি কলেজ, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ। যেগুলোর প্রত্যেকটির পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র মৌকরণেই। মৌকরণে একটি মেডিকেল কলেজ করার কথাও ভাবছিলেন এ ছ'আনার মালেক স্যার। কিন্তু শেষমেষ এ দুঃসাধ্যকে তিনি সাধন করতে পারেননি।

 

এ অঞ্চলের বহু প্রতিষ্ঠান প্রধানরাই আইন কানুন বুদ্ধি বিবেচনার জন্যে যেতেন মালেক স্যারের কাছে, আমিও যেতাম। আমার জীবনের সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে স্যারের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি। পটুয়াখালী শহরে হাজী আক্কেল আলী হাওলাদার কলেজ প্রতিষ্ঠা ও আমার বাবার নামে বেতাগী ডা. আছমত আলী কলেজ প্রতিষ্ঠায় স্যারের ছিলো ঐকান্তিক সহযোগিতার হাত। অপরিসীম ধৈর্য্যশীল একজন মানুষ ছিলেন তিনি। ২০১০ সনে আমার কলেজ এমপিওভুক্তির সময় স্যার একটানা তিনটি রাত নির্ঘুম আমাদের সাথে কাটিয়েছিলেন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ এ মানুষটির মধ্যে একটুও ক্লান্তির ছাপ সেদিন দেখিনি। এ শুধু কাজ পাগল মানুষরাই পারে, অন্য কারো পক্ষে তা সম্ভব নয়।
কয়েকশত মানুষের কর্মসংস্থান করে দেয়া এ মানুষটিকে শেষ পরিনতি হিসেবে বরণ করে নিতে হলো অর্থাভাবে বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা। কারাভোগ করতে হলো সহকর্মীদের দেয়া মিথ্যা চাঁদাবাজি মামলায়।

শেষ যাত্রায় মানুষের ভালবাসা ও কান্না

 


একটি করুণ ঘটনার কথা না বললেই নয়-
তখন আমি আর মৌকরণ কলেজে কর্মরত নই। আমার কলেজের কাজে আমি ঢাকা থেকে বরিশালে ফিরছিলাম। কেবিন থেকে বের হয়ে দেখি মালেক স্যার উষ্কখুষ্ক শশ্রুমন্ডিত, লঞ্চের করিডোরে চিন্তিত ভাবাপন্ন হয়ে বসে আছেন। তখন মৌকরণ কলেজে তার দুরবস্থার কথা কিছুটা অবগত ছিলাম। এ অবস্থা দেখে আমি নিজেও অশ্রুসজল হয়ে পড়লাম। ডাক দিতেই স্যার আমার দিকে তাকালেন, বললেন, মাসুদ সাব!
আমি বললাম হ্যাঁ স্যার, আপনি!! এভাবে?
তিনি বললেন মামলার কাজে এসেছিলাম
বললাম, কেবিন পাননি?
তিনি বললেন, না কেবিনের প্রয়োজন নেই
বুঝতে পেরেছি স্যারের হাতে টাকা নেই। জোর করে ধরে এনে আমার রুমে বসালাম, দৌঁড়ে গেলাম সুপারভাইজারের কাছে, যে করেই হোক আমাকে একটি কেবিন ম্যনেজ করে দিতেই হবে।
সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার, সামনে শুক্র-শনি দু'দিন সরকারি ছুটি। সুপারভাইজার বললেন, সরি স্যার, লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে, একটু আগেও যদি বলতেন, হয়তো পারা যেতো, এখন আর কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
আমার রুমে স্যারের রাতের খাবার ব্যবস্থা করলাম, কেবিন বয়কে বললাম, তোমাদের যা যা মেন্যু আছে নিয়ে আসো। স্যার খুব আনন্দ করে পেট পুরে খেলেন। আমরা কেউ মৌকরণ গেলেও স্যার না খেয়ে আসতে দিতেন না। বললাম, স্যার আমার এখানেই থাকেন আপনার সারাদিন অনেক পেরেশানি গিয়েছে, আমি আপনার পাশে বসে থাকি আপনি একটু আরামে ঘুমান। নাছোড়বান্দা এ মানুষটি কিছুতেই রাজি হলেন না। শুধু বললেন, পারলে আমাকে একশ টাকা দেন তাতেই উপকার হবে।
বললাম, একশ টাকা দিয়ে কি হবে?
বললেন, লঞ্চের ভাড়াটাকাটা আছে, বরিশাল থেকে বাড়ি যেতে তো একশ টাকা লাগে।
বললাম, আমাকে যদি না পেতেন?
তিনি বললেন, বরিশাল নেমে কারো কাছে থেকে ধার করতাম
: রাতে খেতেন কি?
: পানি, শুধু পানি খেয়েও থাকা যায়।
: সকালে, দুপুরে কি খেয়েছেন?
: সকালে পাউরুটি চা, দুপুরে একজনে বাদাম আর একজনে চানাচুর খেতে দিয়েছিলো।

""ও কিছুনা মাসুদ সাব, আল্লার নবীও তাঁর ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে এরচেয়েও বেশি না খেয়ে ছিলেন, এরচেয়েও বেশি অপমান নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।""

 


নিজের অজান্তেই চোখ দু'টো কিভাবে যেনো আর্দ্র হয়ে উঠলো, সমস্ত শরীরজুড়ে এক বেদনাময়তার ছাপ পড়ে গেলো মুহূর্তেই। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। স্যার বুঝতে পারলেন, বললেন, ও কিছুনা মাসুদ সাব, আল্লার নবীও তাঁর ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে এরচেয়েও বেশি না খেয়ে ছিলেন, এরচেয়েও বেশি অপমান নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। আমিতো সামান্য মালেক আকন, প্রতিষ্ঠান প্রধান হয়েছেন, নিজে প্রতিষ্ঠান করছেন একদিন টের পাবেন। অবশ্য টের পাওয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই একেক সময় মনটা সত্যিই পালাই পালাই করে যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না করে গোটাদুয়েক ডেয়রি বা পোল্ট্রি ফার্ম করতাম তা বোধহয় ইহজগতে অনেক বেশি কাজে আসতো। জানিনা, আমরা যারা কষ্টেসৃষ্টে খেয়ে না খেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মনের আনন্দে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করি তাদের পরিনতি কি মাকড়শার মায়ের মতো স্বীয় সন্তানের হাতে জীবন সংহার? নাকি মালেক স্যারের মতো অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় ধরাধাম ত্যাগ করা? জানিনা, শুধু জেনে রাখলাম দরিদ্র এক মালেক আকনের শিক্ষার আলো জ্বালাবার নেশা, আর নিরব নিঃশব্দে পৃথিবীর নাট্যমঞ্চ থেকে প্রস্থান করা???
যাইহোক, স্যারকে আমি একহাজার টাকা দেয়ার জন্যে জোরাজোরি করলাম কিন্তু তিনি কোনোভাবেই নিতে সম্মত হলেন না, শেষমেষ ৫০% এ রফা হলো, নিলেন মাত্র ৫০০/-, আর রুমে তো থাকলেন ই না।
বললাম স্যার, তাহলে ক'টা বেনসন কিনে দেই
তিনি বললেন, না, আমি লিভ খাই
আমি তৎক্ষনাৎ কেবিন বয়কে এক প্যাকেট গোল্ড লিফ সাগারেট এনে দিতে বললাম
স্যার বললেন, না, মাত্র পাঁচটা
শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললাম, এখানেও বাঁধা? আচ্ছা যা দরকার কেবিন বয়কে বলেন, ওকে বলা আছে।
মালেক আকনের থাকার মতো তেমন ভালো একটি বাসস্থান নেই, নেই কোনো ব্যক্তিগত জমিদারি। আছে শুধু দৃশ্যমান কিছু মানুষ গড়ার কারখানা- যা তিনি তাঁর সারা জীবনের সংগ্রাম অার ত্যাগ তিতিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন।
এ যেনো সুকান্তর সেই কবিতা
"আমি যেন সেই বাতিওয়ালা, যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য" !!!
মালেক আকনের নিজের ঘরে বাতি জ্বালাবার সামর্থ্য কোনো কালেই ছিলোনা, তাই তিনি সকলের বিভেদ, শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে জীবনের সবটুকু আলো নিভিয়ে নিরবে চলে গেলেন আলোহীন অন্ধকার ঘরে।
______________________________

মাসুদ আলম বাবুল
অধ্যক্ষ
হাজী আক্কেল আলী হাওলাদার ডিগ্রি কলেজ
পটুয়াখালী।

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়