Ameen Qudir

Published:
2018-04-08 16:26:25 BdST

মেডিকেলের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট মেয়েটি ঠিক করল বাচ্চা হবার ডেটের ৭ দিন আগেই সিজার করবে


প্রতিকী ছবি। ছবির মডেল বাংলাদেশ বা পশ্চিম বাংলার নন।




ডা. মিথিলা ফেরদৌস
_________________________________

আমার মেডিকেলের,আমার দেখা সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট মেয়েটি তার বাবু হবার সময় ঠিক করলো,বাবু হবার ডেটের ঠিক এক সপ্তাহ আগেই সিজার করবে।একে বলে ইলেক্টিভ সিজার।বেশির ভাগ ডাক্তার মেয়েই এমন ডিসিশন নেয়,মানে আমার পরিচিতদের মধ্যে।কিন্তু ভাগ্যদেবীর চিন্তা অন্য।সে যেদিন সিজার করবে ঠিক করলো,তার ঠিক তিনদিন আগেই তার লেবার পেইন উঠলো,ক্লিনিকে নেয়ার কিছু পরেই বাচ্চা হয়ে গেলো।বাচ্চা কিছু বড় হওয়ায়,বাচ্চা হবার রাস্তা কিছুটা কাটা হয়েছিল।আমি ওকে দেখতে গেলাম।বেচারি মুখ চোখ কালো করে রেখেছে,মহা বিরক্ত সে।বলে 'একে আমাকে লেবার পেইন সহ্য করতে হলো,তার উপর এপিসিওটোমি,কেমন লাগে বলো?এইজন্যে ডেট এক সপ্তাহ আগায় ঠিক করে রেখেছিলাম।'ওই মেয়ে এখন একজন গাইনীকোলোজিস্ট।ডাক্তার মেয়েরাই জানে নরমাল ডেলিভারির কি কি সমস্যা হতে পারে?

আমার লেবার পেইন উঠলো,সাত মাস বিশ দিনে।যেহেতু লেবারে চলে গেছি।ম্যাডাম বললেন,একটু ড্রিপ দিয়ে দেখি।আমি সাথে সাথেই না বলে দিলাম। ওইটা ছিল,আমার জীবনের সবচেয়ে ওয়াইজ ডিসিশন। বাবু একে তো প্রিমেচিউর ছিল।তার উপর ফিটাল ডিস্ট্রেস।তখনই আমার সিজার করা হলো।বাচ্চার অবস্থা ছিল খুবই খারাপ।উনিশ দিনে বাচ্চা সুস্থ করে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছিলাম।

অস্ট্রেলিয়ায় আমার পরিচিত একজন,সাতাশ ঘন্টা লেবারের ট্রায়াল দেয়ার পর তাকে সিজারে নিতে হয়।প্রতি ঘন্টা মনিটরিং এর জন্যে ডাক্তারকে হাইলি পে করতে হয়েছিল।আর মেয়েটির প্রচন্ড লেবার পেইন সাথে সিজার দুইটাই সহ্য করতে হয়েছে।কিন্তু ওই মেয়েকে একবার দেখলে যে কোন ডাক্তার একবাক্যেই বলবে তার নরমাল ডেলিভারি সম্ভব নাই।মেয়েটা অনেক শর্ট আর খুব বাল্কি ছিলো।নরমাল ট্রায়াল দেয়া যেতেই পারে তাই বলে সাতাশ ঘন্টা কি বাড়াবাড়ি না?
সিজার নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কিছু প্যানিক সৃষ্টি করা হয়েছে।

বেশ কিছুদিন আগে,এক মহিলার লেখা দেখলাম ব্যাপক শেয়ার হয়েছে।মহিলার লেখাটা দেখেই বোঝা যায়,ডাক্তারি সম্পর্কে মিনিমাম কিছু না জেনেই সস্তা জনপ্রিয়তার জন্যেই লেখা।যেহেতু ডাক্তারদের বিরুদ্ধে,আর সিজার নিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে লেখা, সেহেতু জনগন খুব খেয়েছে লেখাটা।আমি সেখানে কিছু প্রশ্ন করলাম।সে কোন উত্তর দিতে পারে নাই।প্রফাইলে দেখলাম,মহিলা হাউজ ওয়াইফ।পড়েছে,সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে।অদ্ভুত!!সিলেটে কোন মেয়েদের ক্যাডেট কলেজ আছে?

আমি বিভিন্ন সময় অনেক জায়গায় ফ্রি হেলথ ক্যাম্প করেছি,প্রচুর মহিলা রুগী পেয়েছি,নরমাল ডেলিভারির হিস্ট্রি, জরায়ুর মুখে কিছু বের হয়ে আসা।ইউটেরাইন প্রলাপ্স,যাতে জরায়ু ফেলে দিতে হয়।

কিছু কিছু নরমাল ডেলিভারিতে বাচ্চাকে অতিরিক্ত টানাটানির জন্যে,বাচ্চার জন্মগত ইনজুরি নিয়ে আসে,তার মধ্যে নার্ভ ইনজুরি সবচেয়ে মারাত্মক।যার জন্যে বাচ্চাটার সারাজীবন শরীরের কোন অংশ দুর্বল থেকেই যায়।

প্রলং বা অবস্ট্রাকটেড লেবার বা যখন কোন কারনে ডেলিভারি প্রলম্বিত হয়, বিভিন কারনে বাচ্চার পজিশন, মায়ের অবস্থা তখন অনেক সময় ফিটাল ডিস্ট্রেস হয়ে বাচ্চা মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

নরমাল ডেলিভারিতে অনেকসময় প্লাসেন্টা বা ফুলের অংশ থেকে যায় যা অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে মাতৃ মৃত্যুর আরেকটি কারণ। সিজারে প্লাসেন্টাকে সুন্দর করে বের করে আনা যায়।প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরনের চান্স কম থাকে।

বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু আর শিশু মৃত্যুর হার অনেক কম।এবং ওয়ার্ল্ড হেলথ ওর্গানাইজেশনের র‍্যাংকিং এ বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে আছে পার্শ্ববর্তী যেকোন দেশের তুলনায়।

আমি নরমাল ডেলিভারির বিপক্ষে বলছিনা,তবে নরমাল ডেলিভারির কন্ডিশন মেনেই তা না করলে,যা যা কম্পলিকেশন হতে পারে তাই বলাই আমার উদ্দেশ্য।সবচেয়ে বড়কথা নরমাল ডেলিভারি ট্রায়াল দিতে হয়,রুগী মনিটরিং করতে হয় আমাদের দেশের জন্যে সেই সিস্টেম বা ডাক্তারদের সেই সুবিধার কতটুকু দেয়া হয়?এখনে রুগীর তুলনার ডাক্তার অপ্রতুল রয়েই গেছে,একজন ডাক্তার কিভাবে ২৭ ঘন্টা রুগীর পাশে বসে থাকতে পারবে?তাহলে কি অন্য রুগীরা বঞ্চিত হবেনা?

শেষে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে দুইটা উদাহরণ দিতে চাই,আমার এক বন্ধু কিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশের অর্থোপেডিক সার্জনের খোজ নিচ্ছিলো, জিজ্ঞেস করলাম,"কেন?এত উন্নত দেশ!!,সে বলল,"খরচে কুলায় না রে।"
দুইদিন আগে, শুনলাম ওমানে একজন বাংলাদেশী ডাক্তার এক্সিডেন্ট করেছে,তাকে বাংলাদেশেই পাঠানো হচ্ছে,কারণ আমাদের দেশের নিউরোসার্জারী ডিপার্টমেন্ট অনেক ভাল।

নিজের দেশের ডাক্তারদের উপর আস্থা রাখুন।কোন ডাক্তার আপনার শত্রু না যে আপনাকে ভুল চিকিৎসা দিবে।কোন ডাক্তার ভুল চিকিৎসা করলে তার নিজের ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যাবে,নিজের স্বার্থেই কোন ডাক্তারই কোন রুগীর খারাপ চায় না।এই সামান্য জিনিস কেন সবাই বুঝতে চায়না।

সিজারের পক্ষে সাফাই গাওয়া আমার উদ্দেশ্য না,আমি গাইনীকোলোজিস্ট নই,জীবনে একটা সিজার করিনি,করবোও না।কিন্তু এই পোস্ট জনগণের সচেতনতার জন্যেই লেখা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের শুভেচ্ছা সকলকে।
_______________________________

ডা. মিথিলা ফেরদৌস। সুলেখক।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়