Ameen Qudir

Published:
2018-04-11 17:40:59 BdST

ভাবছি, ডাক্তারি আর করবো না : আপনারা নিজেরাই ডাক্তারি করুন:ডাক্তার বয়কট করুন


প্রতিকী ছবি। ছবির মুখ বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গের নয়।

 

ডা. নাজিয়া শুভ্রা
______________________________

৫ মাসের দুধের শিশু রেখে পুনরায় নাইট ডিউটি শুরু করি। মায়েদের পাহারা দেই, তাদের অনাগত বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করি। বাচ্চা আমার তার মায়ের বুকে ঘুমানোর জন্য, একটু দুধের জন্য চিৎকার করে কেঁদে চলে সারারাত। আর আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী অফিস থেকে রাত করে ফিরে বাচ্চাকে কোলে করে সারারাত পায়চারী করে আর ডাক্তার বিয়ে করার ভূলের মাসুল গুনে রাতভর। সকালে বাচ্চাকে নিতান্ত অপরিচিত কাজের লোকের হাতে তুলে দিয়ে আলমারি থেকে কোঁচকানো শার্টটা বের করে গায়ে চড়িয়ে বুয়ার গুছানো খাবারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে ঝিমুতে ঝিমুতে রওনা দেয় অফিস মুখে।
ক্লাস ফোরে পড়া আমার বড় ছেলে যেন বয়সের চেয়ে বেশী দায়িত্ববান হয়ে উঠে। একা একা এলার্ম দিয়ে সকালে সময়মতো উঠে বুয়ার হাতের তৈরি খাবারটুকু স্বাদের বালাই না করে খেয়ে না খেয়ে দাদার হাত ধরে স্কুলের দিকে রওনা হয়। সেদিনতো জুতো ঠিকমতো পলিশ না হওয়ার কারণে স্কুল মাঠে প্রায় অর্ধশহস্র ছাত্রের সামনে লজ্জায় পড়তে হয়েছে। আমি মা সেটাও কি অসীম ক্ষমতা বলে হজম করে যাই।

বাসায় লাগানো আই-পি ক্যামেরার বদৌলতে দেখতে যেমন পারি ছোট্ট বাচ্চাটাকে, তার কান্নাও যে পরিস্কার শুনতে পাই। কিন্তু বের হয়ে আশা দীর্ঘ নিঃশ্বাসটাকে গোপনে আড়াল করে খুব আস্তে আস্তে ছাড়ি। চোখ ভরে উপচে আসা পানিকে বাইরে বের হতে না দিয়ে যত্নের সাথে গোপনে গিলে ফেলি যেন কারো চোখে ধরা না পড়ে আমার এ দুর্বলতাটুকু। তারপর দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যাই ইমারজেন্সির দিকে। ছেলের প্রথম ডাক, প্রথম হামাগুড়ি, প্রথম দাঁড়ানো সবই ঘটে যায় আমার আড়ালে।

বড় ছেলে বলে, আজতো মা শুক্রবার/শনিবার কেন তুমি চলে যাও আমাদের রেখে? অথবা বলে, মা আজ রাতে তোমায় বেঁধে রাখব যেন যেতে না পার। আমি বলি " বাবা, আম্মুতো অন্য আম্মুদের জন্য যাই, তাদের বেবিগুলোর জন্য যাই, আম্মু না গেলে ওদের কে দেখবে? কয়জনের আম্মু বল এতো ভালো সুযোগ পায়?" সে বোঝে, বুঝেও প্রতিদিন একই আলাপ চলে মা-ছেলের।
ছোট বাচ্চাটাকে বুক থেকে জোর করে সরিয়ে, ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে বের হয়ে আসি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। এই দোয়া পড়ি দরজার বাইরে এসে
।।। বিসমিল্লাহি তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহ্, ওয়ালা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লাবিল্লাহ্ ।।। অর্থাৎ " আল্লাহর উপর ভরসা করলাম। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া পাপ থেকে ফিরা এবং পুণ্য করা সম্ভব নয়।" মনে মনে এই চিন্তা নিয়ে এগুই যে আমি অন্যের সন্তানের জন্য বের হয়েছি, ইনশা আল্লাহ্‌ আমার সন্তানদের আল্লাহ্‌ই হেফাযত করবেন।
উমরাহ্ -এ গিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করেছি সর্বত্র, "হে আল্লাহ্‌ আমি যদি কারো উপকার করতে নাও পারি অন্তত আমার দ্বারা কারো ক্ষতি যেন কোনদিন না হয়"।

এই কাহিনী প্রতিটি ডাক্তার মেয়ের কাহিনী। এই কষ্ট প্রতিটি ডাক্তার মায়ের কষ্ট আর এ যুদ্ধ প্রতিটি ডাক্তার মেয়ের যুদ্ধ। এতো আত্নত্যাগ, এতো কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনের বেশীরভাগ সময় যেখানে কাটে অজানা অচেনা অসহায় বিপদগ্রস্ত মানুষগুলোর সাথে, তাদের নিয়ে নিতান্ত মনোরঞ্জনের জন্য কোন ডাক্তার কখনো ছেলেখেলা করবে আমি কখনোই তা বিশ্বাস করিনা।
একটি দিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনায় যারা যাচাই বাছাই না করে বাকি ৩৬৪ দিনের আত্নত্যাগকে এক মুহুর্তে তুচ্ছজ্ঞান করে সব ডাক্তারদেরকে এক কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বিচার করতে আসেন, সেই মানুষদের ডাক্তারি নাই বা করলাম। এর চেয়ে গৃহিনী হয়ে স্বামীর শার্ট ইস্ত্রি করায় আর সন্তানদের হাসিমাখা তৃপ্ত মুখ দেখায় তৃপ্তি আর স্বাদ কম নয় বরং বেশীই।
তাদের উদ্দেশ্যে সবার মতো আবারো বলতে চাই, মাঝরাতে কোনরকম প্রসব ব্যাথা উঠলে বা বাচ্চা নড়াচড়া না করলে ডাক্তারদের কাছে আসবেন না। কি দরকার জনমদুঃখী ডাক্তারদের চিত্তবিনোদনের উপকরনে পরিণত হওয়ার? ডাক্তাররা আরামের বিছানা ফেলে পরিবার অগ্রাহ্য করে ভূল চিকিৎসা দিয়ে আপনাদের ক্ষতি করার জন্য ওৎ পেতে অপেক্ষা করে আছে। গুগল আর ইউটিউব এ সব বিস্তারিত বলা আছে দেখানো আছে। তাই নিজেদের সঠিক চিকিৎসাটি নিজেরাই করুন।

ডাক্তার বয়কট করুন, সুস্থ থাকুন।
_______________________________

ডা. নাজিয়া শুভ্রা। সুলেখক। ঢাকা।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়