Ameen Qudir
Published:2018-03-14 18:03:04 BdST
শোক এপিটাফনেহার নেপালে ফেরা এবং এন লেখা সেই লকেট
ছবিতে বাবা মার সঙ্গে ইউএস বাংলা বিমান ট্রাজেডিতে প্রয়াতদের একজন । ফাইল ছবি।
ডা.ছাবিকুন নাহার
_____________________________
এক.
বুকের ভেতরটা থমকে আছে। একটা জগদ্দল পাথর যেনো পাঁজরে ঠেসে বসে আছে। ঠিকঠাক শ্বাস নিতে পারছিনা। অক্সিজেনের ঘাটতি। ধরফর করে ঘুম থেকে উঠলাম। পড়তে পড়তে চোখটা একটু লেগে এসেছিল। আজ শেষ পরীক্ষা। ফাইনাল প্রফ। আহ! মুক্তি! এক মাস টানা ঘুমাবো। চোখ খুলে দেখব, মা কপালের কাছে ঝু্ঁকে আছে।
এই নেহা, এই কী মা মা করছিস? পরীক্ষা দিতে যাবি না? সময় হয়ে এলো তো। তাড়াতাড়ি চল।
নেহা, লজ্জা পেয়ে যায়। ওর ঘুমের মধ্যে কথা বলার বাতিক আছে। সব কথা ওর মা, বাবা, ছোট্ট ভাই সঞ্জিত কে নিয়ে। রুমমেটরা এ নিয়ে কত্ত ক্ষেপায়। ও কিচ্ছু মনে করেনা। সঞ্জিতটা নিশ্চয় বড় হয়ে গেছে। ও যখন বাংলাদেশে পড়তে আসে, ছোটো তখন সিক্সে পড়ত। একদম নেওটা ছিলো নেহার। এবার এসএসসি দিলো। মুখে গোঁফের ফিনফিনে রেখা। কন্ঠ গমগমে। সেদিন ইমোতে কথা হচ্ছিল। কী একটা কথায় দারুণ লজ্জা পেলো। দিদি...! বলে চিৎকার করে ওঠল। ভাইটা আমার কত বড় হয়ে গেছে! আমার স্পর্শ ছাড়াই। আহারে! ভাবে নেহা। অথচ আগে যখন তখন আমার কোলে ঝাঁপায়ে পড়ত। কত আক্ষেপ ছিলো আমার প্রতি! মা নাকি আমাকে বেশি ভালোবাসে!
মাকে এ নিয়ে কত অভিযোগ শুনতে হতো। মা সঞ্জিত কে বোঝানের চেষ্টা করত।
দিদি তো বাংলাদেশে চলে যাবে পড়াশোনা করতে, বাবা। পাঁচ বছরের জন্য। ডাক্তারি পড়া অনেক কঠিন। বাচ্চা আমার বিদেশ বিভু্ঁয়ে কী খাবে না খাবে। তুমি তো আমাদের সাথেই থাকবে বাবা।
কথা শুনে সঞ্জিতের ভয় লেগে যেতো। সত্যি দিদি তুই চলে যাবি? তোকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। বলেই শক্ত করে নেহাকে আঁকড়ে ধরে। বেশি করে। দিদি...

ছোট্ট বেড়ালের মতো লেপ্টে থাকে নেহার সাথে। তারপরও ওর মন ভরত না যেনো। নেহা ফিসফিস করে বলে, ভাই আমার। আমি ছুটি পেলেই তোর কাছে চলে আসব। দেখিস তুই। আমি একটি দিনও তোকে ছাড়া থেকেছি?
বলেই চুপ করে যায় নেহা। ওর আর সঞ্জিতের পড়াশোনার খরচ চালাতে বাবার কত কষ্ট করতে হয়। চারজনের সংসার চালাতে মাকেও যে দাঁতে দাঁত চাপতে হয়। তারপরও মেডিকেলে পড়ার খরচ। আরো কত কী! ছুটিতে যাওয়ার মতো বিলাসিতা তাদের জন্য না। কিন্তু সঞ্জিতকে সান্ত্বনা দিতে ভালো লাগে নেহার। ভালো থাকার অভিনয় মধ্যবিত্তরা জন্মগতভাবেই রপ্ত করে ফেলে। এটা এদের সহজাত। কাউকে শেখাতে হয়না।
যেদিন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলো, সেদিনের কথা নেহার স্পষ্ট মনে আছে। মা হাসি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কী যেনো বলতে গিয়ে টপটপ করে চোখের পানি পরছিলো। মা কথা শেষ করতে পারলেন না। কান্নার ধমকে কেঁপে কেঁপে ওঠছিলেন।
বাবা কপট বকা দিচ্ছিলেন,
কী করো তুমি! মেয়ে আমার ডাক্তার হয়ে দেশে ফিরবে। তুমি দেখো। সবাই আমাকে বলবে, শাবাশ বাবা তুমি। ট্যাক্সিচালক হয়েও মেয়েকে ডাক্তার বানিয়েছ!
ডাক্তারের বাবা হওয়ার আনন্দে বিভোর বাবার চোখ। সে চোখের দিকে তাকিয়ে নেহা বেশি বেশি করে পড়ত। আইটেম, কার্ড, টার্ম, ইয়ার ফাইনাল, প্রফ। একটার পর একটা পর্ব পার হয় আর ভাবে, কবে শেষ হবে এই জার্নি? কবে ফিরবে প্রিয় দেশে? প্রিয় আবহে। মায়ের কোলে? কবে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে? কতদিন মায়ের হাতের রান্না খাই না। কতদিন!
ধুরর! আমি যে কী! প্রবোধ দেয় নেহা। নিজেকে নিজে। এই তো। আর কটা দিন। ফাইনাল প্রফ শেষ। ডাক্তার হয়ে যাবো। ইয়াআআআআ! বাবা আমি আসছি। আমি ডা. নেহা। আমি তোমাদের মেয়ে! ডাক্তার হয়ে গেছি গো। আর মাত্র কটা দিন। দেখো। আহ্!
দুই.
পাঁচ বছরে খুব কি চেঞ্জ হয়েছে নেহা? সঞ্জিত? বাবার চুলে সাদা আভা। মায়ের চোখের নিচে ভাঁজ। সঞ্জিতটার বড়ো হয়ে ওঠার স্বাক্ষী না হতে পারার দুঃখ। নিজেকে নিজে সামলিয়ে রাখার গল্প, সব নেহা জমা করে রেখেছে। ভেবে রোমাঞ্চিত হয়, রিদানের কথা কীভাবে বাবাকে বলবে! রিদান তো ওর সাথেই পড়ে। একই মেডিকেলে। নেপালেরই। ভদ্র। বাবা নিশ্চয় অমত করবেন না। যখন শোনবেন, এই বিদেশ বিভুঁয়ে তার মেয়ের মনখারাপ দিনের ছায়া হতো রিদান।
একই ফ্লাইটে যাচ্ছে ওরা। আর কিছুক্ষণ! আহ! নেপাল। প্রিয় স্বদেশ আমার! নেহার চোখ আনন্দে ভিজে ওঠে।
ঐ তো মা, বাবা! ঐ যে পাশে সঞ্জিত নাহ! কত্ত বড় হয়ে গেছে! ইশ, হুড়োহুড়িতে ঠিকঠাক দেখতেও পাচ্ছি না। চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা দায়। সব ঠিকঠাক চলছিলো। প্লেনে আমরা তেরো জন হবু ডাক্তার। দুই জোড়া কাপল ও ছিলেন। কী সুন্দর দেখতে একটা বাবু ছিলো! সারাক্ষণ কুটুকুটু কথা বলছিলো। মনমাতানো সব কথা! একজন আপু দেখলাম দুই হাতে জমাট করে মেহেদী দেওয়া। সুন্দর দুটো রিং ঝকমক করছিলো হাতে। শুনলাম সদ্য বিয়ে করে হানিমুনে যাচ্ছিলেন। আমার প্রিয় দেশ নেপালে। মনটা গর্বে ভরে যাচ্ছিল।
পুরো ফ্লাইটে অর্ধেকের বেশি ডাক্তার, হবু ডাক্তার। কয়েক জোড়া হানিমুন কাপল। সবার ভিতরই একটা মিল। প্রায় সবাই যাচ্ছে বেড়াতে। অবকাশ যাপনে। আনন্দ ভ্রমনে। হঠাৎ কী যে হলো! কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। আগুণ। আমি চিৎকার করছিলাম। পুড়ে যাচ্ছে সঞ্জিতের জন্য কেনা গিফ্ট বক্স, মেডিসিনের বাইবেল খ্যাত প্রিয় বই ডেভিডসন। পুড়ে যাচ্ছে তোমাদের মেয়ে নেহা। নেহার অবয়ব, আইডেন্ডিটি। ডাক্তার হবার স্বপ্ন। সব।

বাবা কান্না থামাও। মাকে ধরো। এই যে আমি! তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছি। চিনছ না কেনো? আমার সব পুড়ে গেছে, নাহ? এই জন্যই তোমাদের চিনতে কষ্ট হচ্ছে মনে হয়। আমি নেহা... মা আমি নেহা...তোমাদের নেহা...এই দেখো তোমার দেয়া লকেট... এন লেখা...মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর তুমি বানিয়ে দিয়েছিলে...আমি সব সময় পরে থাকতাম মা।
একটু বুদ্ধি খাঁটাও। আমাকে চেনার চেষ্টা করো। এই যে আমি। হ্যাঁ হ্যাঁ এই দিকেই। এমন সময় সঞ্জিত চিৎকার করে ওঠল। দিদি...আমার দিদি... লকেটটা সঞ্জিতের হাতে। এতক্ষণ ও একটুও কাঁদে নি। এই প্রথম আমাকে পাওয়ার সুখে, সমানে কেঁদে যাচ্ছে ভাই আমার। অবশেষে আমি আমার পরিবারের সাথে...
রিদানটা আবার কই গেলো! এই ছেলেটার বুদ্ধি সুদ্ধি হলো না আর। এই ফাঁকে একটু পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম। ইশ, ওর গালায় কিংবা হাতে যদি লকেট বা ব্রেসলেট টাইপের কিছু থাকত!
_________________________
ডা.ছাবিকুন নাহার
মেডিকেল অফিসার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।
আপনার মতামত দিন: