Ameen Qudir

Published:
2018-05-27 19:08:16 BdST

নিপাহ ভাইরাস এবং আমরা


 


 
আজিজুল শাহজী, কলকাতা
______________________________


এই লেখার শুরুর আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা করছি। একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক তবে না বলে পারছি না,প্রায় বছর দুয়েক এই জাকার্বার্গের খুড়োর কলে এসেছি । আপনারা এত ভালোবেসেছেন যে মায়ায় আটকে গিয়েছি, না হলে ইচ্ছা ছিল ডুব মারি ...এর বেশি কিছু বলার নেই। যারা আমাকে মনে রেখেছেন তাদের জন্য বলি, আমার লেখায় ভুল দেখলে ধরিয়ে দিন,আমাকে সংশোধিত করুন । আজকে ইচ্ছা ছিল আনন্দের কিছু লেখা কিন্তু কিছু করার নেই এই লেখাটা দিতেই হলো সবার জন্য কারন আগে মানুষের প্রাণ তারপর বাকি কিছু ।

আমরা জেনেছি যে কেরালাতে সরকারী ভাবে তিনজন মারা গিয়েছেন এই নিপাহ ভাইরাসের প্রকোপে।আরো অন্তত ২৫ জন আক্রান্ত । এই মৃত মানুষদের মধ্যে আছেন একজন নার্স মানে সেবিকা যিনি রোগীর চিকিত্সা করতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছেন ।আশা করি বুঝতেই পারছেন রোগটি ছোয়াচে এবং মানুষ থেকে মানুষে বাহিত হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা আছে ।

কি ভাবে ওটা বিপদের কারন হয় ?
ভাইরাস একটা অদ্ভুত চিজ, ওটা আবার কোনো নির্দিস্ট প্রাণীর (তা সে স্তন্যপায়ী হোক বা অন্য কোনো ) উপর তার কেরামতি দেখায় । মানে ধরুন, মুরগির উপর যে ভাইরাস আক্রমন করবে ওটা কুকুরের উপর করবে না । আরো মজার হলো ওটা কোষের ভিতরেই বংশবৃদ্ধি করে ! শুধু তাই না, ওটা আবার সব কোষের ভিতর ঢুকতে পারে না । এর সাথে আরো সাংঘাতিক একটি বিষয় আছে তা হলো ওরা নিজেদের বদল করে একই প্রজাতির অন্য প্রানীকে ও আক্রমন করতে পারে । আর এই জায়গাতেই হচ্ছে বিপদের অশনি সঙ্কেত !
তাতে কি ?ভাইরাস তো আছেই !

হ্যা তবে এক্ষেত্রে সমস্যা অনেক গভীর। কারন,ওটা ছড়াচ্ছে আরো এক স্তন্যপায়ীর মাধ্যমে,আর ওই জীবটি আমাদের খুব পরিচিত,বাদুড় ! হ্যা ওই বাদুড় এক অদ্ভুত জীব যে পাখির মতো উড়ে বেড়ায় আবার স্তন্যপায়ী ! এই জীব হলো ওই জীবাণু মানে নিপাহ ভাইরাস এর বাহক।বাদুড় মূলত রাতের বিভিন্ন গাছে গাছে ফল খেয়ে বেড়ায় আর তাদের আস্বাদিত ফল আমাদের কাছে প্রায়শই আসে সরাসরি বা বাজারের থেকে।অন্য পাখির থেকে কিন্তু সংক্ৰমণ হচ্ছে না যা আপনি বাদুড়ের কারনে দেখছেন,কারণ ওটি স্তন্যপায়ী এবং আমাদের প্রজাতির কাছাকাছি বলে।আরো ঝামেলা হলো এই সংক্রমণের ছড়িয়ে যাওয়া অনেক বেশি তাড়াতাড়ি হবে যেহেতু এই একমাত্র স্তন্যপায়ী উড়ে বেড়ানো জীবটি এর বাহক। মূলত বাদুড়ের লালা থেকে এই রোগের সংক্রমণ হয়ে থাকে তাই বাদুড় যা কিছু মুখে দেবে আর ওটা যদি আমাদের সংস্পর্শে আসে তা হলে এই রোগের ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরী হয়। তা সে যে খাবারই হোক।

শুধু সংক্ৰমণ এর বিষয় হলে হয়তো এতটা আতংকগ্রস্থ হতাম না যদি না এই ভাইরাস মানুষের মস্তিষ্কের উপর সংক্ৰমণ না করতো। এমনিতে আমাদের মাথার ভিতরে মানে মস্তিষ্কে ওষুধ বা জীবাণু দুটোই ঢুকতে বেগ পায়। এই বিষয়ে আমার খুব একটা জানা নাই তবে আমাদের রোগ প্রতিরোধক কোষ ও কিন্তু ওতে কম তেমনি রক্তের মাধ্যমে আমরা যে প্রতিষেধক নিয়ে থাকি ওটা ও খুব একটা ঢুকতে পারে না। একই ভাবে জীবাণু ও ঢুকতে পারে কম কিন্তু যদি ঢুকে পরে তা হলে তাকে প্রতিরোধ করার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা বা বাইরের থেকে ওষুধের ব্যবস্থা ও করা কঠিন হয়। মাথায় 'ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার' (blood-brain barrier) বলে একটি পর্দা আছে। ওটা আমাদের মস্তিষ্কে ঢোকার মূল দরজা ভাবতে পারেন । আগেই যেমন বলেছি ওটা দিয়ে ভেতরে ঢোকা কঠিন ,এই পর্দাটি শরীরের রক্ত আর স্নায়ুতন্ত্র এবং মস্তিষ্কে প্রবাহিত বিশেষ তরলের (Cerebrospinal fluid) মধ্যে একটি অতি প্রয়োজনীয় পার্থক্য বা ফারাক সৃষ্টি করে রাখে। ভয় এই কারণে যে ওই নিপাহ স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমিত হয় আর এই প্রাচীর ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতে পারে।

আমাদের মস্তিষ্কের বাইরের আস্তরনে সংক্রমণে হয় যে রোগ ওটা বলে মেনিনজাইটিস আর ভিতরের স্তরে হলে এনসেফেলাইটিস। এই পরেরটি হচ্ছে আমাদের আলোচিত নিপাহ ভাইরাস এর কারণে ! আশা করি বুঝতে পারছেন বিষয়টা কত গুরুতর।
ইন্টারনেট ঘেটে দেখতে পাচ্ছি এই রোগটি মালেশিয়া এবং সিঙ্গাপুরে প্রথম দেখা যায় এবং পরবর্তীতে ২০০১ এ ভারতে আর তারপরে বাংলাদেশে। আবার এখন ভারতে,আগের ট্র্যাক থেকে যা বুঝতে পারছি আমাদের এইদিকে ওটা সংক্ৰমণ হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে অন্তত অতীত রেকর্ড তাই বলছে। মালেশিয়াতে ১৯৯৯ এ শুওর থেকে ওই রোগ এর প্রাদুর্ভাবের আতঙ্কে লাখ দশেক প্রাণীকে মেরে ফেলা হয়। বিশাল ব্যবসায়িক ক্ষতি ও হয় ওতে দেশটির। পরবর্তীতে দেখা যায় ,ওই প্রাণীদের আলাদা করে রেখে দিলে ওটা এড়িয়ে যাওয়া হয়তো সহজ হতো। আরো জানতে পারছি পর্যাপ্ত তাপমাত্রায় গরম না করে খেজুরের রস খেলে ওটা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যা হয়েছিল ওই ক্ষেত্রে। একই ভাবে খেজুর বা যে কোনো ফলের ক্ষেত্রে একই সতর্কতা নেওয়া জরুরি যা নিচে লিখলাম।
শরীরে ঢোকার পর ওটা নিজের খেলা দেখাতে সময় নেয় মোটামুটি ৪৫ দিনের মধ্যেই ,অনেক ক্ষেত্রে দিন চারেকের মধ্যেই শুরু হয়ে যেতে পারে। যে উপসর্গ হতে পারে তার ফিরিস্তি হলো জ্বর,মাথা ব্যাথা ,মাসল এর খিঁচুনি,শ্বাসকষ্ট বা মাথা ঘোরা , ভুল বকা,অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। উপসর্গ নিয়ে বেশি বলছি না কারন আমার অদেখা এক গুরু শিবরাম বলেছেন ওই রোগের বিবরণ আরো বেশি করে আমাদের রোগ প্রবন করে ফেলে। আমার কাজ আপনাদের ভয় বা আতংকগ্রস্থ করে দেওয়া না !
তবে সমস্যা হলো ওই রোগ থেকে সেরে উঠলেও ওটার ছাপ থেকে যায় অনেক ক্ষেত্রেই বা আবার ওই রোগ ফিরে আসে অথবা স্থায়ী ভাবে রেখে যায় নার্ভের রোগ বা কর্মক্ষমতার উপর প্রভাব। সোজা কথায় রোগটি বেশ ভয়াবহ। এর মাধ্যমে মৃত্যুর হার অনেক ক্ষেত্রেই ৭০ ভাগের উপরে তাই আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভীত।

বিপদ আরো বেশি কেন ?
মূলত এটি হওয়াতেও ছড়াতে পারে। কোনো সংক্রমিত রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস বা হাঁচি ইত্যাদি বাতাস বাহিত হয়ে ছড়িয়ে যেতে পারে অন্য সুস্থ মানুষের মধ্যে। আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আপনি আউটডোর বা সাধারণ বেড বা প্রাথমিক পরীক্ষার গণ পরিষেবার জায়গাতে কোনো বিশেষ ব্যবস্থা আশাই করতে পারেন না। যতক্ষনে রোগ চিহ্নিত হচ্ছে ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এছাড়া ওটা গৃহপালিত পশুর থেকেও সংক্রামিত হতে পারে। ওই যে দেখছেন স্রেফ শুয়র থেকে হচ্ছে ইত্যাদি ঐগুলো আমার মতো অর্ধেক জানা লোকের লেখা ,একদম পাত্তা দেবেন না !
এর চিকিৎসা কি ?
দুর্ভাগ্যের বিষয় এখনো পর্যন্ত কোনো চিকিৎসা নেই ! সত্যিকারের কোনো পরিত্রানের ওষুধ আমি কোথাও খুঁজে পাই নি। ক্লোরোকুইন মানে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসাতে কাজ দেয় যে ওষুধ ওটা পরীক্ষাগারে সফল হলেও বাস্তবে কাজে দেয় নি।

এই জন্য আমার মতো ক্ষুদ্র বুদ্ধির মানুষের যা মনে হয়েছে ওটা হলো, বাদুড়ের খাওয়া ফল আরো সোজা কথায় যেখানে পাখি বা অন্য জীবের খুঁচিয়ে যাওয়া ফল দেখবেন ওটা এড়িয়ে যান। যদি আক্রান্ত কাউকে চিহ্নিত করা হয় তা হলে তার কাছে যাবেন না ,রোগ আপনার কাছের না রোগী হলেও ,ওটা চিকিৎসক বা তার সহযোগীর উপর ছেড়ে দিন। এক্ষেত্রে আপনার আবেগ আপনার এবং বাকিদের জন্য বিপদের কারন হতে পারে !
আরো বিপদ হলো,বাদুড়ের কোনো বিশেষ প্রজাতি না ,সব ধরণের গুলোই এর সংক্ৰমণ করার প্রবণতা দেখা গিয়েছে ! আর ওই জীবটি আমাদের ভারতে বা বাংলাদেশে একটি অতীব পরিচিত জীব।
আমরা ফল অনেক সময়ে ধুয়ে খাই না বা রোগীকে ওই উপরে যেমন বললাম, আবেগ দিয়ে পরিচর্যা করতে যাই ফলে মানুষ এর সংক্রমনের কারন আরো বেশি হয়ে যায়। আমাদের নিজেদের সচেতনতা ও অনেক কম, চিকিৎসা ব্যবস্থা বা আলাদা করে চিকিৎসা করার (সংক্রমণবাহী রোগের ক্ষেত্রে ) ব্যবস্থা অতীব অপ্রতুল। খেয়াল করবেন,যত এম্বুলেন্স দেখেন প্রায় প্রত্যেকটির গায়েই লেখা 'সংক্রমক রোগের জন্য না ',ফলে বুঝতেই পারছেন বিষয়টা কত গুরুতর।

বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের আরো বেশি সতর্ক থাকা উচিত কারন প্রাদুর্ভাব কিন্তু এইদিকে বেশ বেশি ! বিশেষত বাংলাদেশে এর প্রাদুর্ভাব আগের রেকর্ড অনুযায়ী অনেক বেশি আমাদের ভারতের তুলনায়।

তাতে আমাদের কারোর কোনো পৈশাচিক বা অন্য আনন্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই কারন ওটা ঠেকাতে কোনো ঐশী গুণাবলী নেই। আমাদের দেশগুলো বা অধিকাংশ দেশে উপযুক্ত গবেষণার ব্যবস্থা নেই। আমরা এই বিষয়ে বা সোজা কথায় মানুষের জন্য এই খাতগুলোতে বরাদ্দ রাখি অতীব কম। আমাদের দরকার অস্ত্র বা অন্য বস্তু তাই মানুষের ক্ষেত্রে কোনো হেলদোল নেই কারোর। এতো জনসংখ্যার দেশগুলোতে কয়েক হাজার মরলে কি এসে যায় ? ওটা উপরে বসা কোনো কাউকে দেখিয়ে দিলেই হয়ে যায় তাই মরে সাধারণ মানুষ।

শেষ ভরসা সেই বিজ্ঞান বা আরো সোজাসুজি বললে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষকদের কাজের উপর অপেক্ষা করে আছি। কামনা করি কোনো মহামারী যেন না শুরু হয়। মানুষ যে সর্বাধিক মূল্যবান সম্পদ মানুষের জন্য ওটা আমরা কবে বুঝবো ?

তথ্যসূত্র :
১. https://www.bbc.com/news/world-asia-india-44207740
২. এনসেফেলাইটিস কি জানতে দেখুন https://en.wikipedia.org/wiki/Encephalitis
৩. ওই মস্তিষ্কের প্রাচীর সমন্ধে জানতে দেখতে পারেন https://en.wikipedia.org/wiki/Blood%E2%80%93brain_barrier
৪. https://www.fort.usgs.gov/…/…/publications/22419a/22419a.pdf
৫. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বিষয়ের সূত্র https://www.who.int/csr/disease/nipah/en/
৬. এই রোগের উপর আরো জানতে দেখুন https://www.cdc.gov/vhf/nipah/symptoms/index.html
৭. যদি এই ভাইরাস নিয়ে বিশেষজ্ঞর পর্যায়ের খবর নিতে চান https://jvi.asm.org/content/78/2/834.full

__________________________

আজিজুল শাহজী। প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক । কলকাতা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়