Ameen Qudir
Published:2018-04-07 17:06:48 BdST
১১ বার ফেল করায় মেডিকেল ছাত্রের আত্মহত্যা : একজন অধ্যাপক মনোরোগ বিশেষজ্ঞর বক্তব্য
অবিরাম পাঠ বিড়ম্বনার শিকার মেডিকেল শিক্ষার্থীর প্রতিকী ফাইল ছবি।
প্রফেসর ডা. তাজুল ইসলাম
__________________________________
১১ বার ফেল করা মেডিকেল ছাত্রের আত্মহত্যা : একজন মেডিকেল শিক্ষক ও সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে আমার কিছু মূল্যায়ন ।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রের ১১ বার ফেল করার হতাশায় আত্মহত্যা করার বিষয়ে কয়েকটি পোস্ট ও তাতে অসংখ্য ডাক্তারের মন্তব্য অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মেডিকেলের একজন সিনিয়র শিক্ষক ও সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে কিছু বলা কর্তব্য মনে করছি।
যারা লেখাটি পড়ছেন,দয়া করে শেষ পর্যন্ত পড়বেন,মাঝখানেই জাজমেন্টাল হয়ে পড়বেন না।
( যা বলবো তাকে ঢালাওভাবে গ্রহন করা ঠিক হবে না।এখনো বেশীরভাগ শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান সফল ও ন্যায়ভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহন করে থাকেন।)
তবে এর মাঝেও যে ক্রমশ অবক্ষয় হচ্ছে ও অনেক ক্ষেত্রে চরম অরাজক অবস্হা বিরাজ করছে সেটি অস্বীকার করলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হবে।
মেডিকেল শিক্ষা, তার মান ও অধগতি,অগ্রগতি নিয়ে বিশ্লেষণাত্বক অনেক কিছু বলার ছিল,তবে এবার সংক্ষেপে কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করবো।
পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষার তিক্ত ও অসচ্ছতার অভিজ্ঞতা নিয়ে একসময়ে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম।পরে অবস্হার আরো অবনতি দেখে অধিক শোকে পাথর হয়ে সিদ্ধান্ত নেই এসব নিয়ে আর কিছু লিখবো না।
তবে এ ঘটনাটি আমাদের আবারো জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে।আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে মেডিকেল পরীক্ষা পদ্ধতিতে গুনগত পরিবর্তন আনার।
আবারো বলছি ঢালাওভাবে নয়,তবে কিছু ক্ষেত্রে হলেও এবিষয়গুলোকে অস্বীকার করা কি যাবে?
( এগুলো সব সময়,সব দলের জন্য প্রযোজ্য)
১। মেডিকেল শিক্ষার গুনগত মান ক্রমশ কমছে?
২। ব্যক্তি স্বার্থে,গোষ্ঠী স্বার্থে নিছক বানিজ্যিক কারনে যত্রতত্র মেডিকেল কলেজ খোলা হয়েছে,হচ্ছে?
ও
৩। বিভিন্ন পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী বিকেন্দ্রীকরণের নামে এমন স্হানে ও কি নেওয়া হয়নি যেখানে এমবিবিএস পড়ানোর ও মতন লোকবল নেই?
৪। ভর্তি থেকে পাশ করা,পরে পদ ও বদলী,প্রমোশন,শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ,পরে কোন শিক্ষক পরীক্ষক হবে- ইত্যাদি প্রায় সব ব্যাপারে দলীয়,গোষ্ঠী গত বিবেচনা কি ক্রমশ বাড়েনি?
এসবের সবচেয়ে বড় কুফল হচ্ছে মেডিকেল পরীক্ষা পদ্ধতিতে অরগানাইজড গোষ্ঠী তন্ত্রের সৃষ্টি
১। আমার বিবেচনায় শিক্ষকরা হচ্ছেন মা- বাবার মতন।
তারা সন্তানের ন্যায় ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ভালো ফলাফলের জন্য উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সবরকমের চেষ্টা ও যত্ম নেন
।কোনভাবেই পড়ালেখায় কোন গাফিলতি মেনে নেয় না।আমরা কত জন সেভাবে তাদের তত্বাবধান ও প্রয়োজনীয় শাসনে রাখি?
২।তবে " পরীক্ষকরা" হচ্ছেন " বিচারকদের" মতন,যারা পরীক্ষা নেবেন মহান ন্যায় বিচারকের মতন।
কোনভাবেই কিছু অনৈতিক,বিবেকহীন মা- বাবার মতন স্বজনপ্রীতি করে প্রয়োজনে নিজেরা টাকা দিয়ে ফাস করা প্রশ্ন কিনে সন্তানদের হাতে তুলে দেবেন না।
তারা বিচার করবে( পরীক্ষা নিবে) অন্ধভাবে- কে আমার ছাত্র,আমার পক্ষের,আমার ফলোয়ার,আমার দলের/ গোষ্ঠীর,আমাকে তোয়াজ/ তেল দিয়ে চলে- ইত্যাদি বিবেচনা না করে।
কিন্তু
২। বর্তমানে ছাত্র ছাত্রীরা কি জ্ঞানী, একাডেমীক।প্রাজ্ঞ , গুনী শিক্ষকদের পিছনে ঘুরেন?
আমাদের সময় আমরা কে পরীক্ষক হবে সেটির চেয়ে, কে ভালো পড়ায়,ভালো জানে তাদের ক্লাশ নেওয়ার জন্য পিছনে লেগে থাকতাম।
কিন্তু বর্তমানে অনেক ছাত্র ছাত্রী ( সবাই না)যারা পরীক্ষক হন শুধু তাদের ক্লাশ করেন,তাদের রাউন্ডে ঘুরেন।
হাইলি একাডেমীক,গবেষক, প্রাজ্ঞ শিক্ষক যদি পরীক্ষক না হন, তাহলে তারা তাদের এড়িয়ে চলেন,তাদের ক্লাশে হাজির হওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না।
৩। এরকম হওয়ার কারন,কোন কোন প্রতিষ্ঠানে( সব জায়গায় নয়) মেডিকেল পরীক্ষা পদ্ধতি ২-৩ জনের কৌশলী ব্যবস্হাপনার অধীনে চলে গেছে।
কারা পরীক্ষক হবে,খাতা দেখবে,প্রাকটিকেল নেবে,ভাইবা নেবে এবং এসবের কম্বিনেশন কেমন হবে- ইত্যাদি ঐ ২-৩ জনের হাতে জিম্মি।
ফলে অন্য পরীক্ষকরা পাশ করালেও তারা ফেল করিয়ে দিতে পারে আবার কাউকে জেনিউন ফেল করালেও তাদের তৈরি সিস্টেমের কারনে নিশ্চিত পাশ করে যাবে।
এই যে কারো কাছে নিশ্চিত " পাশ" বা ফেল এর চাবিকাঠি রয়েছে-
এ জন্য সকল ছাত্র ছাত্রী তাদের অনুগত,তাঁবেদারি করাকে কর্তব্য জ্ঞান করে।
একই কারনে যারা ঐ শক্তি কেন্দ্রের বাইরে, তারা যত ভালো,গুনী শিক্ষক, এমনকি পরীক্ষক হোন না কেন তারা ঐ " নিশ্চিত " পাশের শিক্ষক / পরীক্ষকদের তুষ্ট রাখতে তাদেরকে এড়িয়ে চলেন,অন্যদের ক্লাশ করার তাগিদ অনুভব করে না।
৪। এরকম একচেটিয়া পদ্ধতির কারনে অনেক অযোগ্যরা অনায়াসে ও নিশ্চিত ভাবে পাশ করে যায়।আবার কিছু ভালো ছাত্র নিশ্চিত ভাবে ফেল করে যায়।
( ব্যক্তিগত ভাবে আমাকেও পরীক্ষক হওয়া থেকে বিভিন্ন কৌশলে বাদ রাখা হচ্ছে,এমনকি একাডেমিক আলোচনা অনুষ্ঠানে কৌশলে বাদ রাখছে।
আগে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হতাম,এখন হাসি পায়-
যখন টিভির লাইভ টকশোতে লক্ষাধিক লোকের সামনে থাকি,এমনকি অনলাইন পত্রিকাও কিছু গ্রপের ফেইসবুক লাইভে যখন কয়েক হাজার মানুষের সামনে থাকি,বি পজিটিভ বি হ্যাপী পোস্টে নিয়মিত লেখায় শত শত মানুষের অকুন্ঠ প্রশংসা ও ভালোবাসায় সিক্ত থাকি- তখন গোটা পাচেক সুবিধা সন্ধানীর সঙ্গে ছোট্ট মিলনায়তনের ডায়াসে বসা অস্বস্তিকর।)
যা হোক আমার উপরোক্ত বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে একমত নাও হতে পারেন।সেটি জরুরী ও নয়।
তবে আমার মূল বক্তব্য হচ্ছে বার বার ফেল করা দুর্ভাগা সে সব ছা্ত্র ছাত্রীদের নিয়ে ;
এবার দেখি যারা বার বার ফেল করছে তাদের দিকে-
৫। উপরে যে পরীক্ষা সিস্টেম এর কথা বললাম, এর বাইরেও যারা বার বার ফেল করে আমি নির্দ্বিধায় বলবো এরা হচ্ছে বর্তমান সমাজে সবচেয়ে দুর্বল শ্রেনীর লোক।
এরা ঐ গরিষ্ঠ চতুর ছাত্র ছাত্রীদের মতন ঐ পরীক্ষায় নিশ্চিত পাশ করে দেওয়া শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মতন চালাক- চতুর নয়,বা কোন দল,গোষ্ঠীর অনুগত নয়, এমনকি ব্যক্তিগত মাস্তানি করার মতন সাহসী (?) ও নয়।
এক কথায় তারা দুর্বলতম, তাই কোন পক্ষই তাদের কথা বিবেচনায় রাখে না।
তারা গননার বাইরে থাকে।তাদের নিয়ে তদ্বির করার,নেগোশিয়েট করার চাপ দেওয়ার কেউ থাকে না।
বর্তমান যুগে এরকম দুর্বল,বিচ্ছিন্ন মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা নয়।সেদিক থেকে ও তারা সংখ্যা লঘু।
৬। এর মানে এই নয় যে ফেল করাদেরকে পাশ করিয়ে দিতে হবে( তবে প্রশ্ন, কিছু লোকের জন্য নিশ্চিত পাশের ব্যবস্থা থাকবে তাহলে কেন?) ।
৭। ১১ বার ফেল করলে সে বিভাগ ও প্রতিষ্ঠান কি এটি এড়িয়ে থাকতে পারে? ১ বা২ বার ফেল করা আর প্রতিবার ফেল করাকে সমদৃষ্টিতে দেখার কি সুযোগ আছে?
৮। বার বার ফেল করার কারন,তাদের দুর্বলতা গুলো নিয়ে তাদের সঙ্গে বসা কি জরুরি নয়?
তাদের দুর্বল দিক কাটানোর জন্য একাডেমীক ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া কি অত্যাবশ্যক নয়?
৯।প্রতিটি মেডিকেল কলেজে সাইকিয়াট্রি বিভাগ রয়েছে।তাদের ব্যর্থতার কারন জানা,তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা জন্যর কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা কি নেওয়া আবশ্যকীয় নয়?
১০। সর্বোপরি মনোচিকিৎসকরা বাইরের সবার মানসিক সমস্যা, মানসিক রোগ, হতাশা,বিষন্নতার চিকিৎসা সহ আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করে থাকে,
সেখানে ঘরের ছেলে মেয়েদের জন্য তাদের কাজে লাগানো হবে না কেন?
আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব:
১। যারা বার বার ফেল করবে প্রতিটি বিভাগ/ প্রতিষ্ঠান তাদের জন্য একটি একাডেমীক সেল তৈরি করবে,যারা তাদের দুর্বলতা গুলো চিন্নিত করবে ও সে সব কাটিয়ে উঠার একাডেমীক কার্যক্রম গ্রহন করবে।
২। প্রতিটি সাইকিয়াট্রি বিভাগে নিজ প্রতিষ্ঠানের ফেল করা ছাত্র সহ,মানসিক সমস্যা, হতাশা,বিষন্নতায় ভোগা ছাত্র ছাত্রীদের জন্য আলাদা " বিশেষ সেবা" দানের জন্য একটি করে " টিম" গঠন করবে
# আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি,"নিশ্চিত পাশের" বদৌলতে যে সব অযোগ্যরা অনায়াসে পাশ করে বের হয়ে যাচ্ছে, তাদের তুলনায় ফেল করা ছাত্ররা,বিশেষ কার্যক্রমে উপযুক্ত হয়ে পাশ করে বের হলে তারা অধিকতর মানবিক,ও দক্ষ ডাক্তার হয়ে উঠবে
# আমার মতের সঙ্গে দ্বিমত থাকতেই পারে।সে ক্ষেত্রে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে আপনার ভিন্ন ও গঠনমূলক মতামত রাখুন
# কোনভাবেই কেউ যেন এই ঘটনায় ঢালাওভাবে শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত ও গালমন্দ না করেন।
সবাই ভালো থাকবেন ।
____________________________
প্রফেসর ডা. তাজুল ইসলাম
সোশাল সাইকিয়াট্রস্ট
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
কমিউনিটি এন্ড সোশাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল,ঢাকা
e- mail: [email protected]
আপনার মতামত দিন: