Ameen Qudir

Published:
2018-03-09 00:30:57 BdST

নারী দিবস ও একটি জাতির ঘুমিয়ে থাকার গল্প



ডা রাজীব দে সরকার
____________________

রহস্য আমার বেশ ভালো লাগে।


গ্রামে গঞ্জে অনেক ধরনের রহস্য প্রচলিত আছে। আমার গ্রামেও আছে। গ্রামে নাকি রাতের বেলা অশরীরী মানবীরা হেঁটে বেড়ায়। এই রহস্য আমার ব্যবচ্ছেদ করার ইচ্ছে নেই। কিছু রহস্য, রহস্য থেকে যাওয়াই ভালো।


গ্রামের পথ পার হয়ে মফস্বল এর সড়কে বাইক চালাচ্ছিলাম। একটা চায়ের দোকান দেখে নামলাম। রাত ৮ টার মতো বাজে।

চায়ের দোকানে মাঝ বয়সী একজন মানুষ দেখা গেলো। মাথায় অদ্ভূত রঙের টুপি। তিনি বেশ আয়েশ করে চা খাচ্ছেন।

দোকানীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন,
> "কিছু শুনছো নি মিয়া? ইদানিং রাইতের কালে কী সব হয়? কারে কারে জানি দেখা যায়।"
>> "এডির কথা রাইতে কইয়েন না বাই।"

আমি বোকার মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম,
"কী হচ্ছে ইদানিং? রহস্যজনক কিছু?"

আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোকের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যেন তিনি মনের মতো শ্রোতার অপেক্ষায় ছিলেন এতোক্ষণ।

লোকটা আয়েশ করে চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে শুরু করলো,
"কথাডা আমি আমাগো ইউএনও নাসার উদ্দিন সাবেরেও কইছি। আমগো এলাকায় জামেলা আছে। মোড়ের তে আরেট্টু আউগাইয়া যাইবেন। বসন্তপুর যাওন লাগবো না। তার আগেই। ঐহানে লম্বা একখান পুশকুনির পাড়ে কাঠাল গাছ আছে। ঐ গাছের আশে পাশে প্রায় রাতেই মেয়েরা হাঁটে। ইয়ে... মেয়ে মানে মাইয়া মানুষ না, অন্য কিছু। রাইত বিরাইতে কইতেও পারতাছি না। ঐদিক যাইয়েন না রাইতে। দিনের বেলাও হুশ কইরা মিয়া"

আমি রহস্যটাকে কীভাবে নেবো বুঝতে পারছি না। আগেই বলেছি রহস্য সমাধান বা ব্যবচ্ছেদ এর পক্ষে আমি কখনোই নই।

আমার চা খাওয়া শেষ। টাকা দিয়ে আমি বাইক স্টার্ট দিলাম। আমার গ্রামে ফিরে যাবো।


(২)

বাইকের দু'পাশ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস কান ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে। চৈত্র মাসেও একটা হিমেল আমেজ।

অন্ধকার কেটে বাইকের হেডলাইট ছুটে যাচ্ছে মফস্বল এর মহাসড়কের মাঝ দিয়ে। দু'পাশে সারি সারি গাছ যেন চাদরের মতো আগলে রেখেছে এই সড়ক।

কুয়াশা কুয়াশা একটা ভাব। গ্রামে এটা হতেই পারে। শীত এখনো কাটেনি।

হঠাৎ আমি হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। আমি রীতিমতো ভয় পেলাম।

পিক আপ টেনে স্পীড কিছুটা বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু এখনো আমি হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ঠান্ডা বাতাস আরো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আমার নখের মাথায় আমি স্পষ্ট শীতল ছোবল অনুভব করছি। খটকা লাগছে আমার এগুলো।

লক্ষ্য করলাম, আমার বাইকের স্পীড কমে আসছে একাই, অথচ আমি পিক আপ কমাইনি একটুও। কিছুদূর গিয়ে আমার বাইক থেমে গেলো।

এই শীত কুয়াশার মাঝেও আমি ঘেমে শেষ। আমি বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালাম। উপায় নেই। বাইকের স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেছে।

আমি প্রায় কিছুটা দৌড়ে রাস্তার মাঝে সে দাঁড়ালাম। বেশ দূরে ১০-১২ জন এর একটা দল দেখা গেলো। ওরা হেঁটে যাচ্ছে। আমার দিকেই আসছে। যে পথ ধরে আমি এতোক্ষণ এলাম ওরা ওখানেই যাচ্ছে। ক্রমেই ওরা আমার কাছে চলে এলো। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছি। আমার হৃৎকম্পন যেন আমি নিজে শুনতে পাচ্ছি। ওরা আমার খুব কাছে এগিয়ে এলো।

- "আমাদের সাথে চলো। যাবে?"
- আ...আপনারা কারা? কোথায় যাচ্ছেন? আমি যাবো না।"

- "আমরা জানি, তুমি যাবে না। তোমাদের কেউ যাবে না। যাবার কথা না।"
- "না আমি যাবো না। আমাকে ছেড়ে দেন প্লিজ।"

- "আমরা বসন্তপুরের পথে যাচ্ছি। মোড় পেরিয়ে সেই পুকুরটা। সেই কাঠাল গাছটা। সেখানে যাচ্ছি। ওখানে একটা মেয়ে নাকি খুব কাঁদছে। ওর সাথে তোমরা সেই পুরোনো কাজটাই করেছো। লজ্জা তোমাদের রক্তে নেই। আমরা ঐ মেয়েটাকে দেখতে যাচ্ছি।"
বলেই হো হো করে হেসে উঠলো ঐ দলের সবাই।

আমি লক্ষ্য করলাম সেখানে সবাই মেয়ে। ১০/১২ বছরের মেয়ে থেকে মাঝ বয়সী মেয়েরা। সবাই সুন্দর করে সেজেছে। ভয় পাবার মতো কিছু নেই ওদের মাঝে।

- "আপনারা এভাবে হাসছেন কেন?" আমার সাহস কিছুটা জমিয়ে প্রশ্নটা করলাম।
- "কাল নাকি তোমাদের গোয়ালন্দ উপজেলায় নারী দিবসে মিটিং হবে, মিছিল হবে, টিভিতে টিভিতে টক শো হবে। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হবে, হাতে হাতে বিরিয়ানী-বোরহানির ফোয়ারা ছুটবে। এসব দেখেই আমরা হাসি।"

- (আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না, চুপ রইলাম, উনি বলেই যাচ্ছেন)
- "শোনো মানুষ, শোনো সভ্যতার ধারক, আগামীকাল নারী দিবস। সেই দিবসে তোমাদের আয়োজন দেখে আমরা হাসি। আমাদের হাসি পায়। নারী দিবস বোঝো? নারী বোঝো? নারী দিবসে এক বিন্দু কিছু করার অধিকার তোমাদের নেই। চেয়ে দেখো এই মাটির দিকে... কান পাতো এই সারি সারি গাছের বুকে। তুমি শুনতে পাবে, আর্তনাদ। বেঁচে থাকার আর্তনাদ। ছেড়ে দেবার আর্তনাদ। এই মাটি, এই বাতাস, অজস্র মেয়ের কান্নার ভারে ভারী, অজস্র মরদেহের উষ্ণতাহীনতায় শীতল। এই মাটি ভিজেছে অসংখ্য নারীর শাপির অশ্রুর লোনা লাভায়। যে মাটি নারীর অভিশাপে আচ্ছাদিতে, সেখানে কী নারী দিবস করা মানায়? আমাদের দিকে তাকাও। আমরাও এই মাটির সন্তান। অথচ কী না নিখুঁত কুৎসিত অন্ধকারে তোমরা ঢেকে দিয়েছো আমাদের বেঁচে থাকাটুকুকে। বসন্তপুরের কাছে আমাদেরই আরো এক বোনকে তোমরা দিয়েছো তোমাদের পাশবিকতার আচড়। আমরা ওখানে যাচ্ছি। ঐ কাঠাল গাছ, ঐ ঘাট পুকুর, ঐ অন্ধকারের কাছে আমরা বিচার দেবো। দোহাই তোমাদের তোমরা যাই করো, নারী দিবস করো না কখনো। তোমাদের নারী দিবসের বর্ণিল উৎসব আমরা সহ্য করতে পারি না, পারি না, আমাদের কষ্ট হয়। আমাদের পাজর ভেঙ্গে আসে ঘৃণায়। ধর্ষকের বিচার করে না যে জাতি, সে জাতি ধর্ষনের উৎসব করুক, লাম্পট্যের কার্নিভাল করুক, কিন্তু নারী দিবস না... কোন নারী দিবস না।"

হঠাৎ অদ্ভূত এক নীরবতা নেমে এলো রাস্তায়। কারো কোন কথা শুনতে পাচ্ছি না। কোন ঝিঁ ঝিঁর ডাকও নেই এখন।

আমার কী হলো আমি জানি না।

মেয়েদের দলটা সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আমার ঘাড় শক্ত হয়ে যাচ্ছে।

আমি আমার বাইকের দিকে যেতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। আমার শরীর অবশ হয়ে আসছে। আমি ঘুমিয়ে যাচ্ছি। প্রবল আসক্তির সে ঘুম। গভীর সে ঘুম। যে ঘুম আমার কেউ ভাঙ্গাতে পারে না। আমার ঘরের সামনে আমাদের দেশের কোন নারী পশুর নখের আচড়ে হতাহত হলেও ভাঙ্গেনা আমার সে ঘুম। যে ঘুম ভাঙ্গে না কোন মেয়ের আর্ত চিৎকারে, যে ঘুম ভাঙ্গে না কোন অসহায় মেয়ের মুক্তির আস্ফালনে। হাজার বছরে জীর্ণ শীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে সভ্যতার ঘরে ঘরে পালা করে নারী দেহ ভোগের বর্ণীল মহোৎসবেও যে ঘুম ভাঙ্গে না। সেই ঘুমে ঘুমিয়ে যাচ্ছি, আমি, আমরা সবাই।

ঘুমের ঘোরে আমরা স্লোগান দেই। ঘুমের ঘোরে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার আগুন ধরিয়ে প্রতিবাদী হই। ঘুমের ঘোরে আমরা বুঝি না আরো কতটুকু ঘুমালে আমাদের জাগার সময় হবে।

ধিক্কার হে বিবেক আমার
আমার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে তুমি মঞ্চে ওঠো, বক্তৃতা করো, কবিতা-গল্প লেখো।
ধিক্কার হে বিবেক আমার
তোমার মুখে নষ্টামি মানায়, নারী দিবস না।
______________________

ডা রাজীব দে সরকার
রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
প্রচার ও জনসংযোগ সম্পাদক, বিএমএ, রাজবাড়ী
আহবায়ক, সুহৃদ সমাবেশ, গোয়ালন্দ।

আপনার মতামত দিন:


মানুষের জন্য এর জনপ্রিয়