Ameen Qudir

Published:
2018-05-08 01:28:56 BdST

'আমি হাসপাতালকে ভয় পাই :আমার স্টেশন রোড ভালো লাগে, হাসপাতাল রোড নয়'





কামরুল হাসান
__________________________

এমনিতে আমি হাসপাতাল এড়িয়ে চলি (গোপনে বলি, আমি হাসপাতালকে ভয় পাই) পারতপক্ষে হাসপাতালের দিকে পা ফেলি না। আমার স্টেশন রোড ভালো লাগে, হাসপাতাল রোড নয়। তা হাসপাতাল কে ভালোবাসে? সে হাসপাতাল যত সুন্দরই হোক না কেন। আমরা হাসপাতাল ভালোবাসি কেবল তখন যখন হাসপাতাল নতুন শিশুর অাগমন বার্তা ঘোষণা করে। কিংবা মরনাপন্ন কেউ যখন সুস্থ হয়ে ফিরে আসে জীবনের আলোহাওয়ায় তখন হাসপাতালকে মনে হয় জগতের সবচেয়ে সুন্দর দালান।

আজ সকালে আমাকে হাসপাতালে যেতে হলো। শুভানুধ্যায়ীগণ নিশ্চয় এতক্ষণে আঁতকে উঠেছেন অামার কী হলো বলে। না, অামার কিছু হয়নি, অামি গিয়েছিলাম অামার এক অাত্মীয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত খরচের বিষয়ে খোজ নিতে। তার হার্টের একটি ভাল্ব পুরোপুরি অকেজো, অন্য অারেকটি অর্ধেকটা। হৃদরোগ সার্জারি বাংলাদেশে শুধু অপ্রতুল নয়, ভীষণ ব্যয়বহুল। অামি যে হাসপাতালটিতে অাজ গেলাম, সেটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল হাসপাতাল। Price এর সাথে Quality যে সরলরৈখিক সম্পর্ক তৈরি করেছে, সেটি এখানেও সচল। তাই গেলাম ঢাকার বিখ্যাত ইউনাইটেড হাসপাতালে।

অভিজাত গুলশান এলাকায় এই অভিজাত হাসপাতাল তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। গুলশান ২ এর ৭১ নম্বর সড়কের শেষপ্রান্তে গুলশান লেকের পাড়ে তার অালিশান দালান। দেখলে মনে হবে কোন এক অাধুনিক রাজার (মিলিওনার) বাড়ি। তার স্থাপত্য এত নান্দনিক যে হাসপাতালভীতু অামারও রোগী হবার ইচ্ছে হলো। গৈরিক পাথুরে রঙের নয়তলা (ভূমির উপরে সাততলা) হাসপাতালটির মধ্যভাগে সবুজ কাচের বৃহৎ বৃত্তাকার ডোম। প্রবেশপথটি সেখানেই। ৪৫০ বেডের হাসপাতালটির মোট ফ্লোর স্পেস ৪ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গ ফুট।

ইমার্জেন্সির গেট দিয়ে ঢুকে গাড়ি পার্ক করছি, সিকিউরিটি গার্ড এসে বাইরের গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে বল্ল। প্রভাতবেলার অতিথির এই অপমান? অাসলে তা নয়, প্রবেশের পথখানিতে বাইরের সড়ক ধরেই যেতে হয়। সমুখের সবুজ ল্যান্ডস্কেপে মেহিত হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে অানলাম সে হাঁসমহলের (তার মাথায় পাখাও অাছে) অাবার সড়কের কিনারায় যেখানে বেসমেন্টে পার্কিং জোন।

গেটে সিকিউরিটি চেক দেখে অবাক হই না, ঢাকার সকল স্থাপনাতেই এখন এই উষ্ণ অভ্যর্থনা, বিশেষ করে হলি অার্টিজানের সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর এটা সর্বত্র চালু। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি সেই লোমহর্ষক জায়গাটি এই হাসপাতালের খুব কাছে, এক সড়ক দূরত্বে। ভেতরে ঢুকে একে অার হাসপাতাল মনে হলো না, মনে হলো পাঁচতারা হোটেলের লবি। বৃত্তাকার সুবৃহৎ জায়গাটিতে বসার ব্যবস্থা। সকাল বেলাটা ছিমছাম, অাউটডোরে কিছু রোগী ও তাদের অাত্মীয়রা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে অাছে। ডানে ফার্মেসি, বামে রোগী ভর্তি, সোজা রেডিওলজি বিবিধ দেয়ালে উৎকীর্ণ লেখা দেখে সম্বিত পাই এটা হাসপাতাল, হোটেল নয়। কিন্তু এডমিশনের কাউন্টারের নিচে রাখা বিভিন্ন কক্ষের ভাড়া দেখে ফের বিভ্রম জাগে, না বোধকরি ভুল করে হোটেলেই ঢুকে পড়েছি। সে বিভ্রম আরো বাড়ে যখন ভিতরে যাই, যেখানে তিনটি রেস্তোরাঁ। এদের নাম Indulge, Scoop ও Unimart Express । দেখে কে বলবে এটা পাঁচতারকা হোটেলের লবি নয়!

অামি যার কাছে পরামর্শের জন্য এসেছি, তিনি এ হাসপাতালের বিখ্যাত হার্ট সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর কবির। কেবল এ হাসপাতালের নন, তিনি সারা বাংলাদেশেই খ্যাত। ইউনাইটেড হাসপাতালের কার্ডিয়াক সেন্টারের তিনি প্রধান। তাকে কিশোর বয়স থেকে চিনি। তার বাবা অার অামার মামা করাচিতে পাশাপাশি থাকতেন, পরস্পরের ব্ন্ধু। মনে পড়ে অাজ থেকে কুড়ি বছর অাগে, অামি তখন প্যান প্যাসিফিক সোনার গাঁও হোটেলে রিজার্ভেশন ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছি, সেসময়ে ডা. কবিরকে দেখেছি ভারতের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন ডা. শেঠীর সাথে ঘুরতে। এখন বুঝি তিনি তার জীবনের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন এবং সঠিক নেতার পিছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। কার্ডিয়াক সার্জারি জটিল ও উচ্চ ঝুঁকির, তাই বেশিরভাগ চিকিৎসক এ পথে অাসেন না। বেশিরভাগ বল্লাম? শতকরা ৯৯ ভাগই এ পথ এড়িয়ে চলে। ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের মতো কেউ কেউ চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন। ফিনান্সের রিস্ক-রিটার্ন রিলেশনশিপ মেনে হার্ট সার্জনদের অায়ও অাকাশচুম্বী।অামি অামার জীবনে যে কয়েকজন মানুষের উল্কার মতো উত্থান (meteoric rise) দেখেছি তিনি তাদের একজন।

পাদটীকা:

ডা. জাহাঙ্গীর কবির প্রথমে আমায় চিনতে পারলেন না। না চেনারই কথা, বহুদিন দেখা হয়নি আমাদের। পরে মামার নাম বলতেই চিনতে পারলেন। তার সাথে দরকারি কথা শেষ করে নিচের ফুড জোনে তিন দোকানের একটিতে বসেছি ব্রেকফাস্ট খেতে, কেননা সকাল থেকে তেমন কিছু খাই নি। সেখানে যেরকম জমজমাট খাওয়াদাওয়া চলছে তাতে ভুলে গেলাম অামি হাসপাতালে অাছি।

আমার সম্মুখে একই টেবিলে একজন এসে বসলেন। তিনি নিয়েছেন চা ও স্যান্ডউইচ। আমি নিয়েছি ইংলিশ ব্রেকফাস্ট - তিন পিস পাউরুটি সঙ্গে মাখন, জেলি ও ওমলেট। এর দাম আর স্যান্ডউইচের দাম কিন্তু একই, ১০০ টাকা। আমার খাবার নির্বাচন ভালো হয়েছে থেকে আমাদের আলাপের শুরু।

উপরের লেখাটি পড়ে শোনানোর সময় তার সতর্ক কান 'পৈচাশিক' শব্দটিতে অাটকে যায়। তিনি সংশোধন করে দেন। অামার অপনিহিতির ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলেন, শব্দটি হবে 'পৈশাচিক।' অামি ধন্যবাদ দেই এবং ভ্রমসংশোধন করবো বলে প্রতিশ্রুতি দেই। তখন জানতে পারি তার বাবা একজন লেখক ছিলেন, যিনি ফয়েজ অাহমেদ ফয়েজের কবিতা উর্দু থেকে অনুবাদ করেছিলেন।

তার নাম পূর্ণিমা জামিল। স্বামী জামিল অাহমেদ অালীম পেট্রোবাংলার একজন পরিচালক। গত ১১ এপ্রিল কোটা বিরোধী অান্দোলন চলাকালীন তার গাড়ি তেজগাঁওয়ের সাত রাস্তার মোড়ে পিকেটাররা অাটকে দিলে তিনি গাড়ি থেকে নেমে সিএনজি নেবার মানসে রাস্তা পেরুতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনায় পতিত হন। তিনি এখন ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি।

কথায় কথায় জানালেন তিনি ইব্রাহিম লোদীর বংশধর। তার দাদার নাম লবী নেওয়াজ খান লোদী। পিতৃপুরুষ উত্তর ভারত থেকে এসে পাবনার শাহজাদপুরে নিবাস গড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সাথে লোদী পরিবার ও তার নানার পরিবারের সখ্য ছিল। নানা ছিলেন খান বাহাদুর। পূর্ণিমা জামিলের তিন দাদীর নাম স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন, যথাক্রমে লক্ষ্মী, শান্তি ও দেবী। মুসলিম মেয়েদের নাম, বিশেষ করে বনেদী মুসলিম পরিবারের মেয়েদের ওরকম 'হিন্দু' নাম রাখা নিয়ে সেসময় সমালোচনা হয়েছিল। কবিগুরু রেখেছিলেন বলে রক্ষা। সুন্দরী তিন বোন ঐ নাম নিয়েই অাজীবন কাটিয়ে গেছেন।

অামরা কথা বলছি এমনি সময় স্ত্রী ও বালকপুত্রকে নিয়েসেখানে উপস্থিত হলেন অামার এক তরুণ সহকর্মী, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ান। পরমুহূর্তে হাজির অামার প্রাক্তন ছাত্র রঞ্জন। ফেসবুকে আমার স্ট্যাটাস দেখে সে আমাকে খুঁজতে ক্যান্টিনে চলে এসেছে।

নিজের পরিবার নিয়ে গর্বিত পূর্ণিমা জামিল দুমেয়ের মা। পাকিস্তানের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব খান তার ফুফা জানালেন। অপরূপ সুন্দরী তার ফুফু বানী খানের যৌবনকালের ছবি দেখালেন মোবাইল থেকে বের করে। তার অাগে দেখিয়েছিলেন তার দাদার ছবি। এক সমৃদ্ধ ও কীর্তিমান পরিবারের ছবি তার মোবাইলে বয়ে বেড়ান। তার দুই মেয়েও চমৎকার লেখে -সগর্বে জানালেন তিনি।
_________________________

কামরুল হাসান । বাংলাদেশের প্রথিতযশ কবি। ভ্রমণকার। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।

 

 

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়